আল্লাহ রাব্বুল আল আমীন ঘোষণা করেছেন মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব বা আকলাকুল মাকলুকাত। ইবলিশ তা রক্ষা করে নাই বলে তাকে ফেরেস্তাদের দল থেকে বের করে দেয়া হয় এবং শয়তান হিসেবে পরিগনিত করা হয়। মানুষ মানুষের জন্য এ উক্তিটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। যার মধ্যে নীহিত রয়েছে মানুষের প্রতি মানুষের দয়া, প্রেম, ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও সহানুভূতি। যে যত বড় ক্ষমতাশালীই হোক না কেন মানুষকে ভালো না বাসলে সে কখনও আল্লাহর রহমত, সান্নিধ্য, দিদার, দয়া ও ভালোবাসা পেতে পারে না। মানুষের প্রতি কাহারও এর ব্যতিক্রম হলে দুনিয়া ও আখেরাতে কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তির কথা উল্লেখ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে একজন পন্ডিত ব্যক্তি বলেছেন, Sinner can never go unpunished অর্থাৎ পাপী কখনও দুনিয়া থেকে শাস্তি ছাড়া বিদায় হয় না। নমরূদ, কারূন, ফেরাউন (রামেসিস) যার উদাহরণ।
ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করলে দেখা যায়, লেন্দুম দর্জি নিজের স্বার্থে সিকিমের জনগণের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে এক সময় সিকিমের স্বাধীনতা ভারতের তল্পীবাহকদের কাছে তুলে দেয়। কিন্তু দেখা যায়, এই লেন্দুম দর্জি এক সময় ভারতে আশ্রয় নিয়ে খাদ্য, ঔষধ ও চিকিৎসার কষ্টাঘাতে নির্মম, অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করে থাকে। স্ত্রীকেও কাছে পায়নি। মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা ও বেঈমানীর ফল এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কি বা হতে পারে। এছাড়া পার্থিব জগতে এমন অসংখ্য উপমা উদাহরণের শেষ নেই। অপর দিকে যারা শাসন, প্রশাসন ও ক্ষমতার মালিক হয়ে দেশ, জাতি, জনগণ ও সমাজের জন্য কিছু করে গেছে তারা মরেও অমর হয়ে রয়েছে। তাদের জীবদ্দশাতে যে সম্মান পেয়েছে মৃত্যুর পরও মানুষ তাদের জন্ম ও মৃত্যু দিবসে যথাযোগ্য সম্মান জানাতে কুন্ঠাবোধ করেনি। এমনকি তাদের সমাধি বা কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় যেমন তাদের রূহের মাগফেরাত কামনা করে তেমনি তাদের কবর জিয়ারত করতেও ভুল করেনি। অপর দিকে মীর জাফরের কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আজও মানুষ ঘৃণাভরে থুথু নিক্ষেপ করে থাকে। ইহাই হয়তো বাস্তবতা। যাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ একেবারেই পরাহত।
এছাড়া জীবদ্দশাতে প্রভূত ক্ষমতা থাকার পরও মানুষের রোগে, শোকে, দুঃখে ও অভাব অভিযোগের সময় যারা তাকিয়ে দেখে না, চোখ ফিরিয়ে নেয় তাদের মৃত্যুর পর কবরের দিকে মানুষ তাকিয়েও দেখে না। বরং অনেকেই তাদের ঘৃণিত আমলনামা স্মরণ করে ধিক্কার জানাতেও কুন্ঠাবোধ করে না। যার রয়েছে অজ¯্র উদাহরণ। বাংলাদেশের পাকিস্তান প্রবাসী অনেকের কাছ থেকে জানা যায়, ৭১ সালের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে যে সমস্ত নররাক্ষস ও কষাই পাকিস্তানিরা
এদেশের নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে, মা বোনদের নির্যাতন করেছে, লুন্ঠন করেছে এবং কুলের শিশুকে হত্যা করেছে ওরা জনসমক্ষে আসলে নিজ দেশেই প্রশ্নের সম্মুখীন ও অপমানিত হয়ে থাকে। নরঘাতক টিক্কা, নিয়াজি ও ফরমান আলীর মতো লোকজন পাকিস্তানে কোনো অনুষ্ঠানে গেলে যেমন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়, তেমনি অনেককে অনেক অপমান, অপদস্ত করা থেকে পুলিশ তাদের রক্ষা করে থাকে। যুদ্ধের সময় যে সমস্ত পাকিস্তানি সৈন্য এদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহত হয়েছে তাদের পরিবারের লোকজন ও আত্মীয়-স্বজন হানাদার বাহিনীর তস্কর, নরঘাতক ও বিশ্ববেহায়া ইয়াহিয়ার কবরের পাশ দিয়ে চলাফেরার সময় ধিক্কার, ঘৃণা ও থুথু নিক্ষেপ করতেও ভুল করেনি।
৭১ সালের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন অনেকেই শহর ছেড়ে গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে তখন লক্ষ্য করলে দেখা গেছে যারা আত্মীয়-স্বজন এবং মানুষের দুঃসময়ে জনবান্ধব হিসেবে সহানুভূতির হাত সম্প্রসারিত করেছে তাদের প্রতি মানুষের আদর, যতœ ও সহানুভূতির অভাব পরিলক্ষিত হয়নি। আর যারা ক্ষমতা ও কর্মপরিসরে ভালো জায়গায় থাকার পরও এলাকার সাধারণ মানুষের পাশে না দাঁড়িয়ে তুচ্ছ, তাচ্ছিল্য করে তাড়িয়ে দিয়েছে সে শ্রেণীরা শহর, বন্দর, গঞ্জ ছেড়ে গ্রামে আসলেও এলাকার মানুষ শুধু তাদের পাশে আসতে দ্বিধাবোধই করেনি, তাদের কোনো কাজে সহযোগিতা করতেও চায়নি। এ লোকগুলো বর্তমান করোনা ভাইরাসের লকডাউনের মতো গৃহবন্ধী হয়ে পড়ে। এমনকি পরিবার ও নিকটতম আত্মীয়-স্বজনরাও এড়িয়ে চলতে সংকোচবোধ করেনি। ইহাই বাস্তবতা ও ঐতিহাসিক সত্য। যাতে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। অর্থাৎ মানুষ মানুষকে অবজ্ঞা, ঘৃণা ও ভালো না বাসার পরিণতি।
মানুষ সামাজিক জীব। জীবন চলার পথে সভ্য সমাজে একে অপরের কাছে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। এছাড়া স্বজন ও বন্ধুবান্ধব হলে তো কথাই নেই। এ বয়সে একজন সমাজকর্মী, সংবাদকর্মী, এক সময় প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী, লেখক ও নিবন্ধক হিসেবে অনেককে কমবেশী দেখার সুযোগ ঘটেছে। তন্মধ্যে অনেককে পেয়েছি জনবান্ধব হিসেবে আর অনেককে পেয়েছি অমানুষ হিসেবে। তাদেরকে কে বা কাহারা কি বলল তাতে তাদের কিছুই যায় আসে না। দুর্নামকে এ শ্রেণীটা কিছুই মনে করে না। ওদের কাছে ক্ষমতা ও অর্থ কামাই মুখ্যম। তবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় ক্ষমতার চেয়ারে গদিসিনদের মধ্যে সুনামের চেয়ে দুর্নামের পদলেহনকারীর সংখ্যাই অনেক বেশি। অনেককে দেখা যায়, কর্মস্থলে যোগদান করে নিজেকে তুলসী পাতা ধোয়া জাহির করলেও অবশেষে নিজেই নিজের অপকর্ম, সীমাহীন বেলাল্লাপনা ও দুর্নীতির কারণে আইনের বেড়াজালে আটকে পড়ে জনসমক্ষে নিজের আসল চেহারা উন্মোচিত হওয়ার ফলে এক সময় সব ক্যামোফ্ল্যাক্স ও গোমর কারও অজানা থাকেনি।
বর্তমান জনবান্ধব আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ সম্পর্কে একজন সমাজকর্মী, সংবাদকর্মী ও নিবন্ধক হিসেবে কাছ থেকে দেখার সুযোগ ঘটে। তিনি কিশোরগঞ্জের এসপি, ডিএমপির কমিশনার ও র্যাবের মহাপরিচালক থাকাকালীন সময়ে জনবান্ধব হিসেবে দৈনিক মুক্তখবরসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমার লেখা প্রকাশিত হয়ে থাকে। এমনিভাবে পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি ও সারদা পুলিশ একাডেমির প্রিন্সিপাল নাজিবুর রহমান, বর্তমান অতিরিক্ত আইজিপি (হাইওয়ে) মল্লিক ফখরুল ইসলাম, ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক (ডিআইজি চট্টগ্রাম রেঞ্জ), অতিরিক্ত ডিআইজি মোঃ আনোয়ার হোসেন খান (পুলিশ হেড কোয়াটার্স), পুলিশ সুপার মোঃ মাশরুকুর রহমান খালেদ (এসপি, কিশোরগঞ্জ)সহ আরও অনেকেরই পারফরম্যান্স ও জনবান্ধব হিসেবে মানুষ তাদের স্মরণ করে থাকে। বর্তমান অবক্ষয়ের যুগে এমপি, মন্ত্রীতো দূরের কথা অফিসের বড় কর্মকর্তাদের অফিস সহকারি, পিয়ন, চাপরাশি, অর্ডারলি থেকে শুরু করে আরও অনেকে মানুষকে যেমন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। এই সময় বর্তমান আইজিপি থেকে নিয়ে পুলিশ বিভাগের এ সমস্ত কর্মকর্তার কথা মানুষ যথেষ্ট গুরুত্ব ও সম্মান দিয়ে থাকে। তাদের কাছে ফোন করেও মানুষ সঠিক দিক নির্দেশনা ও সহযোগিতা পাওয়ার নজির ও দৃষ্টান্ত কম নহে।
সাবেক প্রধান বিচারপতি ও রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ সম্পর্কে তাহার আত্মীয়-স্বজন ও ভাগিনা সাইফুল ইসলামের কাছ থেকে জানা যায়, রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর এলাকার জনগণ ও আত্মীয়-স্বজনরা একাধিকবার তাহার মাতা পিতার কবর জিয়ারতের কথা বলে থাকে। তাতে তিনি সারা দেননি। তখন নাকি তিনি বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে বহুবার মাতা পিতা দাদা দাদীর কবর জিয়ারত করেছি। একজন রাষ্ট্রপতি কবর জিয়ারত করতে গেলে হেলিকপ্টারের খরচ ও আনুষাঙ্গিক যে সরকারি অর্থ ব্যয় হবে তা দিয়ে এলাকায় ছোট বড় দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করা যাবে। সেজন্য রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময়ে তিনি মাতা পিতার কবর জিয়ারত করতে যাননি। তিনি চাকরি জীবনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত চাকরির বেতন থেকে এলাকার অভাবগ্রস্থ লোকজন ও শিক্ষা সম্প্রসারণে অনেক দৃষ্টান্ত রেখেছেন। যা মানুষের প্রতি দরদ, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধেরই প্রকাশ।
নিবন্ধের আলোকে জনবান্ধব আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ সম্পর্কে নিজের দেখা ও জানামতে সংক্ষিপ্তভাবে কিছু ঘটনা ও দৃশ্যপটের অবতারণা করা হল। তিনি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও পরবর্তী সময় পুলিশ সুপার হিসাবে কিশোরগঞ্জ জেলায় যোগদান করেন। তিনি একজন সদালাপি, সাহিত্যিক, গবেষক, কর্মোদ্যোগী ও জনবান্ধব হিসেবে কিশোরগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষের কাছে অল্পদিনের মধ্যে পরিচিতি লাভ করে থাকেন। দেখা গেছে তিনি যা বলতেন তা করার চেষ্টা করতেন। বড় বড় কথা, অহংকার ও তীর্যকতা তার মাঝে লক্ষ্য করা যায়নি। এছাড়া পুলিশি হাবভাব তাহাকে স্পর্শ করেনি। তিনি ছিলেন জনগণের অকৃত্রিম সহায়ক ও বন্ধু। দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন ও কমিউনিটি পুলিশিং এর জনক লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট ফীলের অনুসারী হিসেবে মনে করা হলে অত্যোক্তি হওয়ার মতো কিছু নয়। রবার্ট ফীলের মর্মবাণী ছিল পুলিশই জনতা এবং জনতাই পুলিশ অর্থাৎ Police are the public & public are the police। ড. বেনজীর আহমেদ তখন কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার। এক সময় ৪/৫ জন ওনার অফিস কক্ষে বসে আছি। এমন সময় একজন সাধারণ মানুষ লুঙ্গি ও গেঞ্জী পড়া অবস্থায় তাহার অফিস কক্ষে ঢুকে বলল স্যার, আমার বাড়ী পাকুন্দিয়া উপজেলার সুখিয়া ইউনিয়নের টুঠারজঙ্গল গ্রামে। আমার পৈতৃক ভিটামাটি থেকে বিত্তশালী এক ব্যক্তি দলবল নিয়ে উচ্ছেদ করেছে। আপনি আমার অসহায় পরিবারকে রক্ষা করেন। লোকটি ঠেলাগাড়ী চালিয়েও জীবিকা নির্বাহ করে বলে জানায়। একথা শুনার পর এসপি বেনজীর আহমেদ তাকে নিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি কিশোরগঞ্জে এসপি থাকাকালীন জনবান্ধব হিসেবে আরও অনেক স্মৃতি রেখে গেছেন।
বড় বড় কথা, ঢাকঢোল পিটিয়ে জনবান্ধব হওয়া যায় না। জনবান্ধব হতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন মানুষকে ভালোবাসা, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ। দাম্ভিকতা, অহংকার ভুলে গিয়ে কথা ও কাজের সমন্বয়, প্রতিশ্রুতি পরায়ন, ধৈর্য্য, সহিষ্ণুতা অবলম্বন, আত্মম্ভরিতা পরিহার ও জনআস্থা অর্জন।
ডিএমপির কমিশনার ও র্যাবের মহাপরিচালক থাকাকালীন তিনি যথেষ্ট অবদান রেখে গেছেন। একদিকে জঙ্গি দমন, অপরদিকে মাদক নিয়ন্ত্রনে সবিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকেন। এমনকি যারা পুলিশ ও র্যাবের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারঙ্গম ছিল তাদেরকেও বিভাগীয় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানে আনুগত্য প্রকাশ না করে দৃঢ় মনোভাবের অনেক দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। ক্যাসিনোর গডফাদারদের বিরুদ্ধে র্যাবের ডিজি হিসেবে ড. বেনজীর আহমেদ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, দেশের মানুষ কখনও তা ভুলার কথা নহে। যাকে বলা যায় ইহা র্যাবের একটি দুঃসাহসিক সাফল্যজনক অভিযান।
জনবান্ধব আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বাংলাদেশ পুলিশ ও দেশের মানুষের গৌরব ও অহংকার। আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ তার সেবা, শ্রম, স্বচ্ছতা ও মননশীলতা দিয়ে পুলিশের ভাবমূর্তি আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে জনপ্রত্যাশা। পরিশেষে বলব, সেবা, শ্রম, সাধনা, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, ন্যায়নিষ্ঠা, আত্মশুদ্ধি, অহংকার বিমোখ, আত্মম্ভরিতা পরিহার, মানুষের প্রতি দয়া, ভালোবাসা, নিজেকে যেমন গৌরবান্বিত করে, তেমনি জনগণের সমর্থন ও সহযোগিতায় অনেক বড় কাজ ও অসাধ্যকে সাধন করা সম্ভব হয়ে থাকে। পুলিশ দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন ও জনগণের বন্ধু হতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ ও মানুষকে মূল্যায়ন ও ভালোবাসা।
(এ.কে.এম শামছুল হক রেনু)
লেখক কলামিষ্ট