পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার প্রায় ২ লাখ মানুষ বসবাস করে। জেলার ৭টি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে হতদরিদ্র ও খেটে খাওয়া সল্প আয়ের মানুষের বসবাস নাজিরপুর উপজেলা। এখানে নেই কোন কলকারখানা বা শিল্পাঞ্চল। নেই কোন বড় বড় ধনাঢ্য ব্যবসায়ী বা দানশীল ধনীদের বসবাস। এখানকার অধিকাংশ মানুষের পেশাই কৃষি বা দিন মজুর। কেউ কেউ ভ্যান, রিক্সা, অটো বা ভাড়ায় চালিত মোটর সাইকেল চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। আবার কেউ কেউ হাটে-বাজারে বা ফেরী করে ছোটখাটো ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করে। কষ্টগুলো প্রকাশ করতে মানা আর জীবনের কোন ক্রান্তিলগ্নে খুব কান্না এলে তাতেও যেন মানা। কাঁদলেও কাঁদতে হবে নিরবে নিভৃতে। এক কথায় মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে জন্মগ্রহণ করা মানুষের জীবনের গল্প ঠিক এমনই। বিশ্বব্যাপী মহামারী আকার ধারণ করা ঘাতক ব্যাধি করোনা ভাইরাস সংক্রামণের বিস্তার বাংলাদেশেও ক্রমাগত ভাবে বেড়েই চলছে। ভাইরাস সংক্রামণের বিস্তার রোধে সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী নাজিরপুর উপজেলায় ওষুধ ও নিত্য প্রয়োজনীয়পন্য ছাড়া সব ধরনের দোকানপাট অনিদির্ষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সেই সাথে বন্ধ হয়ে গেছে মধ্যবিত্ত পরিবারের আয় রোজগারের পথ। প্রশাসনের নির্দেশ মেনে বাজারে ভাড়া নেয়া দোকান গুলো বন্ধ রয়েছে। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হতে মানা। তারপর পরিবারের খাবার সংগ্রহের জন্য বাজারে আসতে বাধ্য হন অনেকেই। এদিকে, উপজেলার অনেক ছোট-বড় ব্যবসায়ীই পরিবার নিয়ে বেচেঁ থাকার জন্য নিজের কাছে জমানো সামান্য পুজিঁ ও লোন করে ঘর মালিককে অগ্রিম টাকা দিয়ে দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করে আসছিলেন অনেকে। এতে তাদের মাথার উপর প্রতিদিন ভর করছে বাড়তি ঋণের বোঝার চাপ। আর সেই সাথে পরিবারের রোজগারের চিন্তা, বোবা কান্না ছাড়া কোন উপায় নাই মধ্যবিত্তদের। এমতাবস্থায় কোনমতে চালাতে হচ্ছে তাদের সংসার। এসব কারণে এখানকার মানুষ কর্মহীন হয়ে ঘর বন্দি থেকে চরম খাদ্য সংকটে ভুগছে। আর মধ্যবিত্তদের মাঝে চলছে নিরব হাহাকার। চহিদা অনুযায়ী সরকারী বা অন্য কোন ব্যাক্তি বা সংস্থা থেকেও তেমন কোন সহায়তা পাচ্ছে না অসহায় এ মানুষ গুলো। যে পরিমান সাহায্য দেয়া হচ্ছে তা চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য বলে জানিয়েছেন একাধিক স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। উপজেলা শেখমাটিয়া ইউনিয়নের বুইচাকাঠ গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের এক যুবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকুরী করে তার লেখাপড়ার খরচ চলতো। অফিস বন্ধ হওয়ায় প্রায় এক মাস বাড়ী এসে ঘর বন্দি রয়েছে। যে টাকা পয়সা ছিলো তাও প্রায় শেষ। আগামী দিন গুলো কিভাবে তার লেখাপড়া চলবে জানি না। কথা হয় উপজেলার শেখমাটিয়া ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের বাসিন্ধা ভ্যান চালক আলি নামের এক যুবকের সাথে অনেকটা কাঁদো কাঁেদা কণ্ঠে তিনি বলে, বাবার কোন জায়গা জমি নেই। নিজেদের থাকার ১ শতক জায়গার উপর একটি বসত ঘর জেটা নেই বলেই চলে। বাবা বোবা আর মা অসুস্থ। ভ্যান চালিয়ে সংসার চলত এখন তাও বন্ধ। ঘর থেকে বের হতে পারছি না। কি খেয়ে বাঁচবো আল্লাহই ভালো জানেন। এখন পর্যন্ত কোন সাহায্য সহায়তাও পাইনি। এদিকে মানবাধিকার কমিশনের উপজেলা সভাপতি আতিয়ার রহমান চৌধুরী (নান্নু) জানান, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সারাদেশে সবকিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই মুহূর্তে গৃহবন্দি সাধারণ মানুষ। নিম্ন আয়ের মানুষের হাতে ত্রান-খাদ্যসামগ্রী এবং প্রয়াজনীয় দ্রব্য তুলে দিচ্ছেন অনেকেই। বড়লোকদের ব্যাংকে জমানো টাকা দিয়ে ভালো ভাবেই পরিবার নিয়ে সংসার চলছে তাদের। তবে মধ্যবিত্তের পাশে নেই কেউ। ঘরে খাবার না থাকলেও মধ্যবিত্তরা লজ্জায় কিছু বলতে পারছে না। মধ্যবিত্তরা পারছেনা মাঠে শ্রমিকের কাজ করতে, রিক্সা চালাতে, না পাচ্ছে সরকারি-বেসরকারি ও কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ত্রাণ ও খাদ্যসামগ্রী সহায়তা। একমাত্র মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজনেরাই শুধুমাত্র বর্তমান সময়ে অতি কষ্টে মানবেতর দিনযাপন করে চলছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ ওবায়দুর রহমান বলেন, এ পর্যন্ত ৬৮ মেট্রিকটন চাল ও নগদ ২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। যা উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে বন্টন করা হয়েছে। পাশাপাশি আমি নিজেও অনেক কর্মহীন অসহায় মানুষের বাড়ী বাড়ী গিয়ে খাদ্যসামগ্রী পৌছে দিচ্ছি। তবে চলমান অবস্থা বিবেচনায় সহায়তার পরিমান আরো বাড়ানো উচিত। অনেক মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে। অনেকেই আমাকে ফোন করছে। আমি সাধ্যমত তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছি। তবে এই মুর্হুতে সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহবান করছি।