‘ভাইরে, জোহের (জোঁকের) জালায় কিচ্ছু (কিছু) করতারি না (করতে পারিনা)। মুনি (ধান কাটা শ্রমিক) ধান কাটার কথা কইলেই (বললে) জোহের ডরে (ভয়ে) কানিতে (বিঘা প্রতি) দাম বাড়াইয়া দেয়। আর এহনতো (এখন) মুনিই পায়না। সবাই জাইন্না গেচে এই বন্ধে (ফসলের মাঠে) জোক বেশি। আর শইল্লের (শরীরের) রক্ত পানি হইয়া যাইতাছেগা (যাচ্ছে), গরু বাচুর একটাও বাদ যাই না এই জোক থেইক্কা (থেকে)। ৫ বছর ধইরা কালি (শুধু) জোক বাড়তাছে আর বাড়তাছে (বৃদ্ধি পাচ্ছে)। দেহেন জোহের ডরে এই বন্ধের অনেক জমি পতিত পইরা রইছে। অনেকরে কইছি কিছু কাজ হয় না। ভাই একটা বিহিদ (ব্যবস্থা) করেন।’ এ ভাবেই প্রতি বছর ধান কাটার মৌসুমে নিচু ধানী জমিতে জোঁকের যন্ত্রণার কথাগুলো বলছিলেন কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের গোথালিয়া গ্রামের কৃষক মো. সোহাগ ভূঁইয়া (৩৫)। শুধু সোহাগ নয় বাজিতপুর-কটিয়াদী উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের প্রায় ৮ হাজার কৃষক বিশেষত ধান কাটার মৌসুমে জোঁকের উৎপাতের শিকার। বিশেষত বাজিতপুরের পিরিজপুর ইউনিয়নের গোথালিয়া, রস্তমপুর, ভাংনাদী (কটিয়াদীরের চান্দপুর ইউনিয়নভুক্ত), নবুরিয়া গ্রামের প্রায় ১ হাজার কৃষকের কাছে এই মৌসুমে ধান কাটা মানে একটি আতংকের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্থাণীয়ভাবে পরিচিত এই লাদিপুরি বিলের প্রায় ১ হাজার হেক্টর ফসলি জমিতে দিনকে দিন জোঁকের পরিমান ও উৎপাত বেড়েই চলছে। শুধু যে ধান কাটার মৌসুমে শ্রমিক সংকট, বিঘা প্রতি ধান কাটার খরচ বৃদ্ধি, জমি পতিত রাখার প্রবণতা কৃষকের কাছে বাড়ছে তা নয়, সাথে কৃষক ও কৃষি শ্রমিকের জীবনও হুমকির মুখে পড়ছে। গত ৫ বছরে এলাকার অনেক কৃষক জোঁকের কামড়ে আহত হয়েছেন। গত বছর গোথালিয়া গ্রামের কৃষক ইসমাইল হোসেনের ছেলে পারভেজ (২৩), নিলকি হাপানিয়া গ্রামের কৃষক নিদু মিয়ার ছেলে সমুন (২০) জমিতে কাজ করতে গিয়ে জোঁকে মারাত্বকভাবে আহত হন। তাদের একজনের প্র¯্রাবের রাস্তা দিয়ে জোঁক ঢুকে এবং সে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দীর্ঘ দিন চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে উঠেন। অন্য জন শরীরের উরুতে জোকের কামড়ে আহত হয়ে ভর্তি হয়ে ছিলেন জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এছাড়া একই গ্রামের কৃষক মানিক মিয়া (৩৫), শ্যামল চন্দ্র সন্ন্যাসী (৪৫), জহরলাল সন্ন্যাসী (৩২), বাবুল মিয়া (৪৬), রাখাল চন্দ্র সন্ন্যাসী (৩৩) জোকের কামড়ে অনেক দিন অসুস্থতায় ভোগছিলেন। চলতি বুরো ধান কাটার মৌসুমে কৃষকরা এ থেকে পরিত্রাণে স্থাণীয় কৌশল বের করেছেন। এ মৌসুমে কৃষকরা ধান কাটার সময় দু’পায়ে লম্বা ধরণের মৌজা পড়ে ধান কাটছেন। তাতে কিছুটা হলেও তারা নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পারছেন বলে এ প্রতিবেদককে অবহিত করেন কৃষি শ্রমিক আবু বক্কর বল্টু। গোথালিয়া গ্রামের মোজাম্মেল হক ভূঁইয়া বলেন, আমি গত প্রায় ৭ একর জমিতে ধান করেছিলাম। বিঘা (স্থাণীয়ভাবে ৩৫ শতাংশে ১ বিঘা ধরে) প্রতি যেখানে উচু জমিতে ধান কাটাতে শ্রমিকের মজুরি আসে ২ হাজার টাকা আর এই বিলে জোঁকের কারণে বিঘা প্রতি আমাকে ৫ হাজার টাকা শ্রমিককে দিতে হয়েছে। টাকা দিয়েও এই বিলের জমিতে ধান কাটার কথা শুনলে ভিন্ন এলাকার কৃষি শ্রমিকরা এখানে আসতে চায় না। এ বছর জোঁকের কারণে নিজে ধান করেছি মাত্র ৩ একর জমিতে।’
এ বিষয়ে বাজিতপুর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মো. রকিবুল হাসান বলেন, এ বিষয়ে আমরা অবগতি আছি। এই সমস্যা দুইভাবে সমাধান করা যায়। প্রথমত. কম্ভাইন্ড হারভেস্টার মেশিনে ধান কাটা। এতে করে ধান কাটায় জোঁকের কোন ভয় ছিল না এবং বিঘা প্রতি খরচও কৃষকের কম হতো । আমরা এই এলাকার কৃষকদের মেশিন ক্রয়ে উদ্বুদ্ধ করেছিলাম হয়তো বেশি টাকার কারণে ক্রয় করেনি তারা। দ্বিতীয়ত. রাসায়নিকভাবে দমনের জন্য এ্যামুলিয়াম সালফেট অথবা সিরিয়াল নামক এক প্রকার কিটনাশক জোঁকের সংক্রমণ ধান ক্ষেত্রে দেখা দেয়ার সাথে সাথে অনুমোদিত মাত্রায় ব্যবহার করা। তারপরও আমি উপ-কৃষি কর্মকর্তাকে পুনরায় এলাকায় পাঠাব এবং উচ্চতর সমাধানে আমাদের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে এ বিষয়ে কথা বলবো।