ছেলেটির বয়স মাত্র ৬-৭ বছর। সেই বয়সে তাঁর মা মৃত্যুবরণ করেন। একান্নবর্তী পরিবারে বাস হওয়ায় বাবা তাকে গ্রামে না রেখে পাঠিয়ে দিলেন নিঃসন্তান ফুফুর কাছে কলকাতায়। সেখানে শিশু বিদ্যাপীঠে পড়ালেখা শুরু করেন তিনি। এখানে এসে তিনি বেড়ে উঠতে লাগলেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের এক বিভীষিকাময় দুর্যোগের মধ্যে। জাপানী বোমার শব্দের ভয়ে সেই কিশোর শিশু বিদ্যাপীঠে গেছেন কানে তুলো দিয়ে। এই ছেলেটিই পড়ে রাজপথে-কাজপথে তৈরি করেন নিজস্ব অবস্থান; নির্মাণ করেন নিবেদিত থাকার পথ। আর সেই পথ ধরে এগিয়ে যেতে যেতে দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে তিনি পাবনা চলে যান। ভর্তি হন পাবনা জিলা স্কুলে। ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। এরপর ভর্তি হন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। থাকেন ছোট কাকা শিক্ষাবিদ ও লেখক তাসাদ্দুক হোসেন খান লোহানীর কাছে। এই কলেজ থেকেই উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন তিনি। আর উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি টানেন কামাল লোহানী।
সংবাদমাধ্যমে-সাংস্কৃতিক অঙ্গণে সাহসের সাথে তিনি এগিয়ে চলেন নিরন্তর। তারই সূত্রতায় টানা সাড়ে তিন মাস বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কারাগারে একই সেলে কাটিয়েছিলেন নির্মল মনের সাহসী মানুষ সাংবাদিক কামাল লোহানী। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় থেকে অসংখ্যবার বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে এসেছেন। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন রেডিও কমেন্টি করেছেন তিনি। কলকাতা সংবর্ধনা সভায়ও তিনি কমেন্টি করেছেন। সংবাদ সংগ্রহের কাজে বঙ্গবন্ধুকে অনুসরন করেছেন ছায়ার মত।
তাঁর নিজের মুখে বলা সেই ইতিহাস হলো- ‘১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে আমি কর্মী ছিলাম। তখন বঙ্গবন্ধু পাবনায় নির্বাচনী প্রচারে যেতেন ও আমাকে কর্মী হিসেবে চিনতেন। তবে সরাসরি সান্নিধ্যে আসি ১৯৬২ সালে। এ বছর আমি গ্রেফতার হয়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে যাই। আমাকে পাঠানো হয় ২৬ নাম্বার সেলে। সেই সেলে বঙ্গবন্ধু ছিলেন। সেলে ঢুকতেই একটি দরাজ কন্ঠ বলে উঠল, দআয় আয় এখন থেকে আমাদের সঙ্গে বাস করতে হবে। এ দরাজ কন্ঠটিই বঙ্গবন্ধু। আমার ওই বয়সে জেল খানায় হঠাৎ করে জেল খানায় গিয়ে এমন আন্তরিক সান্নিধ্য আমার মনোবল বাড়িয়ে দেয়। এরপর সাড়ে তিন মাস আমরা একসঙ্গে ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটা কথা আমার জন্য যেমন শিক্ষণীয়, প্রতিটা আচরণ ছিল আমার জন্য বিস্ময়কর।
জেলখানায় দীর্ঘদিন ধরে বন্দী ছিলেন রণেশ দাস গুপ্ত। বামপন্থী নেতা। বঙ্গবন্ধু তাঁকে যে কী পরিমাণ শ্রদ্ধা করতেন তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। জেলখানায় এমন অনেক পুরনো কারাবন্দী ছিল যারা পনের বিশ বছর ধরে জেল খাটছিল। আমি খেয়াল করে দেখলাম, জেলখানায় নেতৃত্ব বা প্রভাব খাটানোর কোন ইচ্ছা বঙ্গবন্ধুর ছিল না। সবাইকে সহবন্দী হিসেবে ট্রিট করতেন। আমাদের একই সেলে তাজউদ্দিন ছিলেন, আবুল মনসুর আহমেদ (ডেইলী স্টার সম্পাদক মাহফুয আনাম এর বাবা) ছিলেন, কফিল উদ্দিন চৌধুরী ছিলেন, ইত্তেফাক- এর তোফাজ্জেল হোসেন মানিক মিয়া ছিলেন, কোরবান আলী ছিলেন। ছাত্রনেতাদের মধ্যে শাহ মোয়াজ্জেম, শেখ ফজলুল হক মণি, হায়দার আকবর খান রনো, শ্রমিক নেতাদের মধ্যে নাসিম আলী ছিলেন। আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতানৈক্য ছিল। কিন্তু আমরা সবাই একটা বিষয়ে একমত ছিলাম। তা হলো আমাদের শত্রু এক।
