গ্রামাঞ্চলে প্রবাদ আছে ‘এমনিতেই ঘর পোড়ে, সেই ঘরে আলু পোড়ে’। বিশ্বব্যাপী চলছে এখন নির্মম মহামারি করোনার মধ্যে যুদ্ধ-দুর্নীতি-লুটপাট আর ছলা-কলার রাজনৈতিক-প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের মারপ্যাচ। যেই প্যাচে পরে বাংলাদেশের অর্থনীতিও ধ্বংস হচ্ছে, সাথে সাথে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। এরই মধ্যদিয়ে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ বলে আমেরিকানদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলো। পর্যটকদের দুটি সম্ভাব্য তালিকা হচ্ছে। করোনা নিয়ন্ত্রণের মাত্রার ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের অনুমোদন কিংবা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হবে। বাছাই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গত ১৪ দিনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে লাখে গড় আক্রান্তের যে হিসাব পাওয়া গেছে, তার বেশি হওয়া যাবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে বর্তমানে লাখে ১৬ জন আক্রান্ত হচ্ছেন। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ১০৭, ব্রাজিলে ১৯০ ও রাশিয়ার ৮০ জন। একই সাথে তৈরি হচ্ছে হাজারও সমস্যার জাল। সেই সাথে সুসংবাদের ধারাও অব্যহত রয়েছে।
সুসংবাদের ধারাবাহিকতায় আলো আর ভালোর খবর হলো- বিশ্বে প্রথমবারের মতো শুরু হচ্ছে সম্ভাব্য করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল। চায়না ন্যাশনাল বায়োটেক গ্রুপের (সিএনবিজি) তৈরি এ ভ্যাকসিনের চূড়ান্ত ট্রায়াল হবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। এ বিষয়ে সিএনবিজি ও আমিরাতি গ্রুপ ৪২-এর মধ্যে চুক্তি হয়েছে। চীনের প্রথম কোম্পানি হিসেবে সিএনবিজিই বিদেশে করোনা ভ্যাকসিনের ট্রায়াল শুরু করতে যাচ্ছে। অবশ্য এ ভ্যাকসিনের প্রথম দুই ধাপের পরীক্ষা সফল হয়েছে। তবে চীনে করোনার সংক্রমণ কমে আসায় এবার বিদেশে এর তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা চালানো হচ্ছে।
বাংলাদেশে স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন মানবাধিকার বাংলাদেশ-এর পক্ষ থেকে জনমনে করোনা সংক্রমণ ও লকডাউনের প্রভাব জানতে সমাজের বিভিন্ন আর্থিক স্তর ও নানা পেশার সঙ্গে যুক্ত প্রায় এক হাজার মানুষের ওপর এ সমীক্ষা চালানো হয়। রাজধানী ঢাকা সহ ১০ টি জেলায় ১৮-৬০ বছর বয়সীদের এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কোভিড ও লকডাউনের কারণে যাদের মানসিক স্থিতি বিপর্যস্ত হয়েছে, তাদের একটা বড় অংশই সরকারের পক্ষ থেকে মানসিক-সামাজিক ও আর্থিক সহায়তা পেলে তা কাটিয়ে উঠতে পারবেন। তা না হলে লোভি-লম্পট মন্ত্রীদের কারণে নিঃস্ব হবে বাংলাদেশ। যা আমাদের কারোই কাম্য নয়।
এতক্ষণ তো বিভিন্নভাবে বিশ্ব ও বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলেছি, এখন একটি বিষয় স্পষ্ট করতে চাই; আর তা হলো- যখন করোনাভাইরাসের তোপে বিপর্যস্ত বিশ্ব; তখন আশার আলো দেখাচ্ছে সুস্থতার হার। বিশ্বে এখন অর্ধকোটির বেশি করোনাজয়ী। শতকরা হিসাবে ৯১ ভাগ মানুষই প্রাণঘাতী এ ভাইরাস থেকে সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন।
