মোবাইলে কথা বলার উপর ট্যাক্স বেড়ে গেলো। শুধু কথা বলাই নয়Ñ শ্বাস, নিশ্বাস কী দীর্ঘশ্বাস সবটার ওপরই চলতি বাজেটে বাড়তি ট্যাক্স বসলো। বাংলাদেশে এক ধরনের গাছ আছে যার নাম হল ‘কলাগাছ’। ওটাকে যেমনে খুশি, যেভাবে খুশি, তেমনে করেই কাটা যায়! এ রকমই যেনো বাঙ্গালীদের পকেট! চাল-ডাল দিয়ে, আদা-পেয়াজ দিয়ে, গ্যাস-বিদ্যুৎ দিয়ে, ওষুধ-ডাক্তার দিয়ে, মোবাইল দিয়ে, ‘যেমনে খুশি তেমনে’ জনগণকে বলির পাঠা বানানো হয়। সরকার নিয়মিতভাবে প্রতিবছর এসব খাতে করের বোঝা চাপিয়ে জনগণের ওপর বাড়তি চাপ ফেলছে। অথচ হাসপাতাল কিংবা প্রশাসনের সেবা বিভাগগুলোয় সেবার মান উন্নত হচ্ছে না, বরং অবনতির অভিযোগ পাহাড়সম। এটা যেনো জনগণকে নিয়ে মজা করা, তামাশা করা! প্রশাসন ও ক্ষমতাবানদের গাড়ি-বাড়ি, আরাম-আয়েশ, বেতন-বোনাস, পে-স্কেল, উৎসব ভাতা সবটার সাথে দুর্নীতিও চলবে ষোলো আনায়! দেশের বেকার, মধ্যবিত্ত, কী নিম্নবিত্তরা কীভাবে চলছে... চলবে, তার খবর কে রাখে?
১০০ টাকা রিচার্জে ৩৩.২৫ পয়সা নেবে সরকার
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত বৃহস্পতিবার সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন, তাতে মোবাইল সিম বা রিম কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে সেবার বিপরীতে সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণের কথা বলা হয়। নতুন করহারে মোবাইল সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ১৫ শতাংশ, সম্পূরক শুল্ক ১৫ শতাংশ ও সারচার্জ ১ শতাংশ। ফলে মোট করভার দাঁড়িয়েছে ৩৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এর ফলে গ্রাহক তার সিমে ১০০ টাকা রিচার্জ করলে ৩৩ টাকা ২৫ পয়সা নেবে সরকার। বাজেট ঘোষণার আগে প্রতি ১০০ টাকা রিচার্জে সরকার নিত ২৭ টাকা ৫০ পয়সা। একথা ঠিক যে, টেলিযোগাযোগ খাতের ওপর নগদ ও সহজে কর আরোপ এবং আদায় করা যায়। কিন্তু আনুপাতিক হারে সেবার মান বাড়ছে কী? উচ্চ হারে কর দিয়ে আমরা নিম্নমানের সেবা পাচ্ছি। এ ছাড়া এ ধরনের কর আরোপ ও টেলিকম সেবার মূল্য বেড়ে গেলে গ্রাহকরাই ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হবেন। বিশেষতঃ বেশি চাপে পরবে নিম্ন আয়ের মানুষ।
সরকারের সুবিধাভোগিদের ভাষ্য
এনবিআরসহ সরকারের সুবিধাভোগি সাবেক ও বর্তমান কতিপয় কর্মকর্তারা বলেছেন, জনগণ নাকি মোবাইলে অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলে থাকে। এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা ইদানিং অতিরিক্ত কথা বলছি। কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই কথা বলি। এতে শারীরিক ও মানষিক নানা সমস্যায় পড়ছে মানুষ। তাই মোবাইলে কথা বলায় সম্পূরক শুল্ক আরোপ অত্যন্ত ভালো একটি উদ্যোগ হবে। এতে অযথা কথাবলা কিছুটা হলেও কমবে...।’ খুব ভালো কথা। তাহলে তো আরও বেশি কাটা হলে আরও ভালো হতো! কেননা, কথা যতো কম হবে ততই ভাল। জনগণ বোবা হয়ে থাকবে! কথায় আছে, বোবার নাকী শত্রু নাই! ঝাল-তেলে পোষা সরকারি কর্মকর্তারা কী জানেন? নিম্ন, মধ্যম ও স্বল্প আয়ের নতুন উদ্যোক্তাদের আয়-ইনকামের প্রধান মাধ্যম হলো মোবাইল। কেউ কেউ হয়তো অতিরিক্ত কথা বলে, কিন্তু ঢালাওভাবে অভিযোগের বাহানা তুলে কলরেট বাড়ানো ঠিক হয়েছে কী?
বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মধ্যবিত্ত ও নতুন উদ্যোক্তা
কলরেট বারার কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে মধ্যবিত্ত, নতুন উদ্যোক্তা ও গরিব মানুষ। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে একজন উচ্চশিক্ষিত প্লাস্টিক পণ্যের উদ্যোক্তা বলেন, ‘আমার পণ্যের পরিচিতি ও বাজারজাতের জন্য আমি রাত দিন পরিশ্রম করে যাচ্ছি। মাসে ২৫/৩০ হাজার টাকা ইনকাল হলেই আমি খুশি। যোগাযোগ এবং বিল কালেকশনের জন্য দৈনিক শতাধিক লোকের সাথে কথা বলতে আমার মাসে ২ হাজার টাকার উপরে খরচ হয়। অথচ এখন আমার মোবাইলের ব্যায় আরো বেড়ে গেলো। এমনিভাবে ভার্সিটি থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে গার্মেন্টস এক্সেসরিজ, কয়েকজন পোশাকের মার্কেটিংয়ে কর্মরতরা বলেন, ‘এমনিতেই বিভিন্ন খরচে দিশেহারা, তারপর নিজের খাওয়া-পরা, বাবা-মা, ভাই-বোনদের ন্যূনতম চাহিদা মিটিয়ে এখনো বিবাহেরও চিন্তা করতে পারিনি। আমাদের এ সার্ভিসের সবচেয়ে প্রধান মাধ্যম হলো মোবাইল। ‘ওরা আমার মুখের কথা (ভাষা) কাইরা নিতে চায়। ওরা কথায় কথায় শিকল পরাই আমার হাতে পায়ে।’ কালজয়ী এ বাণীগুলো প্রতিধ্বনিই যেন উঠে এসেছে ২০২০-২১ বাজেটে। পাকিস্তানীরা যেভাবে আমাদের মুখের ভাষা কাইরা নিতে চেয়েছিলো, তেমনি আমাদের শাসক ও আরাম-আয়েশে বিভোর সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, জনগণ নাকি বেশি কথা বলে। সরকার মোবাইলে কথা বলার রেট বাড়িয়ে যেনো আমাদের মাথায় ঘা মারলো।’
কতজনের হাতে স্মার্টফোন রয়েছে
একথা ঠিক যে, বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির নানা উপায়ের কল্যাণে স্বল্প ব্যায়েও কথা ও তথ্য আদান-প্রদান করা সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে নিম্ন ও মধ্যম শ্রেণির মানুষের কতজনের হাতে স্মার্টফোন রয়েছে। এখনতো নিম্নবিত্ত খেতমজুরের লুঙ্গির খুঁট এবং গৃহকর্মীর শাড়ির আঁচলেও রয়েছে মোবাইল ফোন। সুবিধাভোগী গ্রাহকের সংখ্যা বিবেচনায় সবার ঘাড়ে মূল্যবৃদ্ধির খাঁড়ার ঘা যৌক্তিক হয়েছে কী? অনেকেই আছেন, যারা সামান্য টাকা ইনকাম করেও নিয়মিত পরিবারের খোঁজ-খবর নিয়ে থাকতেন। এখন তাদের জন্য কষ্টের কারণ হলো। দেশের কতজন মানুষই হোয়াটসঅ্যাপ, ই-মেইল, ইমু, মেসঞ্জার ব্যবহার করে কথা ও তথ্য আদান-প্রদান করে থাকে। মোবাইলের কলরেট বাড়িয়ে মূলত সরকার সাধারণ মোবাইল ফোন গ্রাহকদের পকেট থেকে টাকা লুটের একটি বিশেষ সুযোগ নিলো। সাধারণ মানুষ এখন রাষ্ট্রের কাছে ছিনতাইয়ের শিকার। ব্যাংক, শেয়ারবাজার, পণ্যের বাজারের মূল্যবৃদ্ধির সিন্ডিকেটের বড় চোর, বাটপার, লুটেরাদের টিকিও তারা স্পর্শ করতে পারছে না। কিন্তু সাধারণ মানুষকে জবাই করা খুবই সহজ।
করোনাকালে মোবাইলই যখন মূল চালিকা
বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এমনিতেই মানুষের মধ্যে যখন নাভিশ্বাস উঠেছে। দেশ-বিদেশে বর্তমানে মোবাইল হয়ে উঠেছে সব যোগাযোগের মূল চালিকা। এছাড়া দেশ যখন ডিজিটাল ইকনোমির দিকে এগিয়ে চলছে; ঠিক সে সময় এ ধরনের করের বোঝা কোনোভাবেই দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক হবে বলে আমরা মনে করি না। এ বোঝা দরিদ্র মানুষের জন্য অসহনীয় হয়ে পড়বে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পথে অন্তরায় হয়ে উঠবে। পৃথিবীর একমাত্র দেশ বাংলাদেশ, যেখানে মূল্য বৃদ্ধির জন্য কোন কারণ লাগে না। সর্বশেষ অনেক কিছুই জনগণের কাঁধে এসে পড়ে। পরর্তীতে সংশ্লিষ্টদের কোন ভ্রƒক্ষেপ থাকেনা। বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি সুবিধাভোগীরা কোটি কোটি টাকার মালিক। তাদের ফোন ফ্রি, কল ফ্রি, বাসা ফ্রি, যাতায়াত ফ্রি। আসলে জনসাধারণকে বুঝার, ভাববার মতো কেউ আছে কী? নাকি যা মন চায় তাই করে ফেললাম? গ্রামীণফোন, রবি এবং বাংলালিংক, তিনটিতে সিংহভাগ বিনিয়োগ বিদেশিদের। তাদের লাভও বিদেশে যাচ্ছে। তাদের ঊর্ধ্বতন নির্বাহীরা ভিন দেশের লোক। মোবাইল কোম্পানিগুলো কিছু অসম্ভাব্য, অসঙ্গত, আজগুবি ও কুটিল অফার দিয়ে থাকে। যেমন- ৫৯ টাকায় ৪ জিবি নেট সময় ৩ ঘণ্টা। অর্থাৎ, কাউকে ১ কেজি মুড়ি খেতে দেয়া হবে- কিন্তু সময় নিতে পারবে ২০ সেকেন্ড! জনগণকে পরোয়া না করে ইস্ট ইন্ডিয়া কেম্পানির মতো রাজত্ব করার সুযোগ নিয়েছে তারা। সাধারণ জনগণতো কলুর বদল, সব নিরবে সহ্য করে যাবে। এসব দেখার যেন কেউ নেই।
গ্রাহকের বাড়তি টাকা কাটা শুরু
বাজেটে ঘোষণা আসার পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এসআরও জারি করায় গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে এসএমএস, কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারে গ্রাহকদের বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে গ্রাহকদের। বিষয়টি নিশ্চিত করে রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম সংবাদ মাধ্যমকে জানান, বৃহস্পতিবার রাত ১২টার পর থেকেই নতুন হারে টাকা কাটা শুরু হয়েছে। মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের (অ্যামটব) মহাসচিব এস এম ফরহাদ বলেন, বাজেট প্রস্তাবের পর এনবিআর এসআরও জারি করায় বৃহস্পতিবার রাত ১২টার পর থেকেই নতুন হারে টাকা কাটা শুরু করেছে মোবাইল অপারেটরগুলো। অ্যামটব জানিয়েছে, নিয়মিতভাবে করের বোঝা চাপিয়ে সরকার মোবাইল খাতকে ক্রমেই দুর্বল করে তুলছে। ফেলছে গ্রাহকদের ওপর বাড়তি চাপ। অ্যামটব এই বাড়তি কর পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করেছে।
দেশ ডিজিটাল করার সেøাগান
কথায় কথায় এমপি, মিনিষ্টাররা দেশ ডিজিটাল করার সেøাগান দেন। অথচ দুদিন পরপর প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবহারের উপর চড়া হারে কর নির্ধারণ করেন। মানুষ যদি স্বল্প ব্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহার করতে না পারে তাহলে দেশ ডিজিটাল হবে কীভাবে, এটা কি তারা অনুধাবন করে থাকেন? ১৯৮৯ সালে মোবাইলের যাত্রা শুরুর থেকেই কলরেট কমানোয় অতীতের কোন সরকারেরই ভূমিকা রাখেনি। অপারেটররা পরস্পর বিজনেস প্রতিযোগিতায় কমিয়েছে। প্যাসিফিক বাংলাদেশ লিমিটেড একচেটিয়াভাবে সেট, সংযোগ ও কথা বলার গলাকাটা রেটের মাধ্যমে এর সূচনা করে। বর্তমানে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তের সীমানা ছাড়িয়ে নিম্নবিত্ত খেতমজুর, গৃহকর্মী, ফকির, মিসকিনের হাতেও রয়েছে মোবাইল ফোন। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সিম সংযোজন ফি ও কলরেট এতদিন উপরোক্ত সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে একটি স্বস্তিকর অবস্থানে ছিল।
টেলিযোগাযোগ একটি ক্রমবিকাশমান খাত। এতে সব শ্রেণি-পেশার লোককে ধরে রাখতে হলে এর সেবার ব্যয় রাখতে হবে যৌক্তিক পর্যায়ে। এতোদিন মোটামুটি তাই ছিল। তবে হালের এ রেট বৃদ্ধিতে আমাদের সব ধারণা পাল্টে দিয়েছে। যা চরম হতাশাজনক। আমরা সরকারকে টেলিকম খাতের বাজেটের বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করার জন্য আবারও অনুরোধ করছি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় আরেকটু জনবান্ধব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আবার বিষয়টি দেখতে পারে। কতটুকু সেবার জন্য কত বেশি ব্যয় করতে হবে, এ হিসাব খুব কঠিন নয়।