ইউএনও’র কাছে বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষার আবেদনের একদিন পরই শিশু সামিয়া (১৩) অপহরণ মামলার ভিকটিম হয়ে চলে যায় পুলিশ হেফাজতে। ইয়াছিন মিয়া (২২) ও ফয়েজ মিয়া (৩৫) নামের দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের পরের দিনই নথিভূক্ত হয়েছে অপহরণ মামলাটি। মামলার বাদী সামিয়ার মা শাহানা বেগম। সামিয়ার আপন দুই চাচাসহ মোট ৭জন এখন ‘সামিয়া’ অপহরণ মামলারই আসামী। আর গত শুক্রবার বিকেল ২টার দিকে ১৮ ঘন্টা পুলিশ হেফাজতে থাকা শিশু সামিয়াকে বিপর্যস্ত দেখায়। জীবনে প্রথম পুলিশ হেফাজতে এসে হতবিহবল হয়ে পড়েছে শিশুটি। চোখে মুখে তার বিষাদের চাপ। আগের দিনের মত সামিয়ার কথায় গতি নেই। অজানা ভয় ও আতঙ্ক কুঁড়ে খাচ্ছে শিশুটিকে। পুলিশের উপস্থিতিতে মিডিয়া কর্মীদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে চোখ গুলো বড় করে চারিদিকে দ্রƒত দেখে নিচ্ছে। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দিচ্ছে শিশু সামিয়া। তারপরও ছোট স্বরে শিশু সামিয়া পুলিশ হেফাজতে থেকেই বলে ‘আমি অপহরণ হয়নি। আমাকে কেউ অপহরণ করেনি। আমি বাল্যবিয়ে থেকে বাঁচতে চাই। আমি পড়তে চাই। আমি পরিবারের সকলের সাথে থাকতে চাই। ’ মামলার এজহারের কপি সাংবাদিকদের দেখাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা এস আই মো. খালিলুর রহমান।
পুলিশ, সামিয়ার বাবা ও স্থানীয়রা জানায়, শিশু সামিয়া বলছে টিঘর গ্রামের আরশ আলীর ছেলে রূবিন মিয়ার সাথে মা শাহানা বেগম বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। সে বাল্যবিয়েতে সম্মত হচ্ছে না। এজন্য সামিয়ার মা বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করছেন। এমনকি নির্যাতনও করছেন। বাল্য বিয়ে থেকে বাঁচতে সামিয়ার প্রবাসী পিতার কথায় চাচাদের আশ্রয়ে চলে যায়। পরে তাকে ও তার চাচাদের পুলিশ দিয়ে হয়রানি করতে থাকে শাহানা। বাধ্য হয়ে গত ২৭ মে সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষার জন্য আবেদন করেন সামিয়া। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার অনলাইনে ‘ বাল্যবিয়ে থেকে বাঁচতে শিশু সামিয়ার আবেদন’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। একটু নড়েচড়ে ওঠেন প্রশাসন। বিষয়টি নিস্পত্তির কথা বলে স্বজনদের মাধ্যমে বৃহস্পতিবার রাত ৮টার পর সামিয়াকে থানায় নিয়ে আসেন পুলিশ। পুলিশের কাছে সামিয়া বাল্যবিয়ে থেকে বাঁচতে চাচাদের হেফাজতে চলে যাওয়ার কথা জানায়। রাতে দীর্ঘ সময় চলে জিজ্ঞাসাবাদ। আদালতের মাধ্যমেই চুড়ান্ত ফায়সালার সিদ্ধান্ত নেয় পুলিশ। গত শুক্রবার ভোরে শাহানার দায়ের করা অপহরণের অভিযোগপত্রটি নথিভূক্ত করেন থানা কর্তৃপক্ষ। মামলায় আগের দিন সকালে গ্রেপ্তার হওয়া ২ জনের মধ্যে ইয়াছিনকে প্রধান আসামি করে মোট ৭ জনের বিরূদ্ধে করা হয় অপহরণের অভিযোগ। এরমধ্যে রয়েছে সামিয়ার আপন দুই চাচা কাশেম মিয়া (৪০) ও সাত্তার মিয়া (৪২)। বেশ কয়েক মাস আগে এই সাত্তার মিয়াকে জেলহাজতে রেখে একটি ঘটনায় জড়িত দেখিয়ে সরাইল থানায় একটি মামলায় আসামি করেছিল শাহানা। সাথে আসামি ছিল ১০ বছর বয়সের শিশু ইব্রাহিমও। অপহরণ মামলার অন্য আসামিরা সামিয়ার বাবার স্বজন মনু মিয়া (৫০), হেদায়ত মিয়া (৩৫), ফয়েজ মিয়া (৩৫) ও দুলাল মিয়া (৫০)। সামিয়ার সৌদী প্রবাসী বাবা আবু ছায়েদ প্রকাশ সহিদ মিয়া মুঠোফোনে বলেন, আমার স্ত্রী শাহানা অন্যলোকের প্ররোচণায় আমার আপন ভাইসহ গোত্রের লোকজনের বিরূদ্ধে মিথ্যা অপহরণ মামলা করেছে। আমার মেয়ে অপহরণ হয়নি। বাল্যবিয়ে থেকে বাঁচতে আমার নির্দেশে আমার বাড়িতে বসবাস করছিল। এটা শাহানা মেনে নিতে পারেনি। ৫০ বছর বয়সের আমার স্বজনরা সামিয়াকে অপহরণ করবে কেন? সামিয়ার নামে ৮ লাখ টাকার ডিপোজিট করা আছে। এই টাকাটার প্রতি অনেকের লোভ হয়েছে। এ জন্যই আমার স্ত্রী শাহানা ও কিছু লোক সামিয়ার পেছনে ওঠেপড়ে লেগেছে। আদালতে বাজে কিছু কথা বলার জন্য আমার শিশু কন্যাকে চাপ দিচ্ছে পুলিশ। আমাকে ও আমার মেয়েকে বাঁচানোর জন্য আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই। সামিয়ার মা শাহানা বেগম বলেন, আমি কারো সাথে এখন কথা বলতে চাই না। আমার মেয়ে যা বলার আদালতেই বলবে।ু পুলিশ বলছেন, সামিয়ার লিগ্যাল গার্ডিয়ান এখন মা ছাড়া কেউ নেই। অন্য কেউ নিয়ে সামিয়াকে রাখতে পারেন না। আইন এটাকে সমর্থন করে না। শনিবার (গতকাল) সকাল ১১টার পর সামিয়াকে মেডিকেল টেষ্টের জন্য প্রথম হাসপাতালে নেয়া হবে। পরে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী রেকর্ডের জন্য আদালতে পাঠানো হবে। আদালতই ফায়সালা দিবেন সামিয়া এখন কার হেফাজতে থাকবে। সামিয়ার বক্তব্যের উপরই নির্ভর করবে মামলার ভবিষ্যৎ। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ এস এম মোসা বলেন, যেহেতু মামলা হয়েছে। এখন আদালতই দিবেন চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত।