গত কয়েক বছরে বরিশাল জেলাজুড়ে পোল্ট্রি খাতের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। ফলে জেলার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বেশ ভূমিকা রাখতে শুরু করেছিল পোল্ট্রি শিল্প। এরইমধ্যে বৈশ্বিক মহামারি প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের কারণে পোল্ট্রি শিল্পে ধ্বস নামতে শুরু করেছে।
দেশব্যাপী লকডাউনের কারণে গত এক মাস ধরে খামারীদের পোল্ট্রি ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে। বিক্রি হচ্ছে না মুরগী বা তা থেকে উৎপাদিত ডিম। কিন্তু শিল্প টিকিয়ে রাখতে প্রতিদিনই অতিরিক্ত টাকা গুনতে হচ্ছে খামারিদের। যা মাস শেষে লোকসানের খাতায় জমা হচ্ছে মোটা অংকের টাকা। এমন পরিস্থিতিতে আরও কিছুদিন চলতে থাকলে পোল্টি শিল্পে বড় ধরণের ধ্বস নামবে বলে দাবি করেছেন খামারিরা। ইতোমধ্যে অসংখ্য খামার বন্ধও হয়ে গেছে। ফলে চোখে মুখে অজানা আতঙ্ক ভর করেছে খামারিদের। দেশের চলমান পরিস্থিতিতে পোল্টি শিল্প এবং এ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট খামারিদের টিকিয়ে রাখতে সরকারি প্রনোদনার দাবি করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার মধ্যে অন্যতম পোল্টি শিল্প গড়ে উঠেছে উজিরপুর উপজেলায়। জেলায় কয়েক হাজার ছোট-বড় পোল্ট্রি মুরগীর ফার্ম রয়েছে। এদের চোখে মুখে এখন অজানা আতংক। বিশেষ করে উজিরপুর উপজেলার সাতলা ইউনিয়নজুড়ে পোল্ট্রি ফার্মের ব্যাবসা করে সাবলম্বী হওয়া মানুষগুলো এখন করোনার প্রভাবে পথে বসতে শুরু করেছেন। বন্ধ হয়ে পথে বসেছেন গৌরনদী উপজেলার একাধিক পোল্ট্রি খামারীরা।
সূত্রমতে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে গত এক মাস ধরে পোল্ট্রি খামারীদের ব্যাবসা প্রায় অচল হয়ে পরেছে। এ কারণে চরম বিপাকে পরেছেন পোল্ট্রি ব্যবসা নির্ভর পরিবারগুলো। এমন অবস্থায় আরও একমাস কাটলে হাজারো পোল্ট্রি খামারী পুঁজি হারিয়ে পথে বসবে বলে জানিয়েছেন পোল্ট্রি খামারীরা।
সূত্রে আরও জানা গেছে, উজিরপুর উপজেলার সাতলার গ্রামজুড়ে প্রায় এক হাজার পোল্ট্রি ফার্ম রয়েছে। ওইসব ফার্মের অধিকাংশ খামারীদের আয়ের প্রধান উৎস পোল্ট্রি ব্যাবসা। করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে তাদের খামারের উৎপাদিত ডিম ও মুরগীর বেচা-বিক্রি না থাকায় চরম হতাশার মধ্যে রয়েছে এ ব্যাবসায় জড়িত পরিবারগুলো। তাই এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারিভাবে খামারিদের সহয়াতা দেয়ার দাবি জানিয়েছেন ব্যাবসায়ীরা।
সরেজমিনে সাতলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, করোনা দুর্যোগে পোল্ট্র খামারীদের চরম দুর্ভোগের নানা চিত্র। লকডাউনের কারণে যানবাহন চলাচল না করায় মুরগীর খাদ্য সামগ্রীর সংকট ও মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। তারমধ্যে খামারে উৎপাদিত মুরগী ও ডিম বিক্রি না থাকায় খামারীরা পরেছেন মহাসংকটে।
সাতলার রাজাপুর গ্রামের বাসিন্দা ও ইউপি সদস্য জোহান বাড়ৈ জানান, কারোনার কারণে তার দুইটি ফার্মে প্রায় ২০ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। ফার্মে একটি মুরগীর জন্য প্রতিদিন খরচ হচ্ছে পাঁচ টাকা করে। মুরগীর উৎপাদিত ডিম প্রতিপিস বিক্রি করতে হচ্ছে সাড়ে তিন টাকা থেকে চার টাকা দামে। দুইটি ফার্মে প্রতিদিন তার ১০ হাজার টাকা করে লোকসান গুনতে হচ্ছে। একই এলাকার খামারী সাইমুন বাড়ৈ জানান, মুরগীর ফার্ম এখন তার গলার ফাঁসে পরিনত হয়েছে। পটিবাড়ি এলাকার শাহজালাল বলেন, করোনার কারণে ব্যাবসায় ধ্বস নেমেছে কিন্তু কেউ তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন না।
উত্তর সাতলা গ্রামের কামাল মিয়া বলেন, তারা এখন চরম দুঃসময় পার করছেন। ফার্মে প্রতি কেজি মুরগী উৎপাদনে তাদের খরচ হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকা। বর্তমানে তা বিক্রি করতে হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা দামে। করোনার কারণে ব্যাবসার এ অবস্থা হলেও কেউ তাদের দিকে নজর রাখছেন না। উপজেলার বিভিন্ন এলাকাগুলোর ছোট ছোট মুরগীর খামারীদের মাঝেও একই অবস্থা বিরাজ করছে।
গৌরনদী উপজেলার গেরাকুল গ্রামের খামারী জলিল সরদার বলেন, করোনার প্রভাবে তার ফার্মের প্রায় ১৮শ’ মুরগীতে ভাইরাস দেখা দেয়। এরমধ্যে মাত্র দুইদিনে প্রায় চারশ’ মুরগী মারা যায়। বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করেও কোন সুফল না পাওয়ায় পরবর্তীতে দিশেহারা হয়ে নামমাত্র মূল্যে সব মুরগী বিক্রি করে দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে তার ফার্মটি শুন্য অবস্থায় পরে রয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে তিনি মুরগীর ফার্ম শুরু করেছিলেন কিন্তু মহামারির কারণে তার প্রায় দশ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। বর্তমানে ঋণ পরিশোধ নিয়ে তিনি এখন মহাদুশ্চিন্তায় রয়েছেন। একইভাবে জানিয়েছেন ওই গ্রামের অপর খামারী শাহিন সরদার। তিনি বলেন, তার ফার্মে একই ভাইরাস দেখা দেয়ার পর প্রায় তিনশ’ মুরগী মরে গেছে। পরবর্তীতে প্রায় অর্ধলাখ টাকা ব্যয় করে বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগের পর বর্তমানে মুরগীগুলো সুস্থ্য হলেও ডিম উৎপাদন কমে গেছে। তাই ফার্মের খামারীরা বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাদের লোকসান পুষিয়ে ব্যাবসা টিকিয়ে রাখতে সরকারিভাবে সহয়াতার দাবি করেছেন।