কৃষক, মজুর, শ্রমিক যাদের নিরলস পরিশ্রম বাংলাদেশ উন্নয়ন মাপকাঠি ছুঁয়েছে, তাদের মধ্যে দেশের কৃষকরা সব থেকে অবহেলিত। কৃষকের উৎপদিত ধানের নায্য মূল্য না পাওয়ায় কৃষি শ্রমিকের গত অল্পসংখ্যক ৩বছর থেকে থেকে কৃষকের ধান কাঁটতে চায় না শ্রমিকেরা। কোন কোন সময় কাটলেও পারশ্রমিক এত বেশী যে তা পরিশোধ করতে কৃষককে যথেষ্ঠ বেগ পেতে হয়। দিন মিজুর নিজেদের শ্রমের মুল্য নির্ধারণ করে। শ্রমিকেরা পারিশ্রম মজুরী বাড়াতে আন্দলোন করতে পারে। অথচ কৃষক বছরের পর বছর রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, শীতের দুঃখ মাথায় নিয়ে যারা দেশবাসির জন্য খাদ্য জিনিস উৎপাদন করে, দেশকে খাদ্যপণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে যাচ্ছে, আজ তারাই বাংলাদেশে সবচেয়ে অবহেলিত। তারা কোন প্রতিাবাদ করতে পারে না বিক্ষোভ করতে পারেনা। গত ২০১৭ইং সালে প্রথম দেখা গিয়েছিল কৃষকেরা প্রতিবাদ করেছেন, ধানে অগ্নি লাগিয়ে দিয়েছেন, প্রেস ক্লাব, রাস্তাসহ বিভিন্ন স্থানে ধান ছিটিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। ইউএনও, ডিসি, পুলিশ, মন্ত্রী, এমপি, রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষার্থী ব্যাংকারসহ বিভিন্ন পেশার কৃষকদের ধান কেটে দিয়েছেন। এবার কৃষকের ধান কেটে দিয়েছেন অনেকেই। কৃষকদের বাড়ী, বাড়ী গিয়ে ধান কেনা করেছেন এগুলি ছিল মূলত ফেসবুক, পত্র পত্রিকা ও টিভির শিরোনাম হওয়ার জন্য কৃষকদের মূলত কোন কাজে আসে নি। পত্র পত্রিকার প্রকাশিত প্রকাশিত রির্পোটে দেখা যায় খাদ্য জিনিস গুদাম গুলি ধান দিয়ে ভর্তি করেছেন প্রভাবশালী সিন্ডিকেট, নামধারি মন্দ সাংবাদিক, চিহ্নিত মাদক সম্রাট, রাজনীতিবিদসহ আরও অনেকে। যা প্রকৃত তদন্ত করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসত। আর এ বছর চিত্র উল্টাে বাজারে ধানের দাম বেশী থাকায় কোন সিন্ডিকেট, দালালরেরা খাদ্য জিনিস গুদামে ধান নিয়ে যান নি, কৃষকগণ আশেপাশের বাজারে ধান বিক্রি করে দিচ্ছন। করোনা ভাইরাসের ভয়কে জয় করে কৃষক বন্ধুরা রোপা আমন, পারিজা ধান লাগাতে ও বীজতলা তৈরী করতে কৃষক ভাইয়েরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। যখন কলামটি লিখচ্ছি তখন দেশের করোনা ভাইরাসের নিয়মিত বুলেটিন চলছে একটু লক্ষ্য করলে বুঝা যাবে এর ভয়াবহতা কত? এদিন সর্বচ্চ মারা গেছে। দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় মহামারী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৫৩ জনের প্রাণহানি হয়েছে। করোনায় এটাই এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। এ নিয়ে করোনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ১ হাজার ২৬২ জনে। এ ছাড়া একই সময়ে নতুন করে ৩ হাজার ৮৬২ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন। এটিও একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত শনাক্তের রেকর্ড। এ নিয়ে সর্বমোট ৯৪ হাজার ৪৮১ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শনাক্ত হল। মঙ্গলবার দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত অনলাইন হেলথ বুলেটিনে অধিদপ্তরের বাড়তি মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা এসব তথ্য জানান। গত ডিসেম্বরে চীনের উহান শহর থেকে ছড়ানোর পর এ ভাইরাসে বিশ্বজুড়ে এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। মৃতের সংখ্যা ৪ লাখ দুই হাজারেরও বেশি। তবে প্রায় সোয়া ৩৪ লাখ রোগী ইতোমধ্যে সুস্থ হয়েছেন। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। যাই হউক ঝুঁকি নিয়ে কৃষি কাজের ব্যাপারে প্রধান ব্যক্তি ও কৃষকগণ শারিরীক দূরুত্ব বজায় মাঠে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছন।
আমন ধান সম্পর্কে একটু পরিচিত হওয়া যাক। আমন শব্দটির উৎপত্তি আরবি শব্দ ‘আমান’ থেকে যার অর্থ আমানত। অর্থাৎ আমন কৃষকের পাশে একটি নিশ্চিত ফসল (ঝঁৎব ঈৎড়ঢ়) বা আমানত হিসেবে পরিচিত ছিল। আবহমান সময় থেকে এ ধানেই কৃষকের গোলা ভরে, যা দিয়ে কৃষক তার পরিবারের ভরণপোষণ, পিঠাপুলি, আতিথেয়তাসহ সংসারের অন্যান্য ব্যয় মিটিয়ে থাকে। ২০১৬-১৭ আমন মৌসুমে দেশে ৫.৫-৫.৬ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষ হয়, এর মধ্যে ০.৩২৮ মিলিয়ন হেক্টর বোনা, ১.০৮৩ মিলিয়ন হে. স্থানীয় জাতের এবং ৪.১৭২ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে উফশী রোপা আমন চাষ হয়। ২০১৭-১৮ মৌসুমে সরকারের নানামুখী উদ্যোগের কারণে আমন আবাদ এরিয়া ২% বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে ০.৩৬৫ মিলিয়ন হেক্টর বোনা, ০.৯৪৫ মিলিয়ন হে. স্থানীয় জাতের এবং ৪.৩৯৫ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে উফশী রোপা আমন চাষ হয়। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রতি বছর আমনের উৎপাদন বাড়ছে এবং গত বছর আমনের উৎপাদন ১ কোটি ৪০ লক্ষ টনে পৌঁছায়। এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে নতুন নতুন উদ্ভাবিত জাত, আধুনিক ব্যবস্থাপনা ও সরকারের সঠিক নীতি। আমন ধান মূলত দুই প্রকার; রোপা আমন ও বোনা আমন। রোপা আমন ভিন্ন জমিতে চারা প্রস্তুত করে, সেই চারা ক্ষেতে রোপণ করে ধান উৎপন্ন হয় বলে এর এরূপ নাম। রোপা আমন আষাঢ় মাসে বীজতলায় বীজ বোনা হয়, শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে মূল জমিতে রোপণ সাধন হয় এবং কার্তিক-অগ্রহায়ণ-পৌষ (এলাকাভেদে) মাসে ধান রচনা হয়। বোনা আমন ছিটিয়ে বোনা হয়। চৈত্র-বৈশাখ মাসে মাঠে বোনা আমনের বীজ বপন সাধন হয় এবং অগ্রহায়ণ মাসে পাকা ধান রচনা হয়। একে আছড়া আমন, বাওয়া আমন বা গভীর পানির আমনও বলা হয়। আমন মৌসুমে যেহেতু আবাদ অঞ্চল সম্প্রসারণের তেমন সুযোগ নেই তাই ফলন বাড়ানোর জন্য নতুন জাত চাষাবাদের সঙ্গে সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত সাধন জরুরি। আমন ধানের ফলন বৃদ্ধিতে করণীয় বিষয় যেমন- ভালো বীজ নির্বাচন, জমি তৈরি, সঠিক সময়ে বপন বা রোপণ, আগাছা দূরীকরণ, সার ব্যবস্থাপনা।, প্রতি বছর এটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাগণ প্রধান মন্ত্রী ও কৃষি মন্ত্রীর নির্দেশে রোপা আমন পারিজা লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে বেশী পরিমান জমিতে ধান চাষ হবে, সে জন্য বীজ তলাও বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষকগণ বীজতলা তৈরী, ধান লাগানো, জমি তৈরীতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। চাষীদের বোরো ধান উৎপাদন ব্যয় নিয়ে আলোচনার সামনে সামান্য উক্তি যে না বললেই নয়, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরে মূল অর্থকরি ফসল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল পাট, আঁখ, তুলা এবং ধান। লাভের পরিমান উৎপাদন ব্যয় ও বাজার না থাকায় পাট চাষ প্রায় বন্ধ যা চাাষ হয় সেগুলির বেশীরভাগই শাক হিসেবে মানুষ খেয়ে ফেলেন। ভাল দেশি তুলার চেয়ে টেক্সটাইল মার্কেটে অল্প দামে নিম্নমানের বিদেশি তুলায় আগ্রহ অসীম। তাই তুলা চাষ বাজার হারাতে হারাতে বিলীন হয়ে গেছে। অন্যদিকে প্রয়োজনের বাড়তি চিনি আমদানির কারণে আঁখ চাষে আর কোন লাভ আসে না। আমদানির কারণে দেশি চিনি শিল্প এখন লোকসানি খাতে পরিণত হয়েছে। ধান চাষে কৃষকরা যে লোকসানে পড়ছে তা এখন পত্র পত্রিকা, টিভি চ্যালেনগুলি খুললে দেখা যায়। বোরো ধানের পেছনে কৃষকের শ্রম ও অর্থ ব্যয় বছরে সব থেকে বেশি হয়। চাহিদা বেশি থাকার কারণে এই ধানের উপর লাখ লাখ কৃষকের বছরের উপার্জন নির্ভর করতো। ফলন ভাল অথচ সময় শ্রম ও ব্যয় বেশি বলে মহাজনরা এই ফসলে ভাগ অল্প নেয়। আর কোন স্থানে কি রকম জানি না, তবে আমাদের উত্তরাঞ্চলে প্রায় হালকা চুক্তিতে কৃষকের পাশে জমি ছেড়ে দেন মহাজনেরা। তবুও বোরো ঘরে তুলে মহাজনের ভাগ পরিশোধ করার পর খুব একটা টাকা থাকে না বলে পরবর্তি ফসল উৎপাদনের জন্য ব্যয় করতে পারে না। মোটা চাল আমদানির কারণে গত সাত আট বছর থেকে বোরো ধান পর্যাপ্ত দাম পাচ্ছে না কৃষকরা। ধান লাগালেই ধান হয় না। এর পেছনে প্রচুর পরিশ্রম ও ব্যয় আছে। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ হলেও দেশের সিংহভাগ মানুষের ধারনা নেই ধান উৎপাদনে মাঠ পর্যায় প্রকৃত ব্যয় কত। দেশের প্রচুর গণ্যমান্য ব্যক্তিকে কৃষক ও কৃষি বিষয়ে বিরক্ত প্রকাাশ করতে দেখেছি। তারা হয়তো মনে করেন, চাষারা উদ্দেশ্য ছাড়াই অহেতুক হাঙ্গামা করছে। দেশে সব মাঠে পর্যাপ্ত ধানের উৎপাদন হয়, তারপরও কি কারণে এরা অভাব অভাব করে, এরা আর কি চায়, এদের কারণেই হয়তো চালের দাম বাড়ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, তাদের ধারনা সম্পুর্ণ ভুল। তারা যে চাল খায় সেটা চিকন চাল। বাজারে যেটার দাম আগাগোড়াই বেশি থাকে। দাম বেশি হবার উদ্দেশ্য হচ্ছে, দেশের নির্দিষ্ট সামান্য জায়গায় এসব ধানের আবাদ হয়, ভিন্ন কোথাও হয় না। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অল্প হওয়ায় চিকন ধানের দামটাও সব সময় বেশি থাকে। সামর্থেও অভাবের কারণে চিকন চাল সবাই কিনতে পারেনা। যারা এই চাল কিনতে পারেনা তাদের সংখ্যা এদেশে সবচেয়ে বেশি, বলা যায় দেশের নব্বই শতাংশ মানুষ। সে সব মানুষের খাদ্য জিনিস হচ্ছে মোটা চাল। যা বোরো ধান থেকে সংগ্রহ সাধন হয়। নিম্ন আয়ের মানুষের পেটের খাওয়ার ইচ্ছা মেটায় অল্প দামের মোটা চাল, বোরো ধানের চাল। বোরো ধানের দাম অল্প অথচ তা উৎপাদন ব্যয় সামলাতে হিমসিম খেতে হয় মাঠ পর্যায়ের চাষীদের।
প্রশ্ন আসতে পারে, এই ধান উৎপাদনে আসলে কি পরিমাণ ব্যয় হয়? হিসাবটা জানলে, অনেকেই বুঝতে পারবেন, কি কারণে কৃষকরা ধান চাষে প্রতিবার যার ক্ষতি হয়েছে এমন হচ্ছে? বোরো ধান চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে? বাংলা বছরের মাঘ মাসের পহেলা তারিখ থেকে তিরিশ তারিখের মধ্যে বোরো ধানের বীজতলা তৈরি করে বিজ ছিটাতে হয়। বিঘা প্রতি বীজ লাগে ৪০০টাকা থেকে ৪৮০ টাকার। সুস্থ্য চারা তৈরি করতে তিরিশ দিন সময় লাগে। এ সময় পানি ও সার প্রয়োগে ব্যয় হয় বিঘা প্রতি আরো ১০০০ টাকা। এ ধানের জন্য জমি তৈরি করতে এক বিঘা জমিতে দরকার পাঁচশ কেজি গোবর সার, যার মুল্য ১২০০ টাকা। সার জমিতে আনা এবং ছিটানো বাবদ ব্যয় হয় ৫০০ টাকা। সার পচানোর জন্য জমিতে চাষ ও পানি দিতে হয়, সেখানে পানি ২০০ টাকা এবং পাওয়ারটিলারে চাষ ব্যয় ৫০০ টাকা। মাটি পাকাতে সময় লাগে সাত দিন। সাত দিন পর পুনরায় চাষ ৫০০ পানি ২০০ টাকার দিতে হয়। তার দুই থেকে তিন দিন পরে রাসায়নিক সার পটাশ ১৫ কেজি ১৮০ টাকা, টিএসপি ১৫ কেজি ৩৬০ টাকা, ইউরিয়া ৫ কেজি ৮০ টাকা। এরপর সাত দিন অপেক্ষা। সাত দিন পর পুনরায় পানি ২০০ টাকা চাষ বাবদ ৫০০ টাকা। বীজ তলা থেকে চারা এনে জমিতে রোপন করতে বিঘা প্রতি ১৬০০ টাকা শ্রমিক মজুরী দিতে হয়। পুরো ফসলের চাষে ন্যুনতম ১২ বার পানি সেচ দিতে প্রতিবার ৩০০ টাকা হিসেবে মোট ৩৬০০ টাকা ব্যয় হয়। জলবায়ু প্রতিকূল হলে বৃষ্টির পানি এখানে ব্যয় কিছুটা কমিয়ে দেয়। ধান রোপনের দশম দিনে দশ কেজি ইউরিয়া ১৬০ টাকা, সাথে ঘাস মারার বিষ দেড় প্যাকেট বা দেড় কেজি ১২০ টাকা। পঁচিশ দিন পর নুন্যতম ৩০ কেজি ইউরিয়া সার ৪৮০ টাকা তার সাথে এক কেজির এক প্যাকেট সালফার ৪৮০ টাকা। এর সাত দিনের মধ্যে ৮০ লিটার পানির সাথে মাজরা পোকা মারা বিষ ১৫ গ্রাম, সাথে মেশাতে হবে পাতার পোকার বিষ- ১০০ মিলি, ছত্রাক নাশক ১০০ গ্রাম-মোট ব্যয় ৫৩০ টাকা। তার ১৫ দিনের মাথায় দানা বিষ প্রয়োগ করতে লাগে বিঘা প্রতি দুই কেজি হিসেবে ৩০০ টাকা। এর ঠিক ১৫ থেকে ২০ দিন পরে পুনরায় মাজরা পোকা মারা বিষ ১৫ গ্রাম তার সাথে মেশাতে হবে পাতার পোকার বিষ ১০০ মিলি, ছত্রাক নাশক ১০০ গ্রাম যার ব্যয় ৫৩০ টাকা। ধানের শীষ বের হবার পূর্বে আবারও মাজরা পোকার বিষ ১৫ গ্রাম সাথে মেশাতে হবে পাতার পোকার বিষ ১০০ মিলি, ছত্রাক নাশক ১০০ গ্রাম মোট ব্যয় ৫৩০ টাকা। ধানের শীষ বের হয়ে, হেলে যাওয়ার সামনে ছত্রাক নাশক প্রয়োগ করতে হয় ব্লাস্ট প্রতিষেধক জিল ১০০ গ্রাম, কার্বাডাজেম ১০০ গ্রাম সঙ্গে যে কোন গন্ধ যুক্ত তরল বিষ ১০০ মিলি, যাতে ব্যয় ৪২০ টাকা। শীষ হেলে যাওয়া থেকে পাক ধরার সামনে আবারও মাঠে ছত্রাক নাশক প্রয়োগ করতে হয়। ব্লাস্ট প্রতিষেধক হিসেবে জিল ১০০ গ্রাম, কার্বাডাজেম ১০০ গ্রাম সঙ্গে যে কোন গন্ধ যুক্ত তরল বিষ ১০০ মিলি, যার ব্যয় ৪২০ টাকা। এরপর আসে ধান কেটে ঘরে তোলার পর্ব। ধান রচনা মাড়াই ৬০০০ টাকা বিঘা, স্থান বিশেষে ব্যয় বেড়ে যায়। উপর্যুক্ত প্রক্রিয়ায় প্রতি বিঘায় ধান উৎপাদন হয় ২৫ থেকে ২৮ মন। ধানের নায্য মূল্য না পাওয়ায় প্রতিবছর কৃষককের লোকসান হচ্ছে। বোঝার উপর শাকের আঁটি বাড়তে বাড়তে নিজের জমি জায়গা বিক্রি করে দায় দেনা পরিশোধ করতে হয়েছে। অথচ বাজার মূল্য ১০০০ টাকা ১০৫০ টাকা স্থান ও জাত ভেদে ধানের মূল্য অল্প হতে পারে। উৎপাদিত ধানের নায্যমূল্য পাওয়ায় কৃষককেরা ফের ধান চাষে আগ্রহ ফিরে পাচ্ছে এখন কৃষক আগাম জাতের পারিজা ধান চাষে ব্যস্ত সময় পার করছেন। গত বছর প্রচুর কৃষক বলছিলেন আর করবো না ধান চাষ দেখবো তোরা কি খাস? অথচ কৃষক বন্ধুরা সেটা পারবেন নি ? চার থেকে পাঁচ মাস গাধার মত খেটে এক বিঘা জমির ফলন বিক্রি করে একজন কৃষক সর্বচ্চ ১৪ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকা পায়। তাতে তারা নিজেদের ব্যয় এবং মহাজনের পাওনা শোধ করে, আবারও মাঠে পরবর্তী ফসল ফলাতে প্রস্তুতি নেয়। তবে নিজেদের জন্য কোন অর্থ সঞ্চয় করতে পারে না। মাসের হিসেবে এই টাকা খুবই সামান্য। জমি পরিশ্রমী যেমন মহাজনেরা লাভ করতে পারে না, তেমন শরীর পরিশ্রমী কৃষকরাও লাভ করতে পারছে না। পর্যাপ্ত অর্থ হাতে না থাকার ফলে সারাজীবন তাদের টানাটানি ও ধার দেনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। বেশির ভাগ কৃষক দাদন ব্যবসায়ীদের খপ্পড়ে পড়ে সমস্ত লাভ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায় প্রথম সপ্তাহে। আর এবার করোনা ভাইরাসের কারণে কৃষক উৎপাদিত সবজির নায্যমূল্য পাননি তবে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলাসহ কয়েকটি স্থানে ত্রানের সাথে সবজি বিতরণ করায় কৃষকগণ কিছুটা আর্থিকভাবে উপকৃত হয়েছেন।
তারপরও তারা পুনরায় আশায় বুক বাঁধে। জমিতে হাল দেয় বাংলার সোনার কৃষক বাংলার মাটিতে সোনার ফসল ফলায়। ঝড় ঝঞ্ঝা শীলাবৃষ্টি জাতিয় প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্ট হলেও তাদের মনবল নষ্ট হয়না। তারা হচ্ছে সোনার বাংলার সত্যিকারের সোনার মানুষ, দেশের আসল নাগরিক। তবুও প্রতিবার লোকসানের বোঝা বইতে থাকলেও এবার বাম্পার ফলন ও ধানের নায্যমূল্য পাওয়ায় কৃষক ভাইয়েরা এখন ধান আবাদে আগ্রহ ফিরে পাচ্ছেন। এদিকে আমলারা অনেকটা না বুঝেই কারণটা রাইসমিল মালিকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে। চাপটা এমন লাভ করতে না পারলেও যেন জমি জায়গা বিক্রি করে তাদের ব্যবসা করতে হবে। তবুও আসল ঘটনা হচ্ছে অসময়ে দেশে মোটা চালের আমদানির অনুমোদন। সেই সময়ে দেশে পর্যাপ্ত ধানের ফলন থাকার পরও চাল আমদানি হয়। আমদানিকৃত চালের সাথে প্রতিযোগিতায় দেশীয় রাইসমিল মালিকরা মার খাচ্ছে। বাজারে চালের পর্যাপ্ত সরবরাহ তারা ধান কিনছে না। কিনলে সে ধান ছাঁটাই করে বাজারে বিক্রি করতে পারছে না। লাভ না করতে পারলে কি কারণে তারা বাজারে নামবে, এতে করে বাড়ছে তাদের ঋণের বোঝা যা মিল বিক্রি করেও পরিশোধ সাধন সম্ভব নয়। এই সুযোগে সামান্য মধ্যসত্ত্বভোগী ব্যবসায়ী বা দালাল, সিন্ডিকেট, প্রভাবশালী মন্দ রাজনীতিবিদ, নেতা পাতিনেতা, বর্ণিত সাংবাদিক, মাদক সম্রাটরেরা খাদ্য জিনিস গুদাম গুলি ভর্তি নালিশ দীর্ঘদিনের। শুধু ধান নয় গমের মৌসুমেও এ শক্তিশালী প্রভাবশালী সিন্ডিকেট নিন্মমানের গম আমদানি বা কেনা করে রাতারাতি খাদ্যগুদাম ভর্তি করার ব্যপক নালিশ রয়েছে। তারা দিনে দিনে আঙুল ফুলে কলাগাছ তার পর বটবৃক্ষ হয়েছেন, বে-আইনী টাকার পাহাড় গড়েছেন। ধরাকে সারা করছেন না। হাট থেকে অল্প দামে ধান কিনে মজুদ করছে এবং খাদ্য জিনিস নিয়ন্ত্রকদের যোগসাজসে খাদ্য জিনিস গুদাম গুলি ধান দিয়ে ভর্তি করেছেন এবং প্রকৃত কৃষকেরা ধান গম গুদামে বিক্রি সাধন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। পরে তারা বিভিন্ন রাইসমিলে ব্যবসায়ীক সুবিধা নিয়ে উচ্চমূল্যে সরবরাহ করছে। প্রভাবশালীদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে দালালরা ও সিন্ডিকেট সদস্যরা লাভবান হচ্ছে অথচ কৃষক ও মিলার দুপক্ষই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। সরকারি হিসেবে দেশের মানুষের মাথাপিছু উপার্জন হিসেব করলে দেখা যাবে কৃষককরা বছরে সমপরিমান টাকা লোকসানে আছে। বাংলাদেশে যে কটা সুগার মিল রয়েছে সেগুলোর জমিগুলো দখলমুক্ত করে আঁখ চাষ করলে, দেশের চিনির চাহিদা মিটবে, চিনি অল্প দামে পাওয়া যাবে, পুনরায় বিদেশেও রপ্তানি সাধন যাবে। প্রয়োজন শুধু একটু আধুনিকায়নের। অথচ সেদিকে কি কারও নজর আছে? দেশের কিছুকিছু জায়গায় এখনও পাট চাষ হয়। তবে তা এনজিও সংস্থা গুলোর শোরুমের পণ্য তৈরির জন্য, এনজিও গুলোর নিজস্ব তত্ত্বাবধানে। বাড়তি প্রয়োজন মেটাতে তারা বিদেশ থেকে পাট আমদানি করছে। তবুও দেশের পাট গবেষণা চাষ বৃদ্ধির দিকে পাট কর্তৃপক্ষের কোন নজরদারি নেই। নানা সমস্যার কারণে পাট, আঁখ, উৎপাদন এখন বহু সমস্যায় জর্জরিত। সার পানির খরচের চেয়েও বড় সমস্যা হচ্ছে অসময়ে চাল আমদানি। বেশী জমির মালিকগন জমিতে মাল্টা, ড্রাগন, আম, লিচু, কাঠাল, পিয়ারা গাছ লাগাতে শুরু করেছে। উত্তরাঞ্চলের বহু জায়গায় স্থানীয়রা এখন তাই করছে। এই পরিস্থিতি থাকলে একটা সময় এমন আসবে, যখন দেশ খাদ্য জিনিস সংকটে পড়বে। উদ্দেশ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক অর্থ উপার্জনের মত দেশে কোন সামান্য অবশিষ্ট থাকবে না। কৃষি বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে এ উক্তি স্মরন করে সময় থাকতে বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ গ্রহন করে হবে বর্তমান সরকারকে।