করোনা প্রাদুর্ভাবে দেশে অক্সিজেন সিলিন্ডারের তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। মূলত হুজুগে পড়ে ঘরে ঘরে অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুদের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে বাজারে অক্সিজেন সিলিন্ডারের দাম আকাশছোঁয়া। ১০ হাজার টাকার সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকায়। এমন পরিস্থিতিতে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের সিলিন্ডারে ছেয়ে গেছে বাজার। পরিস্থিতি সামাল দিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জরুরিভাবে হাই ফ্লো নাসাল ক্যানোলা সিস্টেম (এইচএফএনসি) ও অক্সিজেন সিলিন্ডার আমদানির পরিকল্পনা করছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, করোনায় গুরুতর অসুস্থদের প্রাণ বাঁচাতে হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের চাহিদা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। পাশাপাশি বাড়তি সতর্কতা হিসেবে সাধারণ নাগরিকরাও ঘরে ঘরে অক্সিজেন কিনে মজুদ রাখছে। মূলত হাসপাতালগুলো চিকিৎসা দিতে গড়িমসি করায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে ১.৩৬ মিটার কিউব গ্যাস ধারণক্ষমতার সিলিন্ডার। সুযোগ বুঝে অসাধু চক্র সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে অক্সিজেন সিলিন্ডারের দামে মোটা টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর দিন যত যাচ্ছে দেশের হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীর চাপ ততো বাড়ছে। রোগীর চাপ সামলাতে বিশেষায়িত হাসপাতালগুলো হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় যেসব রোগীর শারীরিক অবস্থা কিছুটা ভালো চিকিৎসকরা তাদের বাড়িতে থেকেই নিয়ম মেনে চিকিৎসা নিতে উদ্বুদ্ধ করছেন। কিন্তু বাড়িতে থাকা রোগীরা বাড়তি সতর্কতা হিসেবে অন্তত একটি সিলিন্ডার বাড়িতে রাখতে চাচ্ছেন। ফলে সারা দেশে অক্সিজেন সিলিন্ডারের বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছে।
সূত্র জানায়, করোনা রোগীদের চিকিৎসায় হাই ফ্লো নাসাল ক্যানোলা সিস্টেম (এইচএফএনসি) খুবই দরকারি এবং প্রয়োজনীয় একটি যন্ত্র। এ যন্ত্রের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করা হলে রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট তাড়াতাড়ি দূর হয়ে যায়। অল্প কয়েকটি হাসপাতালে এ ধরনের যন্ত্রের মাধ্যমে রোগীকে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। কিন্তু করোনা রোগী বাড়ায় বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোয় বর্তমানে এ জাতীয় চিকিৎসা সরঞ্জামের সরবরাগ বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে। আর বাড়তি চাহিদায় অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের প্রচ- চাপে হিমশিম খাচ্ছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, অক্সিজেন সিলিন্ডার নেই জেনেও অনেক ক্রেতা জোর করে ওসব প্রতিষ্ঠানে টাকা জমা দিয়ে যাচ্ছে। বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় সরবরাহকারী সবগুলো প্রতিষ্ঠান অক্সিজেন সিলিন্ডারের সঙ্কটে পড়েছে। প্রায় পাঁচ গুণ দাম বেড়ে মাঝারি মানের একটি অক্সিজেনের সিলিন্ডার ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম বিক্রি হচ্ছে ২৬ হাজার টাকা। অথচ তিন মাস আগেও অক্সিজেন সিলিন্ডারের এই সেট পাওয়া যেত ৫ থেকে ৬ হাজার টাকায়।
সূত্র আরো জানায়, পরিস্থিতি সামাল দিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জরুরিভাবে আমদানির প্রয়োজনে দরপত্র আহ্বান না করেই ওসব উপকরণ আমদানির পরিকল্পনা করছে। ওই লক্ষ্যে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন আমদানিকারক ও সরবরাহকারীকে মন্ত্রণালয়ে ডেকে এনে দর প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি প্রতিটি হাই ফ্লো নাসাল ক্যানোলা সিস্টেম ডিভাইসের জন্য ১২ লাখ টাকার প্রস্তাব করে পরে তা ৯ লাখ টাকায় নামিয়ে আনে। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা প্রতিটি এইচএফএনসি সেটের মূল্য সাড়ে তিন লাখ টাকা দিতে চাচ্ছে। তবে সরবরাহকারীরা তাতে রাজি হননি। অবশ্য সম্প্রতি ৩৯টি সরকারি হাসপাতালে কভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় রোগীদের লিকুইড অক্সিজেন ট্যাংক থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। সম্প্রতি লিকুইড অক্সিজেন ট্যাংক স্থাপনের জন্য ন্যাশন্যাল ইলেকট্রো-মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স অ্যান্ড ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারে একটি চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, গণপূর্ত বিভাগ নির্মিত সরকারি হাসপাতালগুলোয় মেডিকেল গ্যাস পাইপলাইন সিস্টেম থাকলেও অধিকাংশ হাসপাতালে লিকুইড অক্সিজেন ট্যাংক নেই। ফলে কভিড-১৯ রোগীদের নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীদের সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করা হলেও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে চিকিৎসা নিতে গিয়ে রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সিলিন্ডার অক্সিজেন দিয়ে অল্প কিছু ক্ষেত্রে কাজ চালিয়ে নেয়া হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা পর্যাপ্ত নয়। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হলে অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ে, কিন্তু সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। আবার কমপ্রেসড অক্সিজেনের চেয়ে লিকুইড অক্সিজেন ব্যবহার করা তুলনামূলক সহজ। এক্ষেত্রে শুধু কেন্দ্রীয়ভাবে সরবরাহের ব্যবস্থা থাকলেই রোগীদের নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন দেয়া সম্ভব।
এদিকে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া নি¤œমানের এবং নির্ধারিত মাত্রার কমবেশি অক্সিজেন প্রয়োগে বিষক্রিয়া এবং নানা দুর্ঘটনাও ঘটছে। পাশাপাশি নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহারে দেখা দিচ্ছে নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাড়তি চাহিদায় সরবরাহকৃত সিলিন্ডারের সাথে থাকা মাস্ক এবং পাইপের মান নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। করোনা রোগীদের জন্য প্রয়োজন উচ্চ চাপসমৃদ্ধ অক্সিজেন। কিন্তু এখন করোনা রোগীদের জন্য শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে। ওই সিলিন্ডারে অক্সিজেনের পরিমাণ কত আছে তা জানার সুযোগ নেই। ফলে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যেই মাঠে নেমেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর চলমান করোনাভাইরাস মহামারীতে বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুদ না করার পরামর্শ দিয়েছে। কারণ অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে ভয়াবহ বিপদ ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত অনলাইন বুলেটিনে অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) প্রফেসর নাসিমা সুলতানা জানান, এটি একটি টেকনিক্যাল বিষয়। দয়া করে এগুলো (অক্সিজেন সিলিন্ডার) কিনে বাড়িতে মজুদ করবেন না। এটা বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করবে। একজন রোগীর প্রতি মিনিটে কতটুকু অক্সিজেন প্রয়োজন তা কেবল একজন চিকিৎসকই বলতে পারেন। এ ধরনের কাজের মাধ্যমে জীবনের ঝুঁকি ডেকে না আনতে সবার প্রতি পরামর্শ দেন তিনি।
অন্যদিকে এইচএফএনসি ও অক্সিজেন সিলিন্ডার আমদানি প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও মন্ত্রণালয় গঠিত মিডিয়া সেলের ফোকাল পয়েন্ট মো. হাবিবুর রহমান খান জানান, অক্সিজেন সিলিন্ডার ও হাই ফ্লো নাসাল ক্যানোলা সিস্টেম আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৫০০ সিলিন্ডার আমদানির চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। হাই ফ্লো নাসাল ক্যানোলা সিস্টেমের সংখ্যা এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। দ্রুতই ওসব যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে হাসপাতালগুলোয় সরবরাহের উদ্যেগ নেয়া হবে।