ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে বরগুনায় ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে। বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় ১০ হাজার বাড়ি-ঘর। বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে অর্ধশত গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। উপড়ে গেছে অসংখ্য গাছপালা। এছাড়াও প্রাবিত হয়েছে শতাধিক মাছের ঘের এবং ৩০০ হেক্টর সবজি ও ফসলের ক্ষেত। দুপুড়ে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ঘূর্ণিঝড় আম্পান বুধবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বরগুনায় আঘাত হানে। রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত একটানা ছয় ঘন্টা এর তান্ডব চলে। তাছাড়া প্রায় সারা রাতই এর প্রভাব চলতে থাকে। এ সময়ে বরগুনাসহ বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় ১০ হাজার বাড়ি-ঘর আংশিত বিধ্বস্ত হয়েছে। জেলার বিভিন্ন পয়েন্টে ১৩.৫৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষাতগ্রস্ত হয়ে অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ১০টি চিংড়ির ঘের ছাড়াও ১২১টি মাছের ঘের প্লাবিত হয়েছে। ১৫টি মুরগীর খামার ও ১৯টি গরুর খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাতটি আম বাগান ও প্রায় ৫০ হেক্টর সবজি ক্ষেত ছাড়াও ২৫০ হেক্টর ফসলের ক্ষতি হয়েছে। প্রায় ৪০ হাজার একর বনভূমি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়াও ৫০টি নলকূপ, ১০০টি টয়লেট, ১০টি খাবার পানির পুকুর ও পাঁচটি রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং ট্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ফলে বরগুনায় কোন মানুষ মারা যায়নি।
বরগুনা জেলা পানি উন্নয়র বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ কায়সার আলম জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে বরগুনায় বুধবার রাতে বরগুনায় সাত থেকে ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে জেলার বিভিন্ন স্থানের ১৫টি পয়েন্টে ১৩.৫৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষাতগ্রস্ত হয়েছে। এতে আয়লা পাতাকাটা, জাঙ্গালিয়া, বুড়িরচর, লবনগোলা, মাইঠা, নলটোনা, পাথরঘাটার জিনতলাসহ অর্ধশত গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তবে প্লাবিত এলাকা থেকে ইতোমধ্যেই পানি নেমে গেছে।
বরগুনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এসএম বদরুল আলম জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে জেলার সাতটি আম বাগান, ৫০ হেক্টর সবজি ক্ষেতসহ ৩০০ হেক্টর ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে, আম, চিনাবাদাম, ভুট্টা, মুগডাল, সূর্যমূখীসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি। এছাড়াও পানের বরজ ও মরিচের বীজতলার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
বরগুনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ মনিরুল ইসলাম জানান, ঘূর্ণিঝড়ে জেলায় মোট ১৫টি মুরগি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়াও তালতলী উপজেলার ১৯টি গরুর খামারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে দুই লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আবুল কালাম আজাদ জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে বরগুনায় ১০টি চিংড়ির ঘের যার আয়তন ৪.০৫ হেক্টর এবং ১২১টি মাছের ঘের যার আয়তন ৪,৪৮ হেক্টর প্লাবিত হয়ে প্রায় ২০ মোট্রক টন মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার ক্ষতির পরিমান প্রায় ২০ লাখ টাকা।
বন বিভাগেন তথ্যমতে, জেলার প্রায় ৪০ হাজার একর বনভূমি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার ক্ষতির পরিমান প্রায় ৫০ লাখ টাকা।
এছাড়া, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ঘূর্ণিঝড় আম্পানে বরগুনায় ৫০টি নলকূপ, ১০০টি টয়লেট, ১০টি খাবার পানির পুকুর ও পাঁচটি রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং ট্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার ক্ষতির পরিমান প্রায় ৫০ লাখ টাকা।
এদিকে, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে সোমকার থেকেই বরগুনায় কিছুটা প্রভাব পরতে থাকে। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকেই বরগুনার আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে যেতে শুরু করেছে লোকজন। বিশেষকরে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের আশ্রয়কেন্দ্রে বেশি আসতে দেখা গেছে। রাতে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলার প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে ইফতারী ও সাহরীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া, শিশু ও যারা রোজা রাখতে অক্ষম তাদের জন্যও খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা গভীর রাত পর্যন্ত বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র ঘুড়ে ঘুড়ে এসব কার্যক্রম তদারকি করেছেন এবং আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থানকারীদের খোঁজখবর নিয়েছেন। উপজেলাগুলোতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও জেলা প্রশাসনের একজরন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সমন্বয়ে টীম গঠন করে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
অপরদিকে, বরগুনায় আশ্রয়কেন্দ্রে আশার সময়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মোঃ শহীদুল ইসলাম (৬৪) নামের একজন হোটেল ব্যাবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে সদর উপজেলার এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের পরীরখাল মাধ্যমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে আসার পথে তার মৃত্যু হয়। এম বালিয়াতলী ইউনিয়ন পারষদের চেয়ারম্যান মোঃ সেলিম শাহনেওয়াজ মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, শহীদুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত ছিলেন।
জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে বরগুনার ছয়টি উপজেলার ৪২টি ইউনিয়র ও চারটি পৌরসভায় কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঝড়ের পর থেকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিভেন্সের সদস্যদের মাধ্যমে রাস্তার উপর পড়ে থাকা গাছ অপসারণের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগের লাইন মেরামতে তিনটি কুইক রেসপন্স টিম কাজ করছে। তিনি বলেন, জরুরী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ৪২টি মেডিকেল টিম জেলা জুড়ে কাজ করছে। এছাড়া, পুনর্বাসন কার্যক্রমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মৎস্য দপ্তর, প্রাণিসম্পদ দপ্তরসহ অন্যান্য দপ্তর কাজ করছে। তিনি আরও বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পান মোকারেলায় বরগুনা জেলায় এ পর্যন্ত ২০০ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য এবং দুই হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার, শিশু খাদ্য ক্রয়ের জন্য দুই লাখ টাকা এবং ২৮ লাখ নগদ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক বলেন, শুক্রবার থেকে বরগুনায় পুনর্বাসনের কাজ শুরু করা হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে ১০০ পরিবারকে দুই বান্ডিল করে ঢেউটিন, নগদ টাকা ও খাদ্য সহায়তা দেওয়া হবে।