এক মাসেরও অধিক সময় করোনার সাথে লড়াই করে সরাইলে জয়ী হয়েছেন ৬ জন। এদের মধ্যে ৩ জন পুরূষ ও ৩ জন মহিলা। যুদ্ধকালীন সময়ের নানা গল্প তাদের স্মৃতিতে আছে। এবং থাকবে অনন্তকাল। চিকিৎসকের পরামর্শে কাটানো তাদের দৈনন্দিন চলাফেরা ও পরিচ্ছন্নতার গল্প সকলেরই প্রয়োজন। কখনো ভয়। কখনো সাহসিকতা। সব মিলিয়েই লড়েছেন তারা। করেছেন কঠোর পরিশ্রম। স্বীকার করেছেন ত্যাগ। তাদের শেষ কথা একটাই-ভয় পেলে করোনাকে জয় করা কঠিন। করোনা জয়ী ৬ ব্যক্তিকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছেন নির্বাহী কর্মকর্তা এএসএম মোসা ও ইউএইচও ডা: মো. নোমান মিয়াসহ হাসপাতালের নমুনা সংগ্রহকারী টীমের সদস্যরা। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সরাইল উপজেলা কমপ্লেক্সে আনুষ্ঠানিক ভাবে তাদেরকে জানানো হয়েছে শুভেচ্ছা। হাসপাতাল ও আক্রান্ত ব্যক্তিরা জানায়, আক্রান্ত হওয়ার পর অনেকেই ভয় পেয়ে গেছেন। আবার অনেকে সাহসের সাথে স্বাভাবিক ভেবেই লড়াই করেছেন। পিতা মাতা স্বামী শিশু সন্তানকে ফেলে একা জীবন-যাপন করেছেন আইসোলেশনে। কেউ হাসপাতালে। আবার অনেকে বাড়িতেই হোম আইসোলেশনে থেকেছেন। আইসোলেশনে করেছেন স্বাস্থ্য বিধি সহ নানা নিয়ম-কানুন পালনের যুদ্ধ। বাঁচার লড়াইয়ে তাদের কেউই অলসতা করেননি। শাহবাজপুর গ্রামের সৌরভ পাল (৩০)। অল্প কয়েকদিন হয়েছে বিয়ে করেছেন। লাখাই উপজেলায় বাংলাদেশ কৃষিব্যাংক মুড়াকুড়ি শাখায় চাকুরি করেন। গত ১২ মে তাঁর করোনা পজেটিভ ধরা পড়ে। স্বজনরা ভেঙ্গে পড়লেও ঘাবড়ে যাননি সৌরভ পাল। সৌরভ পাল বলেন, আমি জানতাম আমাকে সচেতন হতে হবে। স্বাস্থ্য বিধি মেনে লড়াই চালিয়ে গেলে করোনা কিছুই করতে পারবে না। তাই করেছি। সম্পূর্ণ আলাদা একটি কক্ষে এক মাসেরও অধিক সময় কাটিয়েছে। আমি কখনো ভয় পায়নি। মনে সাহস রেখেছি। চিকিৎসকের পরামর্শ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। ঘুম থেকে ওঠেই হালকা কুসুম গরম পানির ভাব নিয়েছি। নিয়মিত সেই পানি পান করেছি। ঔষধ সেবন করেছি সময়মত। প্রত্যেকদিন পড়নের কাপড় ধৌঁত করেছি। বিছানার ছাদর বালিশ সহ সবকিছু পরিস্কার রেখেছি। একটু পরপর জীবাণুনাশক ছিটিয়েছি। ওয়াশ রূম খুব ভাল করে পরিস্কার রেখেছি। প্রোটিনযুক্ত খাবার বেশী খেয়েছি। প্লেট গ্লাস এ গুলো নিয়মিত সাবান দিয়ে ধৌঁত করেছি। আমার ভেতরে কখনো করোনার কাছে পরাজিত হতে হবে এমন চিন্তা আসেনি। জয়ী আমি হবই। এ মানসিকতা কাজ করেছে। করোনা ভয়ে ভেঙ্গে পড়লে হবে না। করোনায় আক্রান্ত হলে অবশ্যই সাহসের সাথে লড়াই করে যেতে হবে। একই গ্রামের শাহারা বেগম (৫৫)। ৪ ছেলে ও ২ কন্যা সন্তানের জননী তিনি। মাঝে মধ্যে এলাকায় ধাত্রীর কাজ করেন। করোনা জয়ী শাহারা বলেন, আক্রান্তের খবরে ভেঙ্গে পড়েছিলাম। কারণ শুনেছি বয়স্করা করোনার ধাক্কা সামলাতে পারে না। ছেলেরা সাহস দিয়েছে। নিয়ম মেনে ঔষধ খেয়েছি। এক সময় ভয় কেটে গেছে। আজকে খুবই ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে নতুন পৃথিবী পেয়েছি। আরেক যুদ্ধা সরাইল সদরের দেওয়ান হাবলি গ্রামের মোছা. হোসনা খাতুন (৫৪)। তিনি বলেন, করোনার চেয়ে মানুষের সমালোচনায় বেশী ভয় পেয়েছি। একা একটি কক্ষে থেকেছি। সকল নিয়ম সঠিক ভাবে পালন করেছি। সন্তানরা সেবা শু¤্রষা করেছে। একাধিকবার কোরআন খতম করেছি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেছি। এক সময় ভেতরের ভয়টা উধাও হয়ে গেছে। পরে শুধু সময় গুণেছি। আজ ঈদের মত আনন্দ লাগছে। নিজ সরাইল গ্রামের মো. জিতু মিয়া (৫৪) আক্রান্তের খবর পান ২৩ মে। ২৪ মে আক্রান্ত হয়ে পড়েন উনার স্ত্রী লাভলী ইসলাম (৪৮)। এক পরিবারে দুইজন আক্রান্ত হওয়ায় সন্তান সহ অন্যান্য স্বজনরাও ভেঙ্গে পড়েছিলেন। দুজনই চলে যান হোম আইসোলেশনে। স্বাস্থ্য বিধি ও নিয়মের মধ্যে চলে তাদের দিন যাপন। তারা বলেন, চারিদিক থেকে আসা মৃত্যুর খবর আমাদেরকে কাঁপিয়ে তুলত। না জানি কোন সময় আমাদের মৃত্যুটা হয়ে যায়। এমনসব ভাবনা প্রথম দিকে আমাদের কুঁড়ে খেত। সপ্তাহ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর শরীর পাতলা অনুভব হতে লাগল। ভীতিও কাটতে শুরূ করল। তখন সাহস বেড়ে গেল। ভাবলাম এ লড়াইয়ে হারলে চলবে না। জয়ী আমাদের হতেই হবে। স্বাস্থ্য বিধি মেনে নিয়মিত জীবন-যাপন আমাদেরকে সুস্থ্য করে তুলেছে। আমরা চিকিৎসকদের কাছেও ঋণী। একই গ্রামের বাসিন্ধা মো. নূরূজ্জামান (৩০) বলেন, আক্রান্তের খবরে প্রথমে অনেক ভয় পেয়েছি। আর আশপাশের লোকজনের কথা বার্তা ও আচরণে মন আরো বেশী খারাপ হয়েছিল। তবে চিকিৎসকদের আন্তরিকতা ও আমাদের নিয়মানুবর্তিতার কারণে আল্লাহ রহমত করেছেন। আল্লাহর কাছেও আমরা শুকরিয়া জানাই। সকলকে যেন আল্লাহ করোনা ভাইরাস থেকে হেফাজত করেন। সরাইল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ও করোনা নিরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ কমিটির লিডার ডা: আনাস ইবনে মালেক বলেন, দীর্ঘ ৩ মাস ধরে করোনা রোগী সনাক্তের জন্য নমুনা সংগ্রহের কাজ করছি। কাজটি যদিও খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। জীবন বাজি রেখেই করে যাচ্ছি। আবার করোনা রোগীদের সেবাও দিচ্ছি। আজ ৬ জন রোগীকে সম্পূর্ণ করোনামুক্ত ঘোষণা করতে পেরে খুবই ভাল লাগছে। পেছনের সকল কষ্ট আজ ভুলে গেছি। আরো ভাল লাগছে তাদের করোনা জয়ের গল্প শুনে। এ যোদ্ধাদের অনুসরণ অনুকরণ করলে ইনশাল্লাহ করোনা আমাদের কিছু করতে পারবে না।