বাংলাদেশেও করোনা শনাক্ত বাড়ার পাশাপাশি সুস্থ হওয়ার সংখ্যাও বাড়ছে। প্রতিদিনই সুস্থ হচ্ছেন বিপুল সংখ্যক মানুষ। এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধ লাখ মানুষ সুস্থ হয়েছেন। ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা মহানগরসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ও বাড়িতে উপসর্গবিহীন রোগীসহ সুস্থ হয়েছেন ২ হাজার ৩১ জন। সব মিলিয়ে মোট সুস্থ রোগীর সংখ্যা এখন ৪৯ হাজার ৬৬৬ জন। সেই সূত্রতায় বলা যায়- শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৪০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এদিকে ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩৭ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে করোনাভাইরাস। এ নিয়ে ভাইরাসটিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১ হাজার ৫৮২ জনে। একই সময়ে করোনায় আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন আরও ৩ হাজার ৪৬২ জন। এতে মোট শনাক্ত কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১ লাখ ২২ হাজার ৬৬০ জনে। তবে বাস্তবতা হলো- নেগেটিভকে পজিটিভ রেজাল্ট দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়ারও সংবাদ দৈনিকে প্রকাশিত হচ্ছে, মিডিয়াতে প্রচার হচ্ছে। এরই মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছে নমুনা পরীক্ষা। যেখানে নতুন যুক্ত একটিসহ ৬৬টি পরীক্ষাগারে ২৪ ঘণ্টায় ১৭ হাজার ২৪৫টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ১৬ হাজার ৪৩৩টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এ নিয়ে দেশে মোট নমুনা পরীক্ষা করা হল ৬ লাখ ৬০ হাজার ৪৪৪টি। গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ২১ দশমিক ৭ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ২৯ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় যারা মারা গেছেন তাদের ৩৪ জন পুরুষ, তিনজন নারী। তাদের মধ্যে ১১ থেকে ২০ বছরের একজন, ২১ থেকে ৩০ বছরের দুজন, ৩১-৪০ বছরের মধ্যে দুজন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের তিনজন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের ১২ জন, ৬১-৭০ বছরের নয়জন এবং ৭১ থেকে ৮০ বছরের মধ্যে আটজন রয়েছেন।
একদিকে করোনা-লকডাউন; অন্যদিকে করোনাকে পূঁজি করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি-দুর্নীতির কারণে নিরন্ন মানুষের সংখ্যা বেড়ই চলছে। বাড়ছে বেকারত্বের সংখ্যাও। ঢাকা ছাড়ছেন স্বপ্নের সোনার হরিণ ধরতে আসা স্বপ্নবাজ অনেকেই। দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত ২৭ জুনের প্রথম পাতায় লিড প্রতিবেদনে সংবাদযোদ্ধা জামিউল আহসান সিপুর শিরোনাম ছিলো ‘কাজ হারিয়ে ঢাকা ছাড়ছেন বহু মানুষ’। তুলে ধরা হয় অসংখ্য মানুষের জীবনকথা। যারা এই করোনার কারণে ব্যবসা হারিয়ে, চাকুরিয়ে হারিয়ে, সরকারি সহায়তা তো দূরে থাক কোন রকম প্রণোদনা না পেয়ে অবশেষে বাড়ি ভাড়া দিতে না পারায় পা বাড়িয়েছেন গ্রামের বাড়ির পথে। এই বাস্তবতা যখন নিরন্ন মানুষকে কষ্ট আর যন্ত্রণায় আছড়ে ফেলছে; তখন ভয়াবহ দারিদ্র্যের আশঙ্কা করছে ইউনিসেফ।
শুধু ইউনিসেফ কেন? আমরাও দেখছি প্রতিনিয়ত করোনা সংকটে বেকার হয়ে পড়েছে অনেক মানুষ। বিশেষ করে ছিন্নমূল মানুষ মানবেতর দিনযাপন করছে। আর সরকার বলছে- ভালো আছে সবাই, ভালো আছে বাংলাদেশ। মন্ত্রীরা বলছেন- প্রধানমন্ত্রীর কারণে নির্মম মহামারি করোনাকে আমরা পরাজিত করেছি। তবে বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ এশিয়ায় গত কয়েক দশকে শিশুস্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও কোভিড-১৯ মহামারির আঘাতে এই অঞ্চলের লাখ লাখ পরিবার আবারও দারিদ্র্যে ডুবে যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে ইউনিসেফ। তাদের মতে- বিশেষ করে বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ জনসংখ্যার আবাস এই অঞ্চলে মহামারি দ্রম্নত ছড়িয়ে পড়তে থাকায় ৬০ কোটি শিশুর ওপর তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে। একই সাথে তাদের বক্তব্য হলো- কোভিড-১৯ মহামারির কারণে টিকাদান, পুষ্টি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে, যা পরবর্তী ছয় মাসে চার লাখ ৫৯ হাজার শিশু ও মায়ের জীবন হুমকির মুখে ফেলেছে। লকডাউনের সময় বাংলাদেশে টিকাদান পরিষেবা পাওয়ার সীমিত সুযোগ এবং অভিভাবকদের সংক্রমণের আশঙ্কার কারণে এপ্রিল মাসে কেবলমাত্র অর্ধেক শিশু নিয়মিত টিকা নিতে পেরেছে। ইউনিসেফ সারাদেশে স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে অপুষ্টির চিকিৎসায় ব্যবহৃত থেরাপিউটিক দুধ সরবরাহ করলেও তীব্র অপুষ্টিজনিত সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের সেবা গ্রহণের হার জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যবর্তী সময়ে ৭৫ শতাংশ কমেছে।
লকডাউন এবং অন্যান্য পদক্ষেপসহ মহামারির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নানাভাবে শিশুদের জন্য ক্ষতির কারণ হচ্ছে। তবে শিশুদের ওপর অর্থনৈতিক সংকটের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব হবে সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন মাত্রায়। এখনই জরুরি পদক্ষেপ না নিলে কোভিড-১৯ পুরো একটি প্রজন্মের আশা ও ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করে দিতে পারে বলে আমিও আশঙ্কা করছি একজন নিবেদিত শিক্ষা-সাহিত্য-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে। যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষাঙ্গণগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনুমোতি দেয়ার পাশাপাশি সরকারি বরাদ্দ দেয়া এখন সময়ের দাবী।
আমি মোমিন মেহেদী। দিনের মত সত্য অবিরত তৈরি থাকি কাজের জন্য। বাড়ি ভাড়গা সমস্যা সমাধানের দাবীতে করো পরিস্থিতিতে জীবনের কথা না ভেবে দলীয় নেতাকর্মীদেরকে সাথে নিয়ে অনশন করেছি, সরকারের টনক না নড়ায় রোড মার্চ করেছি, প্রধানমন্ত্রীকে দাবী ও সমাধানকল্পে স্মারকলিপি দিয়েছি। গাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে সমাবেশ করেছি, বাজেট গণবিরোধী হওয়ায় অর্থমন্ত্রীকে লাল কার্ড দেখিয়েছি, স্বাস্থ্যখাতে ব্যর্থ হওয়ায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কুশপুত্তুলিকা দাহ করেছি, খাদ্য মন্ত্রণালয়ে সীমাহীন দুর্নীতি-দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধে ব্যর্থ হওয়ায় খাদ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে জুতো মিছিল করেছি। সবচেয়ে বড় কথা আমি কখনোই চর্বিত চর্বন; এক কথা বারবার বলা আর নিজেকে জাহির করার সমাধানহীন টক শোতে যাই না, কলামও লিখি না। যে কারণে নিবেদিত থেকে সাহসের সাথে বলছি- বিশ্বে শিক্ষাঙ্গণ বন্ধ থাকায় ৪৩ কোটিরও বেশি শিশুকে দূরবর্তী (অনলাইন) শিক্ষা কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। তবে বাংলাদেশের মত অনুন্নত দেশের অনেক পরিবারের, বিশেষ করে অনেক গ্রামীণ অঞ্চলে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ না থাকায় এই ব্যবস্থা আংশিক প্রয়োজন মেটাতে পারলেও অধিকাংশ শিক্ষার্থীকেই করেছে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এই সমস্যা উত্তরণে যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেয়া হয়; কেবলমাত্র বাংলাদেশেই ঝরে যাবে ২২ লাখ শিক্ষার্থী। উত্তরণে নতুন প্রজন্মের পক্ষ থেকে কোটি কোটি শিক্ষার্থী ও লাখ লাখ শিক্ষকের জন্য চলতি বাজেটে ২০% বরাদ্দ চাই। শিক্ষা খাতে ২০% বরাদ্দ এবং বেকারত্ব দূরিকরণের জন্য প্রকৃত প্রণোদনা সহজ শর্তে দেয়ার লক্ষ্যে কর্মসংস্থান ও ব্যবসায় কমপক্ষে ১০% বরাদ্দ চাই। যে বরাদ্দের টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে বেকার হয়ে যাওয়া চাকুরীজীবী-ব্যবসায়ীদেরকে দেয়া হবে। বেকাত্বমুক্ত বাংলাদেশ-সুশিক্ষার পরিবেশ সবার মঙ্গলসময় আগামী দেখার প্রত্যয়ে থাকবো বরাবরের মত অবিরত...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি