সিয়াম সাধনা, আত্মশুদ্ধির পয়গাম, রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের বার্তা নিয়ে রমযান আমাদের মাঝে উপস্থিত। পবিত্র সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আল্ল¬াহর নৈকট্যলাভে ব্যাকুল বিশ্বের সকল মুসলমান। ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কাছে এ মাসটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পার্থিব লোভ-লালসামুক্ত থাকা, ত্যাগ-সহিষ্ণুতার সাধনা করা এবং মানবিক মূল্যবোধে তৈরি হওয়ার প্রশিক্ষণে এ মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। রমযান আল্লাহর অফুরন্ত রহমত নিয়ে শ্রাবণের বৃষ্টিধারার মতো বর্ষিত হতে থাকে রহমত। ঈমানদারদের হৃদয়জুড়ে গভীর প্রত্যাশা ও বাসনা থাকে, ইবাদতের এ ভরা বসন্তে, ক্ষুৎপিপাসা এবং সাধনার আগুনে জ্বলে-পুড়ে খাঁটি হওয়ার।
‘রমযান’ শব্দটির অর্থ হচ্ছেÑ দহন, প্রজ্বলন, জ্বালানো বা পুড়িয়ে ভস্ম করে ফেলা। রমযান মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ নিজের সমুদয় জাগতিক কামনা-বাসনা পরিহার করে আত্মসংযম ও কৃচ্ছপূর্ণ জীবন যাপন করে এবং রিপুকে দমন করে আল্লাহর একনিষ্ঠ অনুগত বান্দা হওয়ার সামর্থ অর্জন করে। রোযা মানুষের অভ্যন্তরীণ যাবতীয় অহংকার, কুপ্রবৃত্তি, নফসের দাসত্ব জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় বলে এ মহিমান্বিত মাসের নাম ‘রমযান’।
এ মাসে বিশেষ দুটি আমল সিয়ামুন নাহার, কিয়ামুল লাইল তথা দিনে রোযা রাখা এবং রাতে তারাবিহ পড়া ছাড়াও আরো দুটি করণীয় হলো, সাহরি ও ইফতার।
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেনÑ ‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোযা ফরজ করা হলো, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিলো, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ মহানবী (সা) রমযান মাসের জন্য পূর্ব থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতেন এবং রজব মাসের চাঁদ দেখে মাহে রমযান প্রাপ্তির আশায় বিভোর থাকতেন। শাবান মাসকে রমযান মাসের প্রস্তুতি ও সোপান মনে করে তিনি বিশেষ দোয়াও করতেন এবং অন্যদের তা শিক্ষা দিতেন। রাসূল (সা) যখন শাবান মাসে উপনীত হতেন, তখন মাহে রমযানকে স্বাগত জানানোর উদ্দেশে আবেগভরে আল্ল¬াহর দরবারে এ প্রার্থনা করতেনÑ ‘হে আল্ল¬াহ! আপনি আমাদের রজব ও শাবান মাসের বিশেষ বরকত দান করুন এবং আমাদের রমযান পর্যন্ত পৌঁছে দিন।’ নবী করিম (সা) রমযান মাস পর্যন্ত হায়াত প্রলম্বিত করার জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা করতেন। যেন রমযানের রহমত, বরকত ও মাগফিরাত অর্জন করা সম্ভব হয়।
সাহরি খাওয়ায় বরকত
রোযা বা সিয়াম পালন করার উদ্দেশ্যে শেষ রাতে পানাহার করাকে সাহরি বলা হয়। সাহরি খাওয়া সুন্নত। বিলম্বে সাহরি খাওয়া উত্তম। পেটে ক্ষুধা না থাকলেও দু-একটি খেজুর, চা, পানি অথবা অন্য কোনো জিনিস খেলেও সাহরির ফজিলত অর্জিত হবে (হেদায়া: ১/১৮৬)। ইসলামি বিধানমতে এটি সুন্নত হলেও প্রকৃতপক্ষে তাকওয়া অর্জন এবং আধ্যাত্মিক উন্নয়নের জন্য এর গুরুত্ব ও ফজিলত অপরিসীম। আনাস ইবনে মালিক (রা) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা) বলেন, তোমরা সাহরি খাও, কেননা সাহরিতে বরকত রয়েছে (বুখারি: ১৮০১)। আমর ইবনুল আস (রা) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা) বলেন, ‘আমাদের রোযা আর আহলে কিতাবদের রোযার মধ্যে পার্থক্য হলো সাহরি খাওয়া আর না খাওয়া (মুসলিম শরিফ: ১৩১)।
হাদিসে এসেছে, সাহরি হলো বরকতময় খাবার। তাই কখনো সাহরি খাওয়া বাদ দিয়ো না। এক ঢোক পানি পান করে হলেও সাহরি খেয়ে নাও। কেননা সাহরির খাবার গ্রহণকারীকে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর ফেরেশতারা স্মরণ করে থাকেন (মুসনাদ আহমাদ)।
সাহরি খাওয়া বিলম্বিত করার জন্য রাসূল (সা) তাকিদ করেছেন। তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি রোযা রাখতে সংকল্প করে, তার জন্য শেষ রাত্রে কিছু পানাহার করে সাহরি পালন করা কর্তব্য। অপর এক হাদিসে রাসূল (সা) ইরশাদ করেছেন, মুসলমানদের ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের রোযা পালন করার মধ্যে পার্থক্য হলো সাহরি খাওয়া। অর্থাৎ মুসলমানগণ সাহরি গ্রহণ করে রোযা রাখে। আর অমুসলিমরা সাহরি না খেয়ে রোযা পালন করে। সাহরি গ্রহণ করার শেষ সময় হলো সুবহে সাদিক উদয় হওয়া। অর্থাৎ, রাতের শেষাংশে সুবহে সাদিক উদয় হওয়ার আগ পর্যন্ত সাহরি গ্রহণ করা যায়। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সা) সাহরি খাওয়া বিলম্বিত করতে উৎসাহ প্রদান করেছেন। বস্তুত : সাহরি বিলম্বে গ্রহণ করলে আল্লাহ পাকের সন্তোষ লাভ ও রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অনরুসৃত নীতির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন সাধিত হয়। তিনি সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করেছেন যে, তোমরা রাত্রির শেষাংশে সাহরি গ্রহণ কর (তাবরানি)। এই হাদিসে রাতের শেষাংশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং এর ব্যতিক্রম না করাই বিধেয়।
অনেক রোযাদার এমনও আছে যারা মধ্য রাতেই সাহরি গ্রহণ করে থাকে। আবার এমন লোকও আছে যারা রাতের প্রথমাংশেই সাহরি গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা পূর্ণ করে নেয়। এ ধরনের সাহরি খাওয়া ইসলামে পছন্দনীয় কাজ নয়। বরং যেভাবে কর্ম সম্পাদন করলে আল্লাহ পাক খুশী হন, সে পন্থা অবলম্বন করাই শ্রেয়।
কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ সাহরি খাওয়ার শেষ সময় ও রোযা শুরু করার প্রথম সময় বুঝাবার জন্য ইরশাদ করেছেন, ‘আর তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ রাত্রির কৃষ্ণ রেখা হতে ঊষার শুভ্র রেখা স্পষ্ট রূপে তোমাদের নিকট প্রতিভাত না হয়’ (বাকারাহ: ১৮৭)। এই আয়াতে কৃষ্ণরেখা বলতে সুবহে কাজেবকে বুঝানো হয়েছে এবং শুভ্র রেখা বলতে সুবহে সাদেককে নির্দেশ করা হয়েছে। সুতরাং সুবহে কাজেব অর্থাৎ রাত্রের কালো অন্ধকার অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত সাহরি গ্রহণ করা যাবে এবং সুবহে সাদেক অর্থাৎ দিনের শ্বেত শুভ্র আলো স্পষ্ট হয়ে উঠলেই রোযা শুরু হয়ে যাবে।
ইফতারের ক্ষণটি দোয়া কবুলের
যে ইবাদতের মধ্যে আনন্দ পাওয়া যায়, সে ইবাদত করতেও ভালো লাগে। আর প্রকৃত মুমিনগণ ইবাদতে আনন্দ লাভ করেন। মহানবী (সা) বলেছেন, রোযাদারের জন্য দুটি খুশি। একটি ইফতারের সময়, অপরটি আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়। সূর্যাস্তের পর রোযাদার প্রথম যে পানাহারের মাধ্যমে রোযা ছাড়ে, তাকে ইফতার বলে। ইফতার অর্থ ভাঙা বা উপবাস ভঙ্গন করা। ইফতারের সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা উত্তম। কোন বিলম্ব না করা। ইফতারের আগেই ইফতার সামনে নিয়ে অপেক্ষা করা এবং যথাসময়ে ইফতার করা সুন্নত। ইফতার সামনে নিয়ে যে দোয়া করা হয়, সেই দোয়া আল্লাহ কবুল করেন।
ইফতারের জন্য খেজুর ও পানির কথা হাদিস দ্বারা সমর্থিত। ইফতার নিজে করা এবং অন্যকে করানো সওয়াবের কাজ। যে ব্যক্তি অন্যকে ইফতার করাবে, তার সওয়াবের কোনো কমতি হবে না। হাদিসে এসেছে, ‘যদি কেউ রমযান মাসে তার সার্মথ্য অনুযায়ী একটি খেজুর বা এক গ্লাস পানি দ্বারা হলেও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অপর ভাইকে ইফতার করায় তাহলে আল্লাহ তাকে মাফ করে দিবেন। একই সাথে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবেন ও উক্ত রোযাদারের সমপরিমাণ সওয়াব দিবেন আর এ কারণে ঐ রোযাদারের সওয়াব একটুও কমানো হবে না।’
ইফতারের সময় এ দোয়াটি পড়া উত্তম, ‘আল্লাহুম্মা লাকা ছুমতু, ওয়াআলা রিজকিকা আফতারতু।’ অর্থ- ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার সন্তুষ্টির জন্য রোযা রেখেছি এবং আপনার রিযিক দ্বারাই ইফতার করছি।’ হাদিস শরিফে এসেছে, রোযাদার যখন ইফতার করে, তার দোয়া প্রত্যাখ্যান করা হয় না।’
রোযাদারের দোয়া আল্লাহর নিকট এতই আকর্ষণীয় যে দয়াময় আল্লাহ রমযানের সময় ফেরেশতাদের উদ্দেশে ঘোষণা করেন, ‘রমযানে তোমাদের পূর্বের দায়িত্ব মওকুফ করা হলো এবং নতুন দায়িত্বের আদেশ করা হলো, তা হলো আমার রোযাদার বান্দাগণ যখন কোনো দোয়া মোনাজাত করবে, তখন তোমরা আমিন! আমিন! বলতে থাকবে।’
ইফতার সওয়াবের উদ্দেশ্য ভিন্ন হওয়া অনুচিত
ইফতার মাহফিল ও ইফতার পার্টি সওয়াবের উদ্দেশ্য ভিন্ন হওয়া অনুচিত। ইফতার অনুষ্ঠানের লক্ষ্য হওয়া উচিতÑ ইফতার করা ও করানোর মাধ্যমে সওয়াব লাভ করা। দ্বীনি তালিম; ইসলামি তাহজিব তমুদ্দুন ও সংস্কৃতির বিকাশ; গরিবদের আর্থিক ও সামাজিক সহযোগিতা করা, ইত্যাদি। বিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া কোনো ইবাদতই কবুল হয় না। হালাল খাদ্য ও হালাল উপার্জন রোযা, নামাজ ও যাবতীয় ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত। তাই ইফতার ও সাহরিতে বৈধ উপার্জনের হালাল খাবার অবশ্যই হওয়া চাই।
রমজান ধৈর্যের মাস। আর ধৈর্যের প্রতিদান জান্নাত। এ মাস সহানুভূতি প্রদর্শনের মাস। এটা সে মাস যাতে মুমিনের রিযিক বৃদ্ধি করা হয়। যে এ মাসে কোনো রোযাদারকে ইফতার করাবে, সেটা তার জন্য তার পাপরাশি ক্ষমার নিমিত্ত এবং দোযখের আগুন থেকে মুক্তির কারণ হবে। এছাড়া তার সাওয়াব হবে সে রোযাদার ব্যক্তির সমান, অথচ রোযাদারের সাওয়াবও কম হবে না। সাহাবিগণ বললেনÑ হে আল্লাহর রাসূল (সা)! আমাদের প্রত্যেক ব্যক্তি তো এমন সামর্থ রাখে না, যা দ্বারা রোযাদারকে ইফতার করাতে পারে? রাসূল (সা) বললেন, আল্লাহ তাআলা এ সাওয়াব দান করবেন ওই ব্যক্তিকে, যে রোযাদারকে ইফতার করায় এক চুমুক দুধ দ্বারা, অথবা একটি খেজুর দ্বারা, অথবা পানি দ্বারা। আর যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে তৃপ্তিসহ খাওয়ায়, আল্লাহ তাআলা তাকে আমার হাউজ (কাউসার) থেকে পান করাবেন। যার ফলে জান্নাতে প্রবেশ পর্যন্ত পুনরায় সে তৃষ্ণার্ত হবে না।
রোযাদারের দোয়া ফিরিয়ে দেয়া হয় না
আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) ইরশাদ করেনÑ তিন ব্যক্তির দোয়া ফিরিয়ে দেয়া হয় না। ১. রোযাদারের দোয়া ইফতার করা পর্যন্ত। ২. ন্যায়পরায়ণ বাদশাহের দোয়া। ৩. মাজলুমের দোয়া (তিরমিজি: ২৫২৫)। আল্লাহ তাআলা রোযাদারের দোয়া মেঘমালার উপরে উঠিয়ে নেন এবং এর জন্য আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। আর আল্ল¬াহ বলেন, ‘আমার ইজ্জতের কসম, বিলম্বে হলেও আমি অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করব’। দোয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এজন্য এ মাসে বেশি বেশি দোয়া করা ও আল্লাহর নিকট বেশি বেশি কান্নাকাটি করা। হাদিসে এসেছেÑ ইফতারের মূহূর্তে দয়াময় আল্ল¬াহ বহু লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। মুক্তির এ প্রক্রিয়াটি রমযানের প্রতি রাতেই চলতে থাকে (জামিউস সাগির: ৩৯৩৩)। নবী করিম (সা) যখন ইফতার করতেন তখন বলতেনÑ পিপাসা নিবারিত হলো, শিরা উপশিরা সিক্ত হলো এবং আল্ল¬াহর ইচ্ছায় পুরস্কারও নির্ধারিত হলো (আবু দাউদ: ২৩৫৯)।
সব কাজে সব সময় সর্বাবস্থায় নেক আমলের জন্য কষ্টসহিষ্ণুতা ও পাপ বর্জনের জন্য মানসিক দৃঢ় মনোবল অর্জনই রোজার মূল শিক্ষা বা লক্ষ্য। যদি কেউ রোজা পালন করেন, কিন্তু গুনাহ ছাড়তে না পারেন, তবে রোজার প্রকৃত সুফল তিনি পাবেন না।