বঙ্গবন্ধুকে আমি লিডারদ সম্বোধন করতাম। বঙ্গবন্ধু বললেন, তুই আমাকে লিডার ডাকবি না। আমি জানি তোর লিডার কে। কারণ, তিনি জানতেন, রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে আমি তাঁর অনুসারী নই। আমি গোঁ ধরে তাঁকে লিডার ডেকেছি সব সময়। আমরা বিকেলে ভলিভল খেলতাম। আপনারা জানেন, বঙ্গবন্ধু টুঙ্গীপাড়ায় ভাল ফুটবল খেলতেন। কিন্তু কারাগারে দেখেছি তিনি ভাল ভলিবলও খেলেন। তাঁর শারীরিক উচ্চতার কারণেই তিনি ভাল খেলতেন। আমরা দুটো দলে ভাগ হয়ে খেলতাম। একটা দলে ক্যাপ্টেন ছিলাম আমি। বঙ্গবন্ধু আমাকে ক্যাপ্টেন বানিয়ে তিনি আমার দলে খেলতেন। খেলার মাঠে তিনি খেলোয়াড়। অন্য কিছু তখন তার মাথায় আসতো না। একে একে সবাই জামিন নিয়ে বের হয়ে গেল। শুধু বঙ্গবন্ধু, আমি ও রনেশ দা রয়ে গেলাম। আমার রিলিজ অর্ডার যখন আসল, তিনি তখন বললেন, তুইও চলে যাবি? আমি তখন তাঁকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলি। কারাগারে একটা জিনিস খেয়াল করেছি। সেটা হলো জেলার থেকে শুরু করে বাইরের সবাই বঙ্গবন্ধুর প্রতি একটা গোপন আনুগত্য দেখায়। গোপন একটা শ্রদ্ধা সবাই লালন করে।’
এমন শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে এগিয়েছিলেন আজন্মকাল। লোভ মোহহীন নিবেদিত দেশ-সংবাদ ও সংস্কৃতিপ্রেমিক কামাল লোহানীর জীবনকথা বললে অবাক হওয়আ ব্যতিত আর কিছুই থাকবে না। কেননা, তিনি সারাজীবন দেশের জন্য-মানুষের জন্য-নিরন্ন মানুষের মুখে খাবার তুলে দেবার জন্য কাজ করেছেন-সংগঠন করেছেন- লেখালেখি করেছেন।
আজন্মকালের সংগ্রামী মানুষটির পরিবারের বসতি ছিল যমুনা পাড়ে। আগ্রাসী যমুনা-গর্ভে তাদের বাড়িঘর জমি-জিরেত চলে যাওয়ার পর তারা সিরাজগঞ্জেরই উল্লাপাড়া থানার খান সনতলা গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। আর এই সনতলা গ্রামেই ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন কামাল লোহানী জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মুসা খান লোহানী। মা রোকেয়া খান লোহানী।
যুদ্ধজীবনে তিনি কয়েকবার কারাবরণও করেছেন। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হওয়ার পর যখন কলেজ নির্বাচন এগিয়ে এলো তখন কামাল লোহানীসহ আরো ক'জন সমমনা একজোট হয়ে জোট বাঁধলেন, নাম দিলেন ‘পাইওনিয়ার্স ফ্রন্ট’। লড়লেন নির্বাচনে এবং নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করলেন। এই ফ্রন্টের সদস্যরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর গড়ে ওঠা প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। এছাড়া তারা রাজনৈতিক সংগ্রাম ছাড়াও সেইসময় সাংস্কৃতিক কাজে বেশ সক্রিয় ছিলেন। সুতরাং কামাল লোহানীও এ থেকে বাইরে রইলেন না। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনে সক্রিয় ভূমিকা নিতে থাকলেন। উপস্থাপনা, গ্রন্থনা এবং আবৃত্তিতে পাঠ নিলেন তিনি। তারও অনেক পরের কথা। ১৯৫৩ সালে পাবনার তৎকালীন জিন্নাহ্ পার্কে (বর্তমান স্টেডিয়াম) মুসলিম লীগ কাউন্সিল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এইখানে যোগদানের জন্য আসেন তৎকালীন পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সর্দার আব্দুর রব নিশতার, কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতা খান আব্দুল কাউয়ুম খান, প্রাদেশিক লীগ নেতা মোহাম্মদ আফজাল প্রমুখ। ছাত্র হত্যাকারী নূরুল আমিনের পাবনা আগমন ও মুসলিম লীগ সম্মেলনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করায় কামাল লোহানী পাবনার রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং এডওয়ার্ড কলেজের অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীদের সাথে প্রথম গ্রেফতার হন।
সূর্যসেনের রাজনৈতিক দর্শনে নিরন্তর তিনি নির্ভিক ১৯৫৪ সালের মার্চে পূর্ববাংলায় অনুষ্ঠিত হয় প্রাদেশিক নির্বাচন। কামাল লোহানী তথা সকল প্রগতিশীল ছাত্ররাই যুক্তফ্রন্টের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাবনা টাউন হলে মহান শহীদ দিবস উপলক্ষে গণজমায়েত এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিপুল জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে তৎকালীন সরকার তটস্থ হয়ে পরদিন গ্রেফতার শুরু করে। ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে কামাল লোহানী গ্রেফতার হন। এবং যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয়ে নির্বাচনের পর মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু মার্কিনী মদদপুষ্ট পাকিস্তান সরকার এই বিজয়কে গ্রহণ করেনি। এবং শঙ্কিত হয়ে ১৯৫৪ সালের ২৯ মে ৯২-(ক) ধারার মাধ্যমে পূর্ববাংলায় ‘গভর্নরী শাসন’ চালু করে। মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা পূর্ববাংলায় গভর্নর হয়ে আসে এবং ব্যাপক ধরপাকড়ের নির্দেশ দেন।
একবার রাজশাহী কারাগার থেকে মুক্তির পর কামাল লোহানী ফিরে এলেন পাবনায়। কিন্তু অভিভাবকদের সাথে তার শুরু হলো রাজনীতি নিয়ে মতবিরোধ। অভিভাবকরা চাইছিলেন লেখাপড়া শেষে রাজনীতি করো, আপত্তি নেই। কিন্তু কামাল লোহানী তখন রীতিমত রাজনীতি প্রভাবিত এবং মার্কসবাদের অনুসারী। চোখে তার বিপ্লবের ঐশ্বর্য। আর তাই উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি টানেন কামাল লোহানী। ছোট চাচা শিক্ষাবিদ তাসাদ্দুক লোহানীর কাছ থেকে মাত্র ১৫ টাকা চেয়ে নিয়ে অনিশ্চিতের পথে ঢাকা অভিমুখে পা বাড়ান কামাল লোহানী। জীবনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করলেন। আর সেই সঙ্গে শুরু হল তার নিজের পায়ে দাঁড়াবার সংগ্রাম। ইতিহাস বলে- ১৯৫৫ সালে তিনি ন্যাপ-এ যোগ দেন এবং জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হন। কিন্তু ১৯৫৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে দেশ বিপন্ন হলে, কামাল লোহানী আত্মগোপন করতে বাধ্য হন।
১৯৬২ সালেও কামাল লোহানী কিছুদিনের জন্য কারাগারে বন্দী ছিলেন। ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গর্জে উঠলো। কামাল লোহানীর নামে জারি হল হুলিয়া। ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি গ্রেফতার হলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। পরিস্থিতি আরও সংকটাপন্ন হল। ১৩ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে গ্রেফতার হলেন তিনি। এই সময় ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ২৬ নম্বর সেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমদ, আবুল মনসুর আহমেদ, হায়দার আকবর খান রনো, অধ্যাপক রফিকুল ইসলামসহ অনেকেই একসাথে ছিলেন বলে আমাদের বীরত্বময় ইতিহাস স্বীকৃতি দেয়। অবশ্য তারও কিছুটা আগে ১৯৬০ সালে কামাল লোহানী বিয়ে করেছিলেন তারই চাচাতো বোন দীপ্তি লোহানীকে। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যয়নকালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী এবং আন্দোলনের সাথী ছিল স্ত্রী দীপ্তি লোহানী। তাঁর এক ছেলে ও দুই মেয়ে। তারা হলেন-সাগর লোহানী, বন্যা লোহানী, ঊর্মি লোহানী। প্রত্যেকেই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট। পুত্র সাগর লোহানী পেশায় সাংবাদিকতা এবং চিত্র নির্মাণের সাথে যুক্ত। জ্যেষ্ঠ কন্যা বন্যা লোহানী চাকুরীর পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করছেন। কনিষ্ঠ কন্যা ঊর্মি লোহানী অনলাইন আর্কাইভ গুণীজন ডট কম পরিচালনায় সম্পৃক্ত ।
সংগ্রামের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাওয়া মানুষটি রুটি-রুজীর জন্য তার চাচাতো ভাই ফজলে লোহানীর সহযোগিতায় দৈনিক 'মিল্লাত' পত্রিকায় ৮০ টাকা বেতনে সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলেন। হাতেখড়ি হল সাংবাদিকতায়। একজন কলম সৈনিক হিসেবে শুরু হলো তার নতুন করে পথচলা। ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দৈনিক 'সংবাদ'-এ সিনিয়র সাব-এডিটর হিসেবে যোগ দিয়ে অল্প দিনেই শিফট-ইন-চার্জ পদে উন্নীত হন। এরপর তিনি ‘পাকিস্তান ফিচার সিন্ডিকেট’-এ যোগ দেন। ১৯৬৭ সালে সিন্ডিকেট প্রায় বন্ধের উপক্রম হলে কামাল লোহানী অবজারভার গ্রুপ অব পাবলিকেশন্সের দৈনিক 'পূর্বদেশ' পত্রিকায় শিফট ইনচার্জ হিসেবে যোগ দেন। পরে চীফ সাব- এডিটর পদে উন্নীত হন। এই সময় তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নে দু'দফায় যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে তিনি পূর্বপাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আর যুদ্ধময় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ- এর পর যতদিন তিনি পূর্ববাংলায় ছিলেন, ততদিন সামরিক শাসকচক্রের নানা দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে তৎপর ছিলেন। এইসময়ে তিনি প্রখ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক 'স্বরাজ' পত্রিকায় কয়েকটি অগ্নিগর্ভ প্রতিবেদন রচনা করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি দায়িত্ব নিলেন ঢাকা বেতারের। দেশ স্বাধীন হলেও প্রশাসনে পরিবর্তন আসেনি বলে অনেকটা নীরব প্রতিবাদেই ট্রান্সক্রিপশন পরিচালক হিসেবে তিনি বেতার ত্যাগ করেন। ১৯৭৩ সালে ২০ জানুয়ারি পুনরায় সাংবাদিকতায় ফিরে আসেন। যোগ দেন 'দৈনিক জনপদ' নামে একটি নতুন পত্রিকায়। এইসময় তিনি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হন। ১৯৭৪ সালে 'দৈনিক জনপদ' ছেড়ে 'দৈনিক বঙ্গবার্তা' যোগ দান করেন। মওলানা ভাসানী সমর্থিত এ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ফয়েজ আহমেদ। প্রায় তিনমাস পর পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলে কামাল লোহানী 'দৈনিক বাংলার বাণী' পত্রিকার বার্তা সম্পাদক নিযুক্ত হন। এ বছরই তার নেতৃত্বে পুনরায় ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন নির্বাচনে জয়লাভ করেন। সরকার ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন সংবাদপত্র অ্যানালমেন্ট অধ্যাদেশ জারি করে মাত্র চারটি পত্রিকা ছাড়া সব পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। কামাল লোহানী তখন সরকারের দেয়া প্রস্তাবে অস্বীকৃতি জানান। ১৯৭৭ সালে ৬ জানুয়ারি সরকার রাজশাহী থেকে প্রকাশিত 'দৈনিক বার্তা'র নির্বাহী সম্পাদক নিযুক্ত করে ঢাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য করেন তাকে। ১৯৭৮ সালে তাকে সম্পাদক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। সম্পাদক হবার পর জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকা-তে অনুষ্ঠিতব্য কমনওয়েলথ রাষ্ট্রপ্রধান সম্মেলনে বাংলাদেশের একজন সম্পাদক হিসেবে প্রেসিডেন্সিয়াল এনট্যুরেজের সদস্য মনোনীত হন। কিন্তু রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের প্রস্তাবনুযায়ী চিরন্তন পরিধেয় পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহার করে স্যুট কোট পরতে অস্বীকার করেন। ১৯৮১ সালে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর সাথে মতবিরোধ হলে 'দৈনিক বার্তা' ছেড়ে 'বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট' এর প্রকাশনা পরিচালক ও 'ডেপথনিউজ বাংলাদেশ'-এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ক'মাস পরেই তিনি পিআইবি'র এসোসিয়েট এডিটর পদে নিযুক্ত হন। ১৯৯১ সালে তিনি শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ষোল মাসের মাথায় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর সাথে মতবিরোধ হওয়ায় তিনি পিআইবিতে ফিরে আসেন। কিন্তু পিআইবি'র মহাপরিচালক তাকে জোরপূর্বক অবসরে পাঠান। এই সময় রাজনৈতিক অভিযাত্রার পাশাপাশি যুক্ত হল সংস্কৃতি সংগ্রাম। চলচ্চিত্রেও দেখা গেছে কামাল লোহানীকে। ঢাকাই প্রথম বাংলা (এফডিসি কেন্দ্রিক) চলচ্চিত্র ফতেহ লোহানী পরিচালিত ‘আসিয়া’ তে কামাল লোহানী মুখোশ নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন তিনি। এরপর এহতেশাম পরিচালিত ‘এদেশ তোমার আমার’ এ তিনি সমবেত নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৯ সালে রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠিত 'রাজশাহী আর্ট কলেজ' এর প্রধান উদ্যোক্তাদের অন্যতম কামাল লোহানী ছিলেন 'রাজশাহী আর্ট কলেজ' এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। কামাল লোহানী ৭২ এর সংবিধান পুণঃপ্রতিষ্ঠা জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যানেরও দায়িত্ব পালন করছেন ।
১৯৮৩ সালে কামাল লোহানী সরাসরি জড়িত হয়ে বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্থা গঠন করেন এবং গণশিল্পী সংস্থার সভাপতি হন। সবকিছুর পাশাপাশি কামাল লোহানী 'আমার বাংলা' নামে শিল্প-সংস্কৃতি গবেষণা ও অনুশীলন চক্র গঠন করেছেন। এছাড়াও তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার পরিষদের উপদেষ্টা, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটেরও উপদেষ্টা। ১৯৬২ সালে স্বল্পকাল কারাবাসের পর কামাল লোহানী 'ছায়ানট' সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সাড়ে চার বছর এই দায়িত্ব পালন করেন। এরপর মার্কসবাদী আদর্শে ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন 'ক্রান্তি'। দুই দফায় তিনি শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। জীবন থেকে বিদায় নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবাদ বিরোধী দক্ষিণ এশীয় সাংস্কৃতিক কনভেনশনের ওয়ার্কিং গ্রুপের কনভেনার, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর নির্বাহী কমিটির সদস্য, ভাষা আন্দোলনের সংগঠন একুশে চেতনা পরিষদ- এর সাধারণ সম্পাদক, মানবাধিকার নাট্য পরিষদের চেয়ারম্যান ও সোমেন চন্দ চর্চা কেন্দ্রের সভাপতি ছিলেন। কামাল লোহানী বাংলা একাডেমিতেও তিনি সাধ্যমত কাজের স্বাক্ষর রেখেছেন।
ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে গণমানুষের মুক্তির জন্য নিরন্তর তিনি-নির্ভিক তিনি নিরন্তর। কামাল লোহানী মানে নির্লোভ-ভয়হীন বিয়ের প্রত্যাশী সাহসী মানুষ। সেই ২০০১ সাল থেকে কাছেকাছে থাকার সুযোগ হয়েছিলো আমার। মনে হয়েছে, ছাত্র জীবন বাদ দিয়ে অবিরত তাঁর সাথে থাকি-মানুষকে ডাকি সাহসের পথে। তবে তিনি নির্মলতার রাস্তায় অগ্রসর হতে হতে বলতেন- জীবনে যেমন সংগ্রামমূখর পর্ব থাকবে, তেমনই থাকবে বিন¤্র মেধার প্রয়োজন। তাই মেধার স্বাক্ষর রাখতে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালিন সময়গুলোতে তিনি অভিভাবকের চেয়েও বেশি ভূমিকা রেখেছেন কেবল প্রেরণা দিয়ে। আজ তাঁর কথা শুধু মনেই পড়ছে না, চোখ দিয়ে ঝরছে বেদনারজল। তিনি ভালো থাকুন, ¯্রষ্টা তাকে ভালো রাখুন নিরন্তর প্রার্থণা নিবেদন...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি