দেশে আশঙ্কাজনক হারে বজ্রপাতে মৃত্যু ও আহতের সংখ্যা। গত এপ্রিল থেকে প্রতিদিনই বজ্রপাতের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে বজ্রপাতের ঘটনা ১৫ শতাংশ বেড়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ২শ’ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। আর বজ্রপাতে প্রতিটি মৃত্যুর সাথে গড়ে ১০ জন আহত হচ্ছে। এপ্রিল ৭০ জন এবং মে মাসে ৬০ জনের বজ্রপাতে প্রাণহানি ঘটেছে। চলতি মাসে একদিনেই সিলেটে বজ্রপাতে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। বজ্রপাতে আহতরা স্থায়ীভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীতে বজ্রপাতে যতো মানুষ মারা যাচ্ছে, তার এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশে ঘটছে। হাওর, বাঁওড় ও বিল এলাকার জেলাগুলোয় বজ্রপাতে বেশি প্রাণহানি ঘটছে। ঝড়-বৃষ্টির সময় খোলা মাঠ, নৌকা ও পথঘাটে যারা চলাচল করে তারাই এর শিকার। বিশেষজ্ঞদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ডিজাস্টার ফোরাম নামে একটি সংগঠনের গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণ তথ্যানুযায়ী ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯ মে পর্যন্ত বজ্রাঘাতে ৭৩ জনের মৃত্যু ও ২৮ জন আহত হয়েছে। ২০১৮ সালে নিহতের ঘটনা ২৭৭টি। দেশি-বিদেশি গবেষণার তথ্যানুযায়ী দেশে গত কয়েক বছরে কালবৈশাখীর পাশাপাশি বজ্রপাত বেড়েছে। আর বজ্রপাতে মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় বিগত ২০১৬ সালের ১৭ মে বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, বজ্রপাতে একটি মৃত্যু হলে আরো ১০-১৫ জন আহত হন বলে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। পাশাপাশি অন্য দুর্ঘটনায় আহত আর বজ্রাঘাতে আহতের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এই দুর্ঘটনায় আহতরা স্থায়ীভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। দেশের হাতে গোনা কিছু জেলায় বজ্রপাত বেশি ঘটে। বিশেষ করে হাওর, বাঁওড় ও বিল এলাকার জেলাগুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। লাইটেনিং অ্যারেস্টর স্থাপনই মূল সমাধান। বিশেষজ্ঞরা এখনো বজ্রপাতে মৃত্যু নিয়ে একক কোনো কারণ চিহ্নিত করতে পারছেন না। তাদের ধারণা, তাপমাত্রা ও বাতাসে সিসার পরিমাণ বৃদ্ধি, জনজীবনে ধাতব পদার্থের ব্যবহারের আধিক্য, মোবাইল ফোন ব্যবহার ও এর টাওয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি, বনভূমি বা গ্রামাঞ্চলে উঁচু গাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস, জলাভূমি ভরাট ও নদী শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি বজ্রপাত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। আর এর সবকটির সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নের সম্পর্ক আছে। বিশ্বখ্যাত সায়েন্স পত্রিকার নিবন্ধে ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বজ্রপাতের আশঙ্কা ১২ শতাংশ বেড়ে যায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশে সাধারণত এপ্রিল থেকে জুন মাসে বজ্রপাত বেশি হয়। এই সময়ে ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতাও থাকে। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই বজ্রপাত ও ঘূর্ণিঝড় দুর্যোগই বাড়ছে।
এদিকে বজ্রপাত বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল জানান, বিশ্বে বাংলাদেশে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এর প্রতিরোধে ‘আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম’ (প্রাক-সতর্কীকরণ ব্যবস্থা) ও লাইটেনিং অ্যারেস্টর (বজ্রপাত নিরোধক) স্থাপনের মাধ্যমে মানুষকে রক্ষার পদক্ষেপ নেয়া যায়। আর এ কাজটি সরকারকেই করতে হবে। তবে সবচেয়ে বেশি দরকার সচেতনতা। কালো মেঘ দেখা দিলে উন্মুক্ত প্রান্তরে আর কাজ করা যাবে না। বাসাবাড়িতে আর্থিংয়ের ব্যবস্থা ও মাঠে-ঘাটে গাছ রোপণ (যা উঁচু হবে) এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। ওড়িশায় আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম বেশ কাজে লেগেছে বলে জানা যায়।
অন্যদিকে একই প্রসঙ্গে বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. একেএম সাইফুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে অন্তত ৪০টি বজ্রপাত হয় বলে আন্তর্জাতিক গবেষণায় উঠে এসেছে। এদেশ পৃথিবীর বজ্রপাতপ্রবণ অঞ্চলের একটি দেশ। বিশ্বে বজ্রপাতে যতো মানুষ মারা যায় তার এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশে ঘটছে। বিগত বছরগুলোয় বজ্রপাত অন্তত ১৫ শতাংশ বেড়েছে। আশা করা যায় প্রযুক্তির ব্যবহার করে বজ্রপাতে মৃত্যু নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে।