বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সরকারের ভর্তুকিকৃত ১০ টাকা দরে জনগণের হাতে ডিলাররা তুলে দিচ্ছে পোকা জন্ম নেওয়া নি¤œমানের লালচে মোটা চাল। খাওয়ার অনুপযোগি হওয়ায় সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনার অংশ হিসেবে দেওয়া ১০ টাকা দরের চাল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ভুক্তভোগী কর্মহীন মানুষ।
বুধবার দুপুরে শহরের সরকারি পশু হাসপাতালের সামনে পঞ্চগড়-তেঁতুলিয়া মহাসড়কের পাশে অলস সময় পার করতে দেখা যায় ডিলারের লোকজনকে। ১০ টাকা দরে চাল কিনতে মানুষের লাইন বা হুড়োহুড়ি তো নেই-ই, প্রায় ৩০ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে থেকেও একজন ক্রেতার মুখ দেখা যায়নি। এসময় তাদের কাছে সরকারি সীল যুক্ত বস্তায় রক্ষিত পোকা ধরা লালচে মোটা চাল দেখা যায়। নি¤œমানের চালের বিষয়ে পঞ্চগড় সরকারি খাদ্য গুদাম থেকে আনা হয়েছে বলে জানান ডিলারের ম্যানেজার। পঞ্চগড় সবকারি খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: খলিলুর রহমানের কাছে মুঠোফোনে এ ধরনের নি¤œমানের চাল সরকার কখনও কিনেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের সাথে কথা বলতে বলেন।
স্থানীয় ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ বলেন, সরকার বাজারের সর্বোচ্চ দামে কৃষক বা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ধান-চাল ক্রয় করেন। কিন্তু আমাদের দেওয়া হচ্ছে নি¤œমানের লালচে মোটা চাল। এই চালের ভাত রান্নার সাথে সাথে খেতে হয়। এক-দুই ঘন্টার বেশি সময় রাখা হলে গন্ধ বের হয়ে ভাত নষ্ট হয়ে যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্টেডিয়াম এলাকার এক ব্যক্তি বলেন, তার একজন কর্মহীন প্রতিবেশী ব্যাপক উৎসাহে ১০ টাকা কেজির চাল উত্তোলন করেন। কিন্তু রান্নার পর ভাতের গাঁ ছাড়া ভাব আর গন্ধে খেতে পারেননি। তিনি তার কাছে ৫ কেজি চাল কিনেছেন লকডাউনে অভুক্ত কুকুর-বিড়ালকে খাওয়াতে।
রাত ১২ টায় নিজেই ভাত রান্না করে বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম স্টেডিয়ামের পাশে জড়ো হয়ে থাকা কুকুরগুলোর সামনে কলা পাতায় করে এনে দেন। খাবার দেখে কুকুরগুলো দৌড়ে এলেও ধোয়া ওঠা গরম ভাতগুলো শুকে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে চলে যায়। একটি কুকুরও একটি ভাতও খেতে পারলো না। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে আরও বলেন, ভাবলাম গরম বলেই খেতে পারছে না। ঠান্ডা হলেই খাবে, এমনটা ভেবে আড়ালে প্রায় এক থেকে দুই ঘন্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম। না কোন কুকুরও একটি দানাও স্পর্শ করলো না।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে কর্মরত নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন, ওনি (খলিলুর রহমান) স্থানীয় বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে ওনার নিচের তো আছেই উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদেরও দৌড়ের ওপর রাখেন। পুরো অফিসে তিনি এমন প্রভাব বিস্তার করেছেন যে, আমরা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক স্যারকে যতটা সম্মান বা ভয় পাই না, তার চেয়ে কয়েকগুন বেশি ভয় পাই তাকে। অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বদলী পর্যন্ত হয় তার ইশারায়। পঞ্চগড় আওয়ামী লীগের কোন এক নেতার ছত্রছায়ায় ধান-চাল ক্রয়ে অনিয়ম-দুর্নীতিসহ অফিসে বিভিন্নভাবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর প্রভাব খাটিয়ে আসছেন।
অফিসে কর্মরত অপর একজন, এক কর্মকর্তার দিকে ইশারা করে বলেন, স্যার আর ক’বছর পরেই চাকরি থেকে অবসর নিবেন, এখন পর্যন্ত মাথা গোঁজার ঠাই হিসেবে একটি বাড়ি করতে পারেননি। অথচ ছোট একটা চাকরি করে তিনি (খলিলুর রহমান) ক’তলা ভবন বানাচ্ছেন খবর নিয়ে দেখেন।
ধান-চাল ও গম ব্যবসায়ীদের একটি সূত্র জানায়, বিভিন্ন অজুহাতে খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা খলিল আমাদের পুরো বিল প্রদান করেন না। বিভিন্ন অজুহাতে কৃষক বা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কেটে নেওয়া খাদ্য শষ্য অন্যের নামে বিল করে তিনি নিজে তুলে নেন।
এ ছাড়াও বাজার মূল্যের চেয়ে দাম বেশি জেনেও গুদাম কর্মকর্তার হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে অনেক কৃষক সরকারি খাদ্য গুদামে খাদ্য শষ্য সরবরাহ করেন না। তারা কম লাভে পাইকার বা ব্যবসায়ীদের কাছে তাদের জমিতে উৎপাদিত খাদ্য শষ্য বিক্রি করে দেন।
পঞ্চগড় সদর উপজেলা পরিষদ ভাইস চেয়ারম্যান কাজী আল তারিক বলেন, কিছুদিন আগে একজন ভুক্তভোগি একটি অনিয়ম সর্ম্পকে আমাকে জানালে, আমি গিয়ে তাকে (খলিলুর রহমান) সতর্ক করে দেই।
এ ব্যাপারে পঞ্চগড়ের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও ভুক্তভোগি ডিলার বলেন, এই চালগুলো কোন ডিলারই নিতে চায় না। এগুলো আটোয়ারী ফকিরগঞ্জ খাদ্য গুদামের চাল বলে জানতে পেরেছি।
আটোয়ারী ফকিরগঞ্জ খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত তর্মকর্তা জেসমিন আক্তার বলেন, এক বছর আগের চাল প্রায় মাসখানেক আগে সদরে পাঠানো হয়েছে। তবে চালের মান খারাপ নয়, যতটা বলছেন।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো: জহুরুল হক বলেন, ধান-চাল, গমসহ সরকারের ক্রয় নীতিমালার অর্ন্তভুক্ত সকল প্রকার খাদ্যশষ্য খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ক্রয় করেন। এ বিষয়ে তিনিই সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। এ বিষয়ে আপনাকে আমার কাছে পাঠানোর কারণ আমার বোধগম্য নয়। চালের মান সর্ম্পকে তিনি বলেন, এক বছর পুরনো হলেও চাল এতটা লালচে হওয়া বা পোকা ধরার কথা নয়।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, আচ্ছা আমি দেখবো, ঠিক আছে।