করোনা ভাইরাসজনিত পরিস্থিতিতে সরকার ও বিচার বিভাগের যুগান্তকারী পদক্ষেপ ভার্চুয়াল আদালতে শেরপুরে ব্যাপক সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে। ভার্চুয়াল কোর্টের বদৌলতে বিচারকদের পাশাপাশি আইনজীবীরাও নিজ নিজ চেম্বার বা বাসায় বসেই ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অংশ নিচ্ছেন হাজতী আসামিদের জামিন শুনানীতে। কেবল কম্পিউটার বা ল্যাপটপ নয়, স্মার্টফোনের মাধ্যমেও যুক্ত হওয়া যাচ্ছে আদালতের সাথে। ইতোমধ্যে রবিবার (১৭ মে) পর্যন্ত ৪ কর্মদিবসে জেলা ও দায়রা জজ, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালসহ শিশু আদালত এবং চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতসহ আমলী আদালতগুলোতে জামিন শুনানী নিস্পত্তি হয়েছে ১৭৩টি মামলায়। আর ওইসব মামলায় জামিন পেয়েছেন ১২২ আসামি। এর মধ্যে কেবল চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনেই নিস্পত্তি হয়েছে ১৪৩ মামলার শুনানী এবং জামিন পেয়েছেন ১১১ জন আসামি। অন্যদিকে চলমান কঠিন পরিস্থিতিতে ভার্চুয়াল আদালতে লঘু অপরাধের অভিযোগে কারাগারে আটক আসামিদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন আসামিদের পরিবার ও আইনজীবীসহ অনেকেই।
জানা যায়, রবিবার শেরপুরের চতুর্থ শুনানীর দিনে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ১৫টি আবেদন শুনানী শেষে ৫টি আবেদন মঞ্জুর করেন জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ আল মামুন। এদিন ছুটিতে থাকায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে কোন শুনানী হয়নি। আর চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে করা ১টি আবেদনের মধ্যে ১টিই মঞ্জুর করেন চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এসএম হুমায়ুন কবীর। এছাড়া জেলার ৫টি জিআর আমলী আদালতের মধ্যে নালিতাবাড়ী আমলী আদালতের ৭টি আবেদনের মধ্যে ৫টি মঞ্জুর করেন অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ সুলতান মাহমুদ। আর শেরপুর সদরে রেকর্ডসংখ্যক ১৯টি আবেদনের মধ্যে ১১টি আবেদন মঞ্জুর করেন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফারিন ফারজানা। শ্রীবরদী আমলী আদালতে করা ৩টি আবেদনের মধ্যে ২টি আবেদন মঞ্জুর করেন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আল মামুন। ঝিনাইগাতীর ৫টি আবেদনের মধ্যে ৪টি মঞ্জুর করেন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শরিফুল ইসলাম খান। নকলার ৫টি আবেদনের মধ্যে ৩টি মঞ্জুর করেন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মুহসিনা হোসেন তুষি। এর আগে ১২ মে প্রথম দিনে চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ২ জন, দ্বিতীয় দিনে ৩৪ জন এবং তৃতীয় দিনে জেলা ও দায়রা জজ, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালসহ শিশু আদালত এবং চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতসহ আমলী আদালতগুলোতে আরও ৫৩ আসামি জামিন পায়। এর মধ্যে কেবল চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও আমলী আদালতগুলো থেকেই জামিন পায় ৪৫ আসামি।
আদালতের সাথে সংশ্লিষ্ট ও আইনজীবীসহ নানা সূত্র জানায়, শেরপুর একটি সীমান্তবর্তী ছোট্ট জেলা হলেও এখানকার মানুষ খুবই শান্তিপ্রিয়। এখানে অপরাধের পরিমাণও কম। তাই শেরপুরে কোর্ট-কাচারীতে মামলার সংখ্যা অন্যান্য জেলার তুলনায় খুবই কম। যেমন শেরপুরের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মামলার সংখ্যা প্রায় ৪ হাজারের কিছু বেশি, যেখানে পাশ্ববর্তী ময়মনসিংহ চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মামলার সংখ্যা প্রায় ২২ হাজারেরও বেশি। তাই মামলা সংখ্যাধিক্য ও মামলাজটের কারণে অনেক জেলার নাম নানাসময় শোনা গেলেও শেরপুরের নাম কখনও সেভাবে শোনা যায়নি। তবে সম্প্রতি শেরপুর চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে ভার্চুয়াল শুনানীতে ব্যাপক সাড়া পড়ায় শেরপুর জেলা সমগ্র বাংলাদেশের মধ্যে ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছে। সমগ্র দেশের বিচারক, আইনজীবী ও মানুষের মুখে মুখে শেরপুরের নাম। এমনকি যেসব জেলায় কোর্ট-কাচারীতে ভার্চুয়াল শুনানী হচ্ছে না, সেসব জেলার বিচারক, আইনজীবী, সাধারণ মানুষও এ জেলার সাফল্য জানতে ফোন করছেন পরিচিতজনদের কাছে। এতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি একেএম মোছাদ্দেক ফেরদৌসী ও সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট এমকে মুরাদুজ্জামানসহ অনেকেই।
এ ব্যাপারে জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট রফিকুল ইসলাম আধার বলেন, তুলনামূলকভাবে অনেক অল্প মামলা, অল্প বিচারক ও অল্প আইনজীবী থাকা সত্তে¦ও শেরপুরের নবাগত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এসএম হুমায়ুন কবীরের নেতৃত্বে এখানকার ম্যাজিস্ট্রেসীতে বিচার বিভাগের যুগান্তকারী পদক্ষেপ ভার্চুয়াল শুনানীর মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক মামলা নিষ্পত্তির জন্যই বিচার অঙ্গনে শেরপুর একটি মডেল হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। তিনি যেভাবে কোর্ট কাচারীতে ভার্চুয়াল পদ্ধতি শুরুর পূর্বাহ্নেই জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটগণ, আইনজীবী, কোর্টের স্টাফসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, অন্যান্য জেলাও সেভাবে কাজ করলে শেরপুরের মত সফল হতে পারত। অবশ্য এজন্য এখনও সময় রয়েছে। শেরপুরবাসী আশা করে, শেরপুরের ন্যায় দেশের অন্যান্য জেলাও কোর্ট-কাচারীতে সাফল্যের সাথে ভার্চুয়াল পদ্ধতি প্রয়োগ করে সহজে ও নিরাপদে জনগণকে বিচারিক সেবা প্রদানে সচেষ্ট হবে।
উল্লেখ্য, গত ১০ মে নিম্ন আদালতের ভার্চুয়াল কোর্টে শুধু জামিন শুনানি করতে নির্দেশ দেন সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। এরপর ১১ মে থেকে সারাদেশে ওই শুনানীর সুযোগ নিশ্চিত হলেও শেরপুরে তা শুরু হয় ১২ মে থেকে। ওইদিন নবাগত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এসএম হুমায়ুন কবীর ২টি আবেদন গ্রহণ করে ২টিই নিস্পত্তি করায় জেলায় ভার্চুয়াল আদালতে প্রথম জামিন মেলে ২ আসামির।