করোনা পরিস্থিতিতে দুর্নীতিগ্রস্থ পাপুলদের গ্রেফতারের সংবাদও অভূক্তদের কাছে আশার খবর হয়ে আসতে পারেনি। মানুষ দেশের করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের সমন্বয়হীনতার রাস্তায় অগ্রসর হওয়া দেখে দেখে খেই হারাচ্ছে। এরই মধ্যদিয়ে দেশব্যাপী ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ছে করেনাভাইরাস। প্রতিদিনই আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ আক্রান্ত হলেও রাজনৈতিক নেতা ও সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা করোনার উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন। অবশ্য ইতিমধ্যে দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর খবর রাজপথে তৈরি করেছে হতাশা আর বেদনার রেশ। আমার রাজপথে থাকার দীর্ঘ ২৫ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি- অতিতেও অথর্ব রাজনীতিকরা যে কোন দুঃসময়ে নিজেদেরকে গুটিয়ে বাসায় বন্দী করে রাখে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বিএনপির ৮৫ ভাগ, আওয়ামী লীগের ৭৫ ভাগ, সমাজতান্ত্রিকদের বিভিন্ন দলের ৯৮ ভাগ, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ৯৯.৫ ভাগ ঘরে বসে বসে শুরু করেছে অনলাইন কনফারেন্স। অথচ বাংলাদেশে স্বাধীনতার ৪৯ বছরে ক্ষমতায় আসার জন্য এরাই সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলো। গণবান্ধব না হওয়ায় আজ জাতির ক্রান্তি লগ্নে নিরন্ন মানুষের পাশে এরা তো নেই-ই; বাড়ি ভাড়া দিতে না পারা ব্যবসা ও চাকুরি হারা মানুষগুলোর জন্যও তাদের কোন কথা আমরা শুনিনি। তবে ভর্তুকি দিয়ে থানা থেকে তথ্য নিয়ে সরকারি চাকুরীজীবী ব্যতিত সকল মধ্যবিত্ত-নিন্মবিত্ত বাড়িওয়ালাকে ২০ হাজার ও ভাড়াটিয়াকে ১০ হাজার টাকা প্রদান করে বাড়ি ভাড়া সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করে লকডাউনের দাবীতে আমরণ অনশনে নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি ছিলো বলে সারাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এমন নিবেদন নতুনধারার রাজনীতিকদেরকে করেছে ছাত্র-যুব-জনতার জন্য নিবেদিত থাকার রাজনৈতিক উদাহরণ। অনশনের পাশাপাশি স্মারকলিপি প্রদান করেছে নতুনধারা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে প্রদানকৃত স্মারকলিপির কোন জবাব বাঙালি এখনো পায়নি, পায়নি রোডমার্চ করে রাজপথে থাকার পরও নিজেদেরকে করোনা পরিস্থিতিতে বাঁচানোর কোন পথ। যা পেয়েছে, তা হলো লকডাউন, নির্মম মৃত্যুর ইশারা।
অবশ্য স্বভাবজাতভাবে বরাবরের মত উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাঁপিয়ে দেয়ার মত করে রাজনীতিকদের অধিকাংশই বাজার করতে গিয়ে, শপিং মলে গিয়ে, জানাযায়(ফরজে কেফায়া, একটি এলঅকার পক্ষ থেকে একজন আদায় করলেই হয়) গিয়ে, আড্ডা দিয়ে করোনা আক্রান্ত হয়ে এখন বলে বেড়াচ্ছে যে, কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গেলে তারা শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করতে পারেন না। তাদের কেউ লাশ দাফন, কেউবা ত্রাণ বিতরণ, আবার কেউ দলীয় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত নেতাদের বেশির ভাগই বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অনেকে হাসপাতালেও ভর্তি আছেন। দেশে করোনাভাইরাস শুরু হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বেশিরভাগ কর্মসূচিতেই শারীরিক দূরত্ব মানা হয়নি। স্বাস্থ্যবিধিরও বালাই ছিল না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় বা নগর নেতাদের কেউ কেউ কোনো প্রোগ্রামে গেলেই তাদের ঘিরে ধরে কর্মীরা। সেলফি বা টিভি ক্যামেরায় নেতার সঙ্গে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে ধাক্কাধাক্কি করে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করেন সবাই। এসব ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই দেখা যায়নি।
এক্ষেত্রে অবশ্যই ভাবনার বিষয় এই যে, জাতি যখন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, তখন করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৪ দলের মুখপাত্র ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সদস্য বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, পাবনা-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বিএনপি নেতা সাইফুল আলম সুজা, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর পূর্ব মাদারবাড়ি ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী এবং করোনার কারণে স্থগিত হয়ে যাওয়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলরপ্রার্থী মো. হোসেন মুরাদ। এছাড়া শ্রীমঙ্গল পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল আহাদ, কবিরহাট পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনোয়ার হোসেন ও কালিয়াকৈর পৌরসভার ৭, ৮, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাজেরা বেগম করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। যাদের অধিকাংশ স্টে হোম-এ থাকার পরও মাঝে সাঝে বাজারে- শপিং মলে এবং বাসায় আয়েশি আড্ডার খবর গণমাধ্যমে দেখেছি।
গণমাধ্যম বলছে- আরও দুজন মন্ত্রী, ৭ জন এমপি, দেশের বিভিন্ন সিটি করপোরেশ ও পৌরসভার বেশ কয়েকজন মেয়র-কাউন্সিলর ও রাজনৈতিক নেতা করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন। করোনা আক্রান্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক ও তার স্ত্রী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং ঢাকার সিএমএইচ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। যশোর-৪ আসনের সাংসদ রণজিৎ কুমার রায়, চট্টগ্রাম-৮ আসনের মোসলেম উদ্দিন, চট্টগ্রাম-১৬ আসনের মোস্তাফিজুর রহমান, জামালপুর-২ আসনের ফরিদুল হক খান দুলাল ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনের এবাদুল করিম বুলবুল করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন। তাছাড়া আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম নাদেল, চট্টগ্রাম-৬ আসনের সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী ও নওগাঁ-২ আসনের শহীদুজ্জামান সরকারও করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন। তারা এখন সুস্থ হয়েছেন বলে জানা গেছে। সিলেট সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র বিএনপি নেতা আরিফুল হক ও তার স্ত্রী শ্যামা হক চৌধুরী এবং একই সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা আজাদুর রহমান আজাদ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। কুমিল্লা সদর উপজেলার চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম টুটুল ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কাজী মাহাবুব, যুবলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও নরসিংদীর শিবপুর এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য সিরাজুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (এনসিসি) ৪, ৫ ও ৬নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত কাউন্সিলর মনোয়ারা বেগম করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির নেতা নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ শুরু থেকে করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের লাশ দাফন করে ব্যাপক আলোচনায় আসেন। সমমনা ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে তিনি করোনায় মারা যাওয়া ৪৯ জনের লাশ দাফন করেন। এরপর তিনি ও তার স্ত্রী আফরোজা খন্দকার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। গফরগাঁও পৌরসভার মেয়র এস এম ইকবাল হোসেন সুমন, পটুয়াখালী পৌরসভার মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ, দাউদকান্দি পৌরসভার মেয়র নাইম ইউসুফ, কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান, চান্দনাইশ পৌরসভার মেয়র মুহাম্মদ মাহবুবুল আলম, চৌদ্দগ্রাম পৌরসভার মেয়র মো. মিজানুর রহমান, ভেড়ামারা পৌরসভার মেয়র শামীমুল ইসলাম সামা ও মীরকাদিম পৌরসভার মেয়র শহিদুল ইসলাম শাহীন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। করোনা আক্রান্ত পৌর মেয়রদের প্রত্যেকেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
হুজুগে বাঙালি হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে আমাদের। তারই সর্বশেষ উদাহরণ হলো- করোনা পরিস্থিতিতে আমাদের ফেরিতে করে ঢাকায় অঅসা অথবা বাড়ি যাওয়া। হয়তো এসব কারণেই আজ ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের পর করোনার অন্যতম হটস্পট শিল্প এলাকা গাজীপুর। এরই মধ্যে জেলার সবকটি উপজেলাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর ইতিমধ্যে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। তবে অন্য সহকর্মীরা ভয়ে কাছে আসবেন না ভেবে তা প্রকাশ না করে নিজেরাই আইসোলেশনে চলে গেছেন।
তবু বাংলাদেশকে করোনা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য, নিরন্ন মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয়ার জন্য নিবেদিত রাজনীতিকদেরকে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই মাঠে থাকতে হবে। এ মুহূর্তে তারা যেমন একেবারে ঘরে বসে থাকতে পারবেন না, তেমনি নিজেদের নিরাপত্তার কথাও তাদের ভাবতে হবে। করোনার মতো দুর্যোগে রাজনীতিবিদদের ঘরে বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। তাদের অবশ্যই মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। তবে সেক্ষেত্রে নিজের ও পরিবারের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। একই সাথে প্রতিহত করতে হবে দুর্নীতি। কেননা, করোনা মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত তথাকথিত পদক্ষেপে আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ত্রিমুখী আঁতাতের মাধ্যমে দুর্নীতি হয়েছে। আর দুর্যোগের সময় দুর্নীতিকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। দুটি ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে সরকারের ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে একদিকে যেমন দলীয় বিবেচনায় তালিকা হয়েছে, তেমনি চুরি, আত্মসাৎ ও প্রতারণা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে রাজনীতিতে যারা প্রভাবশালী তারা এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ৯০ জন জনপ্রতিনিধিকে নামমাত্র সাময়িক বরখাস্ত করে তাদের আরও উৎসাহিত করা হয়েছে। এদের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন। এছাড়া স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ছেলে ও সাবেক স্বাস্থ্যসচিবের মাধ্যমে এন-৯৫ মাস্কসহ সুরক্ষাসামগ্রী ক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। ক্রয়ের নীতিমালা বাস্তবায়িত হয়নি। উপরন্তু ৫ থেকে ১০ শতাংশ বেশি হারে ক্রয়মূল্য প্রস্তাব করা হয়েছে। এন-৯৫ মাস্ক কেলেঙ্কারির তদন্ত প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়নি। এই দুর্নীতিতে আমলাদের একটা অংশ জড়িত। মূলত ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিতে প্রভাবশালীরা মিলে ত্রিমুখী আঁতাতের মাধ্যমে দুর্নীতি করা হয়েছে। শাস্তি হিসেবে কাউকে বদলি বা বরখাস্ত করে দুর্নীতিকে আরও উৎসাহিত করা হয়েছে। দুর্যোগের সময় যারা দুর্নীতিতে জড়িত তাদের তো জনপ্রতিনিধিত্ব করার অধিকার স্থায়ীভাবে হরণ করা উচিত। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তবেই দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আসুন না নতুন প্রজন্মের প্রকৃত প্রতিনিধিদের পাশাপাশি সবাই ঘুরে দাঁড়াই। কথা বলি সাহসের সাথে। তাহলে অন্তত বায়ান্ন ভাষা শহীদ, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ এবং নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শহীদগণ শান্তি পাবেন...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি