শেবাচিম হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডাঃ এমএ আজাদ সজলের হত্যার ক্লু উদ্ঘাটনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার জোর তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু ঘাতক কে এবং কিভাবে তাকে হত্যা করে লিফটের নিচে ফেলে রাখা হলো তা এক অবিশ্বাস্য কাহিনি বলে মনে করছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। প্রাথমিকভাবে তারা নিশ্চিত হয়েছেন এ চিকিৎসকের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়, পরিকল্পিত হত্যাকান্ড।
এ ঘটনায় মঙ্গলবার রাতে কোতোয়ালি মডেল থানার নিহতের ভাই ডাঃ শাহরিয়ার উচ্ছ্বাস বাদি হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা একাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। অপরদিকে বুধবার সকাল সাড়ে ১০টায় দ্বিতীয় জানাযা শেষে ডা. এমএ আজাদ সজলের লাশ ঢাকার কেরানীগঞ্জের ইমামবাড়ি কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
কোতয়ালী থানার ওসি (তদন্ত) আবদুর রহমান মুকুল মামলা দায়েরের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, পুরো বিষয়টি তদন্ত চলছে। পাশাপাশি ঘটনাস্থল নগরীর কালীবাড়ি সড়কের মমতা স্পেশালাইজড হাসপাতালের আটক নয়জন কর্মচারীদের সন্দেহের চোঁখে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে।
অপরদিকে মঙ্গলবার বিকেলে নিহত চিকিৎসক সজলের লাশের ময়নাতদন্ত শেষে শেবাচিম হাসপাতালের মর্গের অদুরে মসজিদের সামনে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যার পরে লাশ এ্যাম্বুলেন্সযোগে নিহত চিকিৎসকের আবাসস্থল ঢাকার কেরানীগঞ্জের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে দাফন করা হবে। নিহত চিকিৎসক সজলের স্বজনদের দাবি, নগদ অর্থের লোভে ওই ক্লিনিকের কর্মচারীদের মধ্যে কেউ এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত রয়েছে।
সূত্রমতে, পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ উপজেলার পূর্ব সোহাগদল গ্রামের বাসিন্দা হলেও স্বাধীনতা উত্তর ডাঃ এমএ আজাদ সজলের পিতা প্রায়ত আবদুল হালিম শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় কর্মরত থাকা অবস্থায় কেরানীগঞ্জে স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তোলেন। সেখানেই রয়েছেন নিহতের স্ত্রী কহিনুর বেগম ও বড় কন্যা নবম শ্রেণির ছাত্রী তাসলিম এবং চর্তুথ শ্রেণিতে অধ্যায়নরত পুত্র তাবিব।
বরিশালের স্বাস্থ্যখাতে এবং সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে এ ধরণের বিয়োগান্তের ব্যাতিক্রমী ঘটনায় বিষয়টি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে সর্বমহলে। একজন চিকিৎসকের মৃতদেহ লিফটের নিচে উদ্ধারের খবর মুহুর্তে গোটা নগরীতে ছড়িয়ে পরলে এ ঘটনার নেপথ্যের রহস্য নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
নিহত চিকিৎসকের চাচা আবদুল করিম দাবি করে বলেন, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, এটা একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) মোকতার হোসেন সাংবাদিকদের জানান, তারাও সন্দেহ করছেন ঘটনার পিছনে ভিন্ন কিছু রয়েছে এবং প্রাথমিকভাবে হত্যার আলামত হিসেবেই দেখছে। নিহত চিকিৎসকের দুই পায়ের বিভিন্নস্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তার পরিধেয় পোশাক ছিল ছিন্ন বিছিন্ন। তিনি আরও জানান, লিফটের নিচে ডাঃ সজলের যাওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। সার্বিক আলমত বলছে, তাকে ক্লিনিকের ভিতরেই হত্যার পর লাশ লুকিয়ে রেখে ঘটনা ভিন্নখাতে প্রভাবিত করতে ওইস্থানে রাখা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার এক্সপার্ট টিম ঘটনাস্থলে সার্বিক আলমত দেখে একইমত পোষণ করেছেন। সবার ধারণা কারো একার পক্ষে হত্যা করে লিফটের নিজে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সাথে আরো দুই একজন থাকতে পারে। তবে নিশ্চিত যে, ক্লিনিকের বাহিরে থেকে এসে কারো পক্ষে এ ঘটনা সংঘটিত করা সম্ভাব নয়। তবে পুরো বিষয়টি এখনই নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
