একদিকে কোরবানী, অন্যদিকে করোনা। সমান্তরাল চলতে চলতে তৈরি হবে ভয়ানক করোনা পরিস্থিতি। তেমনটাই দেখতে পাচ্ছি। মধ্যিখানে শিক্ষা-খাদ্য-দারিদ্র সংকট তৈরি হলেও খুলে যাবে বরাবরের মত দুর্নীতির দরোজা। যে দরোজা দিয়ে অবিরত আসছে দুঃসময়ের হাওয়া। আমাদের সুসময়কে খেয়ে নিচ্ছে ছলনার রাজনীতিক-প্রশাসনিক ব্যক্তিরা। এরই মধ্য দিয়ে এবার ঈদুল আজহা কেন্দ্র করে ঢাকাসহ দেশব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণে বিস্ফোরণ ঘটার আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। ঈদ উদযাপনে মানুষ দল বেঁধে ঢাকা ছাড়বে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তখন ছড়িয়ে যাবে ভয়াবহ করোনা। এছাড়া কোরবানির চাহিