শেরপুরের সরকারি শিশু পরিবার (বালিকা) নিরাপদ আশ্রয় এতিম রোকসানার। খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসা, পড়াশেনার সব কিছুই চলছিলো ঠিকঠাক। নিয়মের গ্যারাকলে পড়ে সেই নিরাপদ আশ্রয় হারিয়ে এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে এতিম রোকসানা।
রোকসানার গ্রামের বাড়ি জামালপুর সদর উপজেলার শরিফপুর ইউনিয়নের জয়রামপুর গ্রামে। রোকসানার বাবা উজ্জ্বল মিয়া স্থানীয় বাজারে ছোটখাটো ব্যবসা করে স্ত্রী নাসিমা বেগমকে নিয়ে কোন রকমে দিন চালাচ্ছিলো। হঠাৎ এক ঝড়ো হাওয়ায় রোকসানাদের সে সংসার তছনছ হয়ে যায়।
রোকসানা যখন কেবল মার গর্ভে তখন তার বাবা উজ্জ্বল স্ট্রোক করে মারা গেলে মা নাসিমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। নাসিমা বেগম রোকসানাকে পেটে নিয়েই ধান কাঁটার কাজসহ দিন মজুরের নানা কাজ করে এক বেলা দুই বেলা খেয়ে না খেয়ে সংসার চালিয়ে যান কিছু দিন। কিন্তু রোকসানা পৃথিবীর আলো দেখার পর নাসিমার কষ্টের সীমা বাড়তে থাকে। তাই এক পর্যায় সংসারের ভার কুলাতে না পেরে রোকসানাকে মাত্র ৬ বছর বয়সেই জামালপুর শহরস্থ বজ্রাপুর সরকারি এতিম খানায় ভর্তি করে দেন মা নাসিমা।
এক পর্যায়ে সরকারি সিদ্ধান্তে জামালপুর ও শেরপুর এই দুই জেলার এতিম কন্যা শিশুদেরকে ২০০৬ সালে শেরপুর জেলার চাপাতলীতে স্থাপিত সরকারি শিশু পরিবার (বালিকা) শেরপুরে স্থানান্তর করা হয়। ফলে রোকসানাও চলে আসে শেরপুর সরকারী শিশু পরিবারে (বালিকা)। এখানে সে বেড়ে উঠে ও স্কুলে ভর্তি হয়। স্কুল থেকে কলেজে উঠে দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছরে রোকসানা এখানে থেকে গত বছর এইচএসসি পাশ করে। শিশু পরিবারের সরকারী নীতিমালা অনুযায়ী একজন শিশু এইচএসসি পাশ করা বা ১৮ বছরের পর তাকে আর শিশু পরিবারে রাখার সুযোগ নেই। এখানে অন্যান্য মেয়েরা এসএসসি পাশ করে তাদের নানা আত্মীয় স্বজনের কাছে চলে যায়। কেউবা আবার কোন কর্মসংস্থানে। আবার কারও কারও বিয়ে হয়ে যাওয়ায় ফিরে পায় নতুন জীবন। কিন্তু রোকসানার সে ভাগ্য নেই। কারণ তার একমাত্র মা ছাড়া পৃথিবীতে কেউ নেই যে তাকে একটু আশ্রয় দিবে। বর্তমানে সে মাও আজ প্রায় শয্যাশায়ী।
রোকসাদের বাড়িটি ভেঙ্গে পড়ার মতো কোন রকমে কাথ হয়ে টিকে থাকলেও ঘরের নেই কোন দরজা-জালানা, নেই কোন শোবার জন্য চৌকি। তারপরও এখানেই দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ মা নসিমা বেগম পড়ে থাকলেও ২০ বছর বয়সের রোকসানার এখানে থাকার কোন পরিবেশ নেই। এ ছাড়া তার নিজের কোন কর্মসংস্থানও হয়নি এখনও। সরকারী নিয়মানুযায়ী শিশু পরিবারে লেখা পড়ার পাশাপাশি ভবিষ্যত সাবলম্বি করতে মেয়েদেরকে হাতের নানা কাজের পারদর্শি করে তোলা হয়। রোকসানারার সেলাইয়ের কাজ জানা থাকলেও কোথাও কোন কাজ না পেয়ে অশিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে সে। সব সময় দুর্ভাবনা তাড়া করে তার।
কিন্তু কোথায় যাবে! মায়ের সাথে সেই ভাঙ্গা ঘরে তার নিরাপত্তাই বা কতটুকু পাবে। তার উপর আয়ের কোন পথও আপাতত খোলা না থাকায় অনেকটা বিমর্ষ হয়ে দু’চোখে দুঃস্বপ্নই দোলা দিচ্ছে রোকসানার। শিশু পরিবার থেকে বেড়ে ওঠা রোকসানাকে একজন সুপাত্রের হাতে তুলে দেওয়ারও চিন্তা করা হচ্ছে। কিন্তু সহায় সম্বলহীন এতিম রোকসানাকে কে বিয়ে করবে ? রোকসানার সম্বলমাত্র তাদের জামালপুরে মায়ের নামে তিন শতক জমির উপর ভাঙ্গা ঘরটি। তাই সমাজের বিত্তবান ও হৃদয়বানদের সহযোগিতার হাতের আশায় আছেন রোকসানা। রোকসানার চাওয়া মা-বেটির দুই পেট চলার মতো ছোটখাটো যেকোন একটি চাকুরি।
এ বিষয়ে শিশু পরিবারের উপ- তত্বাবধায়ক মো. বেলাল হোসেন বলেন, সমাজের বিত্তবান লোকেরা বা শিল্প উদ্যোক্তারা যদি তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে দায়িত্ব পালন করত তবে এই গৃহহীন এতিম অসহায় মেয়েটিকে সমাজে পূনর্বাসন করা সম্ভব হতো। সরকার মুজিব বর্ষ উপলক্ষে গৃহহীনদের পূনর্বাসনে (জমি আছে ঘর নাই) অনেক কর্মসূচি নিয়েছে। মেয়েটির মায়ের বসত ভিটায় একটি ঘর করা সম্ভব হলে অথবা মেয়েটার (এইচএসসি পাস) কোন চাকুরি পেলে সে অসহায়ত্ব পরাভূত করে নতুন জীবনের সন্ধান পেত, তার দুঃখ ঘুচত এবং সে একটি ঠাঁই পেত।