নিহতের ছোট ভাই ডাঃ শাহরিয়ার উচ্ছ্বাস জানান, গত দুইমাস যাবত করোনা দূর্যোগে ঢাকার পরিবারের সাথে মিলিত হতে না পারায় এবং প্রতিদিন বিপুল নগদ উপার্জিত অর্থ নিজের কাছে রাখায় কেউ নিশ্চিত হয়েই তা লুণ্ঠনের চেষ্টায় তার ভাইকে অভ্যন্তরীণভাবে অপহরণ করে আটকে রেখে রাতে হত্যার পর লাশটি ওইস্থানে লুকিয়ে রেখেছে।
সূত্রমতে, ঘটনাস্থল নগরীর মমতা স্পেশালাইজড হাসপাতালটি আধুনিক করন করা হলেও কোন সিসি ক্যামেরা না থাকার বিষয়টি রহস্যজনক। তাছাড়া রোগী ও কর্মচারীদের আসা যাওয়ার মাঝে একজন ব্যক্তি তাও সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের চিকিৎসককে হত্যা করে তাকে লুকিয়ে রাখার সময়কালে কারো চোঁখ ফাঁকি দেওয়ার বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ।
ঘটনার পর থেকে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘটনার মূল রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছে। কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি (তদন্ত) এআর মুকুল জানান, ঘটনারদিন রাতে ডিউটিরত হাসপাতালের বিভিন্ন কর্মচারীকে পর্যায়ক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই ঘটনার রহস্য উম্মোচন করা সম্ভব হবে।
সরেজমিনে জানা গেছে, ডাঃ এমএ আজাদ সজল ক্লিনিকের বেশ কয়েকজন কর্মচারীর সাথে ম্যাচে রান্না করা খাবার খেতেন। ঘটনারদিন সোমবার বিকেলে তাকে স্বাভাবিক দেখা গেছে। কয়েকজন রোগী দেখার পর বিকেলে তিনি নিচে নেমে নিজেই বাজার করে ক্লিনিক সংশ্লিষ্ট ওষুধের দোকানে কর্মরত হাসান নামক যুবকে কাছে তা পৌঁছে দিয়েছেন। তার থাকার রুমে যাওয়ার কথা বলে সেখানে ইফতারি নিয়ে আসার জন্য হাসানকে নির্দেশ দিয়ে তিনি হাসপাতালে প্রবেশ করেন। ওই যুবকের ভাষ্য হচ্ছে, কিছু সময় পর ইফতার সামগ্রী নিয়ে তার আসাবন কক্ষে গিয়ে দেখা যায় তালাবদ্ধ। তার সন্ধান না পাওয়ায় ইফতার সামগ্রী সে দরজার সাথে ঝুঁলিয়ে রেখে আসে। ধারণা করা হয়েছিল, সম্ভাবত ডাঃ এমএ আজাদ সজল অপারেশন থিয়েটারে রয়েছেন।
হাসপাতালের একটি সূত্র জানায়, এ সময় একজন রোগীর অপারেশন চলছিল। কিন্তু রাতের খাবার পৌঁছে দিতে একই যুবক পুনরায় তার কক্ষে গিয়ে কক্ষ বন্ধ এবং ইফতার দরজার সাথে ঝুঁলতে দেখতে পান। রাত বাড়ার সাথে সাথে শুরু হয় ডাঃ সজলের সন্ধান। কিন্তু কোথাও তার খোঁজ মেলেনি। সকালেও তার সন্ধান না পাওয়ায় শুরু হয় জোর তল্লাশী। একপর্যায়ে লিফটের নিচে কোন এক কর্মচারী তার লাশ দেখতে পান।
উল্লেখ্য, শেবাচিম হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান ডাঃ জহিরুল হক মানিকের মালিকাধীন মমতা স্পেশালাইজড হাসপাতালের লিফটের নিচের কক্ষ থেকে ডাঃ সজলের লাশ মঙ্গলবার সকালে উদ্ধার করা হয়। তিনি (সজল) শেবাচিম হাসপাতালে বার্ন ইউনিটের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত থাকার পাশাপাশি মমতা স্পেশালাইজড হাসপাতালে বৈকালিক সময় রোগী দেখতেন। সুসজ্জিত বহুতল ভবন বিশিষ্ট ওই ক্লিনিকের দ্বিতীয় তলায় তার নিজস্ব চেম্বার রয়েছে। থাকতেন একই হাসপাতালের সপ্তম তলার ৮ নম্বর কক্ষে।