রাজশাহীর দুর্গাপুরে কলেজ শিক্ষকযখন চা’ দোকানের বয়। অর্দাহারে অনাহারে দিন কাটছে কলেজ শিক্ষক ইসমাইল হোসেনের পরিবারের। দুর্গাপুর উপজেলার সিংগা পূর্বপাড়া গ্রামের মরহুম আলহাজ্ব সিরাজ উদ্দিন পুত্র ইসমাইল হোসেন ২০০০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। পিতার সহায় সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানে মোটা অংকের ডোনেশন দিয়ে ২০০৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর দুর্গাপুর উপজেলার আলীপুর মডেল কলেজে প্রভাষক (বাংলা) বিভাগে নিয়োগ পান এবং ২০০৫ সালের ৯ ই জানুয়ারী প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেন। সেকাল একাল প্রায় দেড় যুগ পর্যন্ত কলেজে অধ্যাপনা করে আসছেন বিনা বেতনে। বর্তমানে সাংসারিক অবস্থার বেহাল দশা প্রভাষক ইসমাইল হোসেনের। তিনি বর্তমানে দুর্গাপুর পৌরসভার সিংগা বাজারের জামাল টি ষ্টলের বয়। চা দোকানেও সপ্তাহে কাজ হয় ২/৩ দিন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কলেজে শিক্ষকতা শেষে দুপুর থেকে সন্ধা অবধি চা দোকানের কাজ করে মিলে ৮০-১০০টাকা। সেই টাকা দিয়ে পরিবারে থাকা বৃদ্ধা মা, ছেলে সন্তান সহ সকল সদস্যদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন কলেজ প্রভাষক ইসমাইল হোসেন। শুধু ইসমাইল হোসেন না এমনকি করুনদশা’য় মানবেতর জীবন কাটছে রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার আলীপুর মডেল কলেজের ৩৬ জন শিক্ষক-কর্মচারীর। শিক্ষকদের এই করুনদশা থেকে মুক্তি দিতে মঙ্গলবার প্রতিষ্ঠানে সরজমিনে পরিদর্শন করে শিক্ষকদের সকল কাগজপত্র যাচাই বাছাই করেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের রাজশাহীর আঞ্চলিক পরিচালক ডা. কামাল হোসেন সহ শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা বৃন্দ।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের রাজশাহীর আঞ্চলিক পরিচালক জানিয়েছেন, শিক্ষকরা এমপিও আবেদন করেছে শিগগিরই এমপিওভুক্তির ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আদালত অবমাননার মামলার পর আলীপুর মডেল কলেজের ৩৬ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে বেতন দিতে গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপরও শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত না করায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের গত ১২ জানুয়ারির আবারও এমপিওভুক্তির নির্দেশনা দেয়। তবে অভিযোগ রয়েছে উপজেলা মাধ্যমিক অফিসের গাফিলতির কারণে অনলাইনে আবেদন করতে পারেনি ৩৬ শিক্ষক-কর্মচারী। অনলাইন আবেদনের জন্য উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ডিউ পোস্ট সেটআপ না দেওয়ায় শিক্ষক-কর্মচারী আবেদন করতে ব্যর্থ হন।
বিষয়টি উল্লেখ করে কলেজ কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এই অভিযোগের পর মন্ত্রণালয় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিলে গত ১৫ জুন মাধ্যমিকও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর রাজশাহীর আঞ্চলিক পরিচালককে এমপিওভুক্তির ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেয়। নির্দেশনায় বলা হয়, গত মার্চ মাসের এমপিও সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অনলাইনে এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে ডিউ পদ সৃষ্টির প্রয়োজন নেই। কলেজ কর্তৃপক্ষ ৩৬ জন শিক্ষক-কর্মচারীর জন্য রাজশাহীর আঞ্চলিক পরিচালক বরাবর আবেদন করবেন। পরিচালক প্যাটার্নভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্ত করবেন এবং প্যাটার্ন বহির্ভূত পদগুলোর জন্য সিদ্ধান্ত চাইবেন।
এ বিষয়ে রাজশাহীর আঞ্চলিক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. কামাল হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, কাগজপত্র যাচাই করার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মন্ত্রণালয় ও মাউশির নির্দেশনা অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার আলীপুর মডেল কলেজ এমপিওভুক্ত হয় ২০০৪ সালে। কিন্তু অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতি ছাড়াই এই প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত করা হয়। এমপিওভুক্তির পরও শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তি বন্ধ রাখা হয়। অধিদফতর থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, অ্যাকডেমিক স্বীকৃতি নিতে হবে। ফলে নতুন করে অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতির আবেদন জানায় কলেজ কর্তৃপক্ষ। অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতি দিতে অধিদফতরের সময় লাগে ৭ বছর। ২০১১ সালে অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতি মেলে। তবে তাতেও ভাগ্য খোলে না ৩৬ শিক্ষক-কর্মচারীর। অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতির পর এমপিওভুক্তির জন্য দীর্ঘ ৬ বছর প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয় কর্তৃপক্ষ। এই পরিস্থিতিতে উচ্চ আদালতের আশ্রয় নেয় কলেজ অধ্যক্ষ। আলীপুর মডেল কলেজের অধ্যক্ষ মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা ২০১৭ সালে হাই কোর্টে রিট পিটিশন করি। ২০১৭ সালের ৩১ মে এমপিওভুক্তির নির্দেশ দেন আদালত। আদালতের নির্দেশের পরও এমপিওভুক্ত হতে পারিনি আমরা ৩৬ জন শিক্ষক-কর্মচারী। পরে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে আদালত অবমাননার মামলা করি মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে। আদালত অবমাননার মামলার পর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ তৎপর হয়। সরকার পক্ষ হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর। আপিল ও আদালত অবমাননার মামলার নির্দেশনায় উচ্চ শেষ পর্যন্ত গত বছর ১৯ সেপ্টেম্বর ৩৬ শিক্ষক-কর্মচারীকে এমপিওভুক্ত করার নির্দেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তাও আটকে যায়। সর্বশেষ গত ১০ জুন অনলাইনে আবেদন করেছি। আঞ্চলিক পরিচালক দ্রুত ব্যবস্থা নিলে সকল শিক্ষকরা মানবেতর জীবন থেকে রেহাই পাবেন।