ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে শুরু হওয়া বৃষ্টিপাত আর নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় চাটমোহরের বিভিন্ন বিলের শত শত হেক্টর জমির উঠতি ইরি-বোরো ধান ডুবে গেছে। তলিয়ে গেছে কৃষকের সোনালী স্বপ্ন। জলাবদ্ধতায় ধান তাটতে গিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন কৃষক। সবচেয়ে বেশী দূর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে বিলে যাওয়া-আসার কোনো সংযোগ সড়ক না থাকায়। অনেক কষ্টে পানিতে তলিয়ে যাওয়া ধান কেটে ঘরে তোলার চেষ্টা করছেন এ অঞ্চলের চাষীরা।
শস্য ভান্ডার খ্যাত চলনবিল অধ্যুষিত পাবনার চাটমোহরে এবার ইরি-বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। দিগন্ত জোড়া বিলে পাকা ধানের সোনালী শীষে দোল খাচ্ছে কৃষকের সোনালী স্বপ্ন। কিন্তু উঠতি বোরো ধান নিয়ে চরম দুশ্চিন্তা ও শঙ্কায় পড়েছেন কৃষক। তাদের সেই স্বপ্ন তলিয়ে গেছে গুমানী নদীর জোয়ারের ও বৃষ্টির পানিতে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে কয়েক দিনের বৃষ্টির পর জোয়ারের পানি নদী দিয়ে ঢুকে পড়েছে বিলে। এতে উপজেলার খলিশাগাড়ী বিল,আফরার বিল,ডিকশী বিল,পাকার বিল,জিদ্দারী বিলসহ বেজপাটিয়াতা,ডেফলচড়া,নলডাঙ্গা,ছাইকোলা,হান্ডিয়াল,বোঁথরসহ বিভিন্ন এলাকার বিলের ধান তলিয়ে গেছে। ধানের সাথে তলিয়ে গেছে কৃষকের সারা বছরের স্বপ্ন। তলিয়ে যাওয়া ধান নিয়ে কৃষক পড়েছেন বিপাকে। অনেকেই আধাপাকা ধান কেটে ঘরে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু করোনার প্রভাবে কৃষি শ্রমিকের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে চাটমোহরসহ চলনবিল অঞ্চলে ৩০ ভাগ জমির বোরো ধান কেটে ঘরে তুলেছেন কৃষক। বাকি ৭০ ভাগ ধান নিয়ে চরম শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন তারা। আকাশে মেঘ আর বৃষ্টিপাত থেমে থেমে হচ্ছে। এরইমধ্যে জোয়ারের পানি গুমানী নদী ভরে বিলে ঢুকে পাকা বোরো ধানের জমি তলিয়ে দিয়েছে। এরআগে ঘূর্ণিঝড় আম্ফালের কারণে একদফা বোরো ধানের ক্ষতি হয়েছে। এবার পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে ধানের জমি। করোনার প্রভাবে কৃষি শ্রমিক মিলছে না। যাও পাওয়া যাচ্ছে,তাদের দিতে হচ্ছে চড়া মজুরী। ১ হাজর টাকা মজুরী দিয়েও কামলা পাওয়া যাচ্ছে না। কৃষি শ্রমিক সংকটে ভোগান্তিতে পড়েছেন কৃষক। এমতাবস্থায় ঝড়,শিলাবৃষ্টি আর পানি বাড়ার আশঙ্কা নিয়ে চরম দৃশ্চিন্তায় পড়েছেন এ অঞ্চলের কৃষক।
উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে,এবার চাটমোহরে ৯ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে। ধানের বাম্পার ফলনে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু হঠাৎ নদীর পানি বৃদ্ধিকে বিলের ধান তলিয়ে যাওয়ায় কৃষক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়াল ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামের কৃষক ছোরমান হোসেন বললেন,‘পানিতে আমার ৭ বিঘা জমির সমস্ত ধান তলিয়ে গেছে। আমি এখন কী করবো,কোথায় যাব। ধান কাঁটার কামলা নেই।’
