যার যত আছে সে তত চায়। বাংলায় এই প্রবাদটি এতটাই বেশি সত্যি যে করোনার মতো দুঃসময়েও নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত কেউ কেউ। লজ্জা,ঘৃণা,সঙ্কোচের কোনো বালাই নেই। দেশের মানুষের প্রতিক্রিয়ায় এদের কিছু হয় না। তাদের সম্মানের চামড়া এতই মোটা যে তাদের কোনোভাবেই লজ্জা দেওয়া যায় না। সারা পৃথিবীতে এখন করোনার কাল চলছে। বৈশি^ক এই মহামারীতে একমাত্র মানবতাই পারে আমাদের এই ঘোর সংকট থেকে রক্ষা করতে। একজনের হাত অন্যজনের দিকে বাড়িয়ে দিয়েই এই পৃথিবীকে আবার সুন্দর করে তুলতে পারি। দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে মানুষকে করোনার প্রকোপ থেকে বাঁচাতে ঘরে থাকার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। চলছে ছুটি। বন্ধ রয়েছে মার্কেট,গণপরিবহন। এমতাবস্থায় সবচেয়ে দুর্দশায় রয়েছে যারা দিন আনে দিন খায় এমন মানুষগুলো। তাদের মুখে খাবার তুলে দিতে দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বহু সংস্থা,সংগঠন,ব্যক্তি কাজ করে যাচ্ছে। সবার প্রচেষ্টা একটাই। কেউ যেন না খেয়ে থাকে। ফোন দিলেই খাবার সরকারি কর্মকর্তা নিজে খাবার পৌছে দেয়ার খবরও আমরা পড়েছি। এটাই মানবতা। সারাদেশে অসহায় নিরন্ন মানুষের সাহায্যের জন্য ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। অথচ তা অনেকের পেট মোটা করার কাজে লাগছে। সেইসব লোভী মানুষগুলোর জন্য ঘৃণা করে যথেষ্ট হবে না। দশ টাকা মূল্যের চাল যখন নিজের পকেট ভারী করতে অন্যত্র সরিয়ে দেয় এবং মিডিয়ার কল্যাণে যখন এসব চাল চোরের খবর আমরা দেখতে পাই তখন সত্যি ভারী অবাক হতে হয়। অবাক হই এটা দেখে যে এরা মনুষ্যত্বের পুরোটাই খেয়ে বসে আছে।
সরকারের এই সদিচ্ছাকে বাস্তবে রুপ না দিয়ে এরা তার বাধার সৃষ্টি করছে। মানুষের হক মানুষকে না দিয়ে নিজের পকেট ভারী করছে। কি লাভ এই দুঃসময়ে মানুষের সাথে এত বড় প্রতারণা করে। নিজেদের স্বভাবটা একটু বন্ধ করলে কোনো ক্ষতি হয় না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই যুগে এদের ছবিগুলোও আমরা দেখছি। দেখতে মানুষেরই মতো। আসলে মানুষ না। মনুষ্যত্ব না থাকলে যে মানুষ হওয়া যায় না। মানুষ হতে হলে বিবেক,মানবতা ও মনুষ্যত্বের প্রয়োজন হয়। এদের তা নেই। আর কোনোকালে তা থাকলেও লোভের কাছে সেসব বশ্যতা স্বীকার করেছে। আমরা এখন এমন সময়ে এসে দাড়িয়েছি যখন পুরো মানব সভ্যতাই হুমকির মুখোমুখি। প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে সংখ্যা বাড়ছে। এখন মানুষের স্বপ্ন কিভাবে মানব জাতিকে এই মহাসর্বনাশের হাত থেকে রক্ষা করা যায়। এখন বিচ্ছিন্ন নয় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময়। বিশ^জুড়ে বিরাজ করছে নিস্তবদ্ধতা। খেটে খাওয়া মানুষগুলো রয়েছে সবচেয়ে বিপাকে। এসব অসহায় মানুষগুলোর জন্যই এসব ত্রাণ দেয়া হচ্ছে বা দশ টাকা কেজি দরে চাল বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। যাতে তারা দুমুঠো খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে। বেঁচে থাকাই বা করোনামুক্ত থাকাই এখন চ্যালেঞ্জ। যেখানে আমাদের দেশেও প্রতিদিন করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এই দুঃসময়ে এসব আয়রোজগারহীন অসহায় মানুষ ও তার পরিবারকে সাহায্য করে বাঁচিয়ে রাখার বিকল্প নেই। অথচ এখান থেকেও যারা চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন করে নিজের ফায়দা লুটতে ব্যস্ত তাদের দেখতে মানুষ মনে হলেও আদতে তারা মানুষ নয়। তাদের থেকে বড় বেঈমান আর কেউ হয় না। মানুষ মানুষের জন্য। এই কথাটি প্রমাণ করার সময় এসেছে। আমাদের দেশের মানুষ তা প্রমাণ করছে।
এরই মধ্যে কেউ কেউ কাঁটা হয়ে চুরি করতে ব্যস্ত। নভেল করোনা ভাইরাসের প্রভাবে মানব সভ্যতা আজ মহা সংকটে পরেছে। এর আগে যত মহামারী এসেছে সেসব মহামারীতেও সভ্যতা এরকম মহাসংকটে পরেছে। আবার মহামারীর প্রকোপ একসময় চলেও গেছে। কোটি কোটি প্রাণও গেছে। কিন্তু মানুষ ঠিক ঘুরে দাড়িয়েছে। পৃথিবী এগিয়ে চলেছে। এসবই হয়ে এই মানুষের জন্যই। এখন পর্যন্ত এটা স্পষ্ট নয় করোনা ভাইরাসের তান্ডব পৃথিবীতে আর কতদিন চলবে। আর কত প্রাণ যাবে এই ভাইরাসে। তবে এই করোনা ভাইরাসের প্রকোপও একসময় কমে যাবে। এর ভ্যাকসিন আবিষ্কার হবে। মানুষ আর করোনা ভাইরাসকে ভয় পাবে না। তবে করোনা ভাইরাস যতদিনে দুর্বল হবে ততদিনে মানুষের আর্থিক সমস্যা প্রকট হবে। সেই সমস্যাকে দূর করতেও প্রয়োজন একতা। এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পাবার উৎকৃষ্ট উপায় হলো নিজেকে ঘরের ভেতর রাখা। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং একইসাথে কঠিন কাজ। কর্মমুখর মানুষগুলোকে ঘরে রাখা সহজ কাজ নয়। বিশেষ করে বাইরে বের না হলে যারা তাদের পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দিতে পারে না এরকম লাখ লাখ কোটি কোটি মানুষকে ঘরে রাখা। বহু মানুষ তবুও নিয়ম উপেক্ষা করেও বাইরে বের হচ্ছে। এদের মধ্যে একটি বড় অংশই পেটের তাগিদে বের হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সবাইকে ঘরে থাকতে হবে। নিজেকে ও নিজের পরিবারকে করোনা ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচাতে হলে এটা করতেই হবে। এজন্য প্রয়োজন তাদের খাদ্যে নিশ্চিত করা যারা একদিন বাইরে না বের হলে সেই পরিবার অভুক্ত থাকবে। এই কাজটি সহজ নয়। এক্ষেত্রে প্রত্যেকের সহায়তা প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে রাজনীতিবিদরা। জনগণের কাছে থাকে তারাই। জনগণ যাদের আশায় দিন কাটায় তারা রাজনীতিবিদ। একেবারে মফস্বল পর্যায় পর্যন্ত জনগণ তাদেরই ভরসা করে। এই ভরসার স্থান থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। এছাড়া সামর্থ্যবান প্রতিটি ব্যক্তি,প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। চাল চুরি করে নয় বরং তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে বিশ^স্ততার প্রমাণ দিতে হবে। এই দুঃসময়ে নিজের মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তুলতে হবে। যেখানে সরকার প্রাণপন চেষ্টা করছে করোনাকালীন সময় মানুষের ঘরে থাকা নিশ্চিত করতে এবং তাদের খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করতে সেখানে কোনো দুর্নীতি চলবে না।
বাংলাদেশের মানুষ সবসময়ই মানবিক। তার বড় উদাহরণ হলো রোহিঙ্গা। স্বদেশে নির্যাতিত হয়ে যখন লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আমরা আশ্রয় দিতে পেরেছি তখন করোনাকালীন সময়েও আমরা মানুষের পাশে দাড়িয়ে প্রমাণ করতে পারবো আমরা মানুষ। করোনা একটি মহাদুর্যোগ। কেউ বলেন এটি প্রকৃতির প্রতিশোধ। কেউ বলে মানুষের কর্মফল। আমরা যাই বলি না কেন, এটি একটি সংকট এবং আমাদেরই তা মোকাবেলা করতে হবে। এসময়ে কোনো অবস্থাতেই আমরা নিজের নিজের দায়িত্বকে অস্বিকার করতে পারি না। তবে প্রচার সর্বস্ব সাহায্যের হাত বাড়িয়ে লাভ নেই। অনেক ক্ষেত্রেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব ছবি আমরা দেখি তা দেখে মনে হয় সাহায্যের জন্য নয় এসব সাহায্যকারীর মূল উদ্দেশ্য আতœপ্রচার। আতœপ্রচার আজকের দিনে সাধারণ ঘটনা। তবে এই সময় এই আতœপ্রচারটুকু না করলেই ভালো। অন্তত নিজেদের হাস্যকর করে তোলার চেষ্টা না করাই ভালো। একটু ভাবুন যারা অসহায়দের সাহায্য করে সেই ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিচ্ছেন সেখানে স্পষ্টতই বোঝা যায় এখানে মুখ্য ছিল প্রচার। এই প্রচারের দরকার নেই। নাম সর্বস্ব সাহায্যের চেয়ে নিশ্চুপ থাকা উত্তম। এতে অন্তত নিজেকে হাস্যকর করার হাত থেকে বাঁচা যাবে। এখন দরকার মানবতার। চুরি নয় দরকার বরাদ্দের বাইরে নিজের থেকে আর একটু বাড়িয়ে দেয়ার। দরকার ভালোবাসার। আমাদের বুঝতে হবে পৃথিবীটা সবার জন্য। প্রত্যেকের বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। আর এজন্য দরকার মানুষ মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসার। আর যারা এখনো নিজের অভ্যাস বদলাতে পারবেনা না, গরীবের বরাদ্দ আতœসাৎ করার চেষ্টা করবে তাদের জন্য কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
অলোক আচার্য
শিক্ষক ও কলাম লেখক