খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি ও মুখরোচক করার অন্যতম উপাদান হচ্ছে মসলা। কিন্তু দেশে চাহিদা অনুযায়ী মসলা উৎপাদন না হওয়ায় বিদেশ থেকে আমদানি করে ঘাটতি মেটাতে হয়। আর দিন দিন দেশে মসলার চাহিদা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার এবার মসলা আমদানি কমিয়ে দেশেই উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে। ওই লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় বিভিন্ন ধরনের মসলা উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছে। দেশে মসলার চাষাবাদ বাড়াতে ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। আর দেশে মসলার উৎপাদন বাড়লে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আমদানিও কমে যাবে। তাতে দেশের অর্থও সাশ্রয় হবে। কৃষি মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা কমিশন সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) দেশে মসলার উৎপাদন বাড়াতে ইতিমধ্যেই ‘মানসম্মত মসলা বীজ উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও বিতরণ’ নামের একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্পটির জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। যার পুরোটাই সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় হবে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারির মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। মানসম্মত বীজ উৎপাদন ও বিতরণের মাধ্যমে মসলা উৎপাদন বাড়ানো হবে।
সূত্র জানায়, কৃষি পণ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ মসলা। দেশে দিন দিন জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে ক্রমেই কমে যাচ্ছে খাদ্যশস্যের জমি। এমন অবস্থায় চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে খাদ্যশস্য চাষের আওতায় মসলার জমি চলে এসেছে। তাতে ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে মসলার উৎপাদন। ফলে চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে মসলা আমদানি করে ঘাটতি পূরণ করতে হচ্ছে। পাশাপাশি দেশের কৃষকের মধ্যেও মসলা উৎপাদনে আগ্রহ কমে গেছে। কারণ কৃষকের তুলনামূলক লাভজনক শস্য করার দিকেই ঝোঁক থাকে। প্রধান শস্য উৎপাদনের ফাঁকে উত্তরাঞ্চলে ব্যাপকভাবে মরিচ ও পেঁয়াজ, আদা চাষ হয়। খোদ রাজধানীর বিভিন্ন বাসার ছাদে উৎপাদন হয় মরিচ। তবে তা বাণিজ্যিক না হলেও দেশের অনেক জায়গায় নানা ধরনের মসলার বাণিজ্যিক উৎপাদন হচ্ছে। দৈনন্দিন খাবারে মসলা একটি অন্যতম প্রধান উপাদান। দেশে ৩০ প্রকার মসলা উৎপাদিত হয়। তার সঙ্গে জিরা, এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, জয়ফল, পেস্তাবাদাম ইত্যাদি বেশকিছু মসলা বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে বছরে মসলার চাহিদা প্রায় ৩৩ লাখ মেট্রিক টন। তারমধ্যে সংরক্ষণজনিত ক্ষতিতে ঘাটতি প্রায় ১২-১৩ লাখ মে. টন।
সূত্র আরো জানায়, এদেশের মাটি ও আবহাওয়া মসলা উৎপাদনের জন্য বেশ উপযোগী। বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মসলা গবেষণা কেন্দ্র থেকে ইতিমধ্যে ১৯ প্রকার মসলার ৩৮টি জাত অবমুক্ত করা হয়েছে। এর আগে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ ও মরিচ উৎপাদন বৃদ্ধির সমন্বিত প্রকল্প শিরোনামে একটি প্রকল্প ১৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০০৭ সালের জুলাই থেকে ২০১০ সালের জুনের মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সংস্থা ডিএই, বারি, এআইএস ও বিএডিসি বাস্তবায়ন করেছে। আর নতুন প্রকল্পটি দেশের ৫টি বিভাগের ১৫টি জেলার ১৪টি উপজেলা এবং চারটি সিটি কর্পোরেশনে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভিন্ন জাতের ১ হাজার টন মানসম্মত মসলা বীজ উৎপাদন করা। মসলা বীজ ও চারা কলম সহজলভ্য করা এবং পর্যায়ক্রমে মসলার আমদানি ব্যয় ৭.১২ শতাংশ হ্রাসের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করা। মসলা বীজ উৎপাদনকারী চুক্তিবদ্ধ কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সক্ষমতা অর্জন ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা হবে। জোরদার করা হবে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বছরব্যাপী মসলার চারা/কলম উৎপাদন বিতরণ এবং বিক্রয়। উৎপাদিত ১ হাজার মেট্রিক টন বীজ ব্যবহার করে ১৪ হাজার ১৩৪ হেক্টর জমিতে মসলা চাষ করা যাবে। যার মাধ্যমে ১ লাখ ২৭ হাজার ৩১৬ মেট্রিক টন মসলা উৎপাদন করা সম্ভব হবে। মসলা চাষে ধানের চেয়ে হেক্টর প্রতি ৫ থেকে ২৭ গুণ বেশি মুনাফা করা সম্ভব। পাশাপাশি প্রতি বছর যে প্রচুর পরিমাণ মসলা বিদেশে থেকে আমদানি করতে হয়, মসলা চাষ বাড়ানোর মাধ্যমে ওসব বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব হবে।
এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে গত ২০ বছরে মসলার উৎপাদন ৮ গুণ বাড়লেও তার সঙ্গে পাল্লা মসলার চাহিদাও বেড়েছে। দেশে সারাবছর ব্যবহৃত মসলার ৬০ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। বাকি ৪০ শতাংশ মসলা আমদানি করতে হয়। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলায় ১৯৯৫ সালে বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ মসলা কেন্দ্রটি নানা গবেষণার মাধ্যমে সফলতার মুখ দেখতে পাচ্ছে। ওই গবেষণা কেন্দ্রে জাতের উন্নয়ন, উদ্যানতত্ত্ব, কীটতত্ত্ব, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, উদ্ভিদ প্রজনন, বিভিন্ন মসলা ফসলের ফিজিওলজি, ব্রিডিং পদ্ধতি, জৈব প্রযুক্তি, উদ্ভিদ পুষ্টি, বীজ উৎপাদন, রোগ ও পোকা মাকড় দমন, শস্য সংগ্রহের ব্যবস্থাপনা ও বাজার পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ের ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। গবেষণার ফলাফল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাধ্যমে কৃষকের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হয়। আর গবেষণায় তৈরি জাত বা বীজ বিএডিসির কাছে হস্তান্তর করা হয়।