হান্ডিয়াল ইউপি চেয়ারম্য্যান কে এম জাকির হোসেন জানালের,এখনো পুরোপুরি ধান পাকেনি। তবে ধান কাটা শুরু হয়েছে। ধানের ফলনও ভালো। কিন্তু ঝড়-বৃষ্টি ধানের ক্ষতি করেছে। আকাশে মেঘ,রোদ মিলছে না। কামলা (কৃষি শ্রমিক) না পেয়ে চরম দুশ্চিন্তায় আছি। হান্ডিয়াল ইউনিয়নের প্রধান ফসল ইরি-বোরো। কিন্তু এবার কৃষক চরম ক্ষতির শিকার।’
বোয়ালমারী গ্রামের কৃষক আঃ মতিন কললেন,হঠাৎ করেই গুমানী নদীতে জোয়ারের পানি বেড়ে গেছে। নদীর পানি এখন বিলে ঢুকছে। উপজেলার খলিসা গাড়ী বিলের অনেক ধানের জমিই এখন পানির নিচে। খবি কষ্ট করে কিছু ধান তাটা সম্ভব হচ্ছে।
আরেক কৃষক আঃ মমিন বললেন,তাড়াহুড়া করে ধান কাটতে হচ্ছে। কিন্তু কামলা মিলছে না। করোনাভাইরাসের কাণে অনেকেই আর ধান কাটতে আসছে না। নিজেরাই যতদুর সম্ভব ধান কাটছি। কিন্তু বিল থেকে ধান তোলার জন্য রাস্তা না থাকায় কঠিন সমস্যার মুখে পড়েছি আমরা। ঝড়,বৃষ্টি আর পানি বাড়ার কারণে ধানের বেশ ক্ষতি হবে।’
ছাইকোলা গ্রামের কৃষক সিদ্দিক আলী জানান,আবাদকৃত ধান নিয়ে তারা বিপদে আছেন। কীভাবে ধান ঘরে তোলা হবে সেই চিন্তা সবার মধ্যে।
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা রবিউল করিম জানান,চাটমোহরে এবার হাইব্রিড,উফশী ও স্থানীয় জাতের বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এবার ধানের ফলনও বাম্পার। ইতোমধ্যে ৫০ ভাগ জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। বর্ষন ও পানিতে ৩শ’ হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছ্।ে কৃষকরা জানান,খলিশাগাড়ী বিল,হান্ডিয়াল,নলডাঙ্গা,ছাইকোলাসহ বিভিন্ন বিলের অন্ততঃ ২ হাজার হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে।
চাটমোহর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ এ এ মাসুম বিল্লাহ জানান,হঠাৎ জোয়ারের পানি বেড়ে গিয়ে বিলে পানি ঢুকেছে। জোয়ারের পানি আর বৃষ্টির কারণে ৩শ’ হেক্টর জমির বোরো ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। তিনি জানান,সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের কারণে চাটমোহর উপজেলায় ১৪৬ হেক্টর জমির ফসল ও আম-লিচুর ক্ষতি হয়েছে। তিনি বললেন,উপজেলার কিনু সরকারের জোলা দিয়ে নদী থেকে বিলে পানি ঢুকছে। এখানকার স্লুই গেট বন্ধ করার জন্য আমরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বলেছি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরকার মোহাম্মদ রায়হান জানান,ফসলের ক্ষতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিনু সরকারের জোলার স্লুইস গেটটি বন্ধ করার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলা হয়েছে। এতে বিলের ধান রক্ষা পাবে।
চাটমোহর উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আঃ হামিদ মাস্টার বললেন,আমি হান্ডিয়াল,ছাইকোলা ও হরিপুর ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকা পরদর্শন করেছি। তলিয়ে যাওয়া ধান নিয়ে কৃষক অনেকটা অসহায়। উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে জরুরী ভিত্তিতে হরিপুর ইউনিয়নের বিলের মধ্যে রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে। কৃষকের জন্য আমরা যা যা করণীয়,তা করবো। অন্য সমস্যাগুলোও সমাধানের চেষ্টা করা হবে।