সারা বিশে^ যখন করোনার মহামারী চলছে, অনেক সামর্থ্যবান মানুষ যখন ঘরের দুয়ার বন্ধ করে আমার সমস্যা নেই এই ভেবে নিশ্চিন্তে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে তখন ৮০ বছর বয়সী নাজিম উদ্দীন যে পেশায় একজন ভিক্ষুক সে তার সবটুকু সঞ্চয় করোনায় মানুষের সাহায্যে তুলে দিয়ে অনেককে সভ্য উচু তলার মানুষকে লজ্জায় ফেলে দিল। সবটুকু দিয়ে মানুষের উপকারে এসে নাজিম উদ্দীনের মুখে তৃপ্তির হাসি দেখেছি সেই হাসি আজকাল কারো মুখে খুব একটা দেখা যায় না। কারণ অনেকদিন আগেই সমাজ তার মানবতার অনেকখানিই হারিয়েছে। যেটুকু বাকি আছে তা এরকম দু’একজন মানুষের মাঝেই আছে। যার যত আছে সে তত চায়। বাংলায় এই প্রবাদটি এতটাই বেশি সত্যি যে করোনার মতো দুঃসময়েও নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত কেউ কেউ। লজ্জা,ঘৃণা,সঙ্কোচের কোনো বালাই নেই। দেশের মানুষের প্রতিক্রিয়ায় এদের কিছু হয় না। তাদের সম্মানের চামড়া এতই মোটা যে তাদের কোনোভাবেই লজ্জা দেওয়া যায় না। অন্তত সেই সব দুর্নীতিবাজদের একটু হলেও লজ্জা পাওয়া উচিত যারা পকেট থেকে কিছু না দিয়ে উল্টো গরীবের চাল ঘরের মেঝেতে লুকিয়ে রাখছে। অবশ্য এদের লজ্জা আছে বলেও আমার জানা নেই। দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে মানুষকে করোনার প্রকোপ থেকে বাঁচাতে ঘরে থাকার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। চলছে ছুটি। বন্ধ রয়েছে মার্কেট,গণপরিবহন। এমতাবস্থায় সবচেয়ে দুর্দশায় রয়েছে যারা দিন আনে দিন খায় এমন মানুষগুলো। তাদের মুখে খাবার তুলে দিতে দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বহু সংস্থা,সংগঠন,ব্যক্তি কাজ করে যাচ্ছে। সবার প্রচেষ্টা একটাই। কেউ যেন না খেয়ে থাকে। ফোন দিলেই খাবার সরকারি কর্মকর্তা নিজে খাবার পৌছে দেয়ার খবরও আমরা পড়েছি। এটাই মানবতা। সারাদেশে অসহায় নিরন্ন মানুষের সাহায্যের জন্য ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। অথচ তা অনেকের পেট মোটা করার কাজে লাগছে। সেইসব লোভী মানুষগুলোর জন্য ঘৃণা করে যথেষ্ট হবে না। দশ টাকা মূল্যের চাল যখন নিজের পকেট ভারী করতে অন্যত্র সরিয়ে দেয় এবং মিডিয়ার কল্যাণে যখন এসব চাল চোরের খবর আমরা দেখতে পাই তখন সত্যি ভারী অবাক হতে হয়। অবাক হই এটা দেখে যে এরা মনুষ্যত্বের পুরোটাই খেয়ে বসে আছে।
মানুষ হতে হলে বিবেক,মানবতা ও মনুষ্যত্বের প্রয়োজন হয়। বড়লোক হওয়ার প্রয়োজন হয় না। কোট প্যান্ট বা টাই পরে ঘুরে বেড়ানোর দরকার হয় না। সুস্থ মনের প্রয়োজন হয়। করোনার কারণে খেটে খাওয়া মানুষগুলো রয়েছে সবচেয়ে বিপাকে। এসব অসহায় মানুষগুলোর জন্যই এসব ত্রাণ দেয়া হচ্ছে বা দশ টাকা কেজি দরে চাল বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। যাতে তারা দুমুঠো খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে। বেঁচে থাকাই বা করোনামুক্ত থাকাই এখন চ্যালেঞ্জ। যেখানে আমাদের দেশেও প্রতিদিন করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এই দুঃসময়ে এসব আয়রোজগারহীন অসহায় মানুষ ও তার পরিবারকে সাহায্য করে বাঁচিয়ে রাখার বিকল্প নেই। অথচ এখান থেকেও যারা চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন করে নিজের ফায়দা লুটতে ব্যস্ত তাদের দেখতে মানুষ মনে হলেও আদতে তারা মানুষ নয়। তাদের থেকে বড় বেঈমান আর কেউ হয় না। মানুষ মানুষের জন্য। এই কথাটি প্রমাণ করার সময় এসেছে। আমাদের দেশের মানুষ তা প্রমাণ করছে।
এখন পর্যন্ত এটা স্পষ্ট নয় করোনা ভাইরাসের তান্ডব পৃথিবীতে আর কতদিন চলবে। আর কত প্রাণ যাবে এই ভাইরাসে। তবে এই করোনা ভাইরাসের প্রকোপও একসময় কমে যাবে। এর ভ্যাকসিন আবিষ্কার হবে। মানুষ আর করোনা ভাইরাসকে ভয় পাবে না। তবে করোনা ভাইরাস যতদিনে দুর্বল হবে ততদিনে মানুষের আর্থিক সমস্যা প্রকট হবে। সেই সমস্যাকে দূর করতেও প্রয়োজন একতা। এজন্য প্রয়োজন তাদের খাদ্যে নিশ্চিত করা যারা একদিন বাইরে না বের হলে সেই পরিবার অভুক্ত থাকবে। এই কাজটি সহজ নয়। এক্ষেত্রে প্রত্যেকের সহায়তা প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে রাজনীতিবিদরা। জনগণের কাছে থাকে তারাই। জনগণ যাদের আশায় দিন কাটায় তারা রাজনীতিবিদ। একেবারে মফস্বল পর্যায় পর্যন্ত জনগণ তাদেরই ভরসা করে। এই ভরসার স্থান থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। এছাড়া সামর্থ্যবান প্রতিটি ব্যক্তি,প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। চাল চুরি করে নয় বরং তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে বিশ^স্ততার প্রমাণ দিতে হবে। এই দুঃসময়ে নিজের মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তুলতে হবে। যেখানে সরকার প্রাণপন চেষ্টা করছে করোনাকালীন সময় মানুষের ঘরে থাকা নিশ্চিত করতে এবং তাদের খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করতে সেখানে কোনো দুর্নীতি চলবে না। এখন দরকার মানবতার। চুরি নয় দরকার বরাদ্দের বাইরে নিজের থেকে আর একটু বাড়িয়ে দেয়ার। দরকার ভালোবাসার। নাজিম উদ্দীনের মতো সব হারা মানুষ সব দিয়ে প্রমাণ করে পৃথিবীতে মানবতা আছে। আমাদের শিক্ষিত, সাহেব আর নামী দামি সমাজকে অনেক কিছু শেখায়। তা থেকে যদি আমাদের একটু শিক্ষা হয়!
অলোক আচার্য
শিক্ষক ও কলাম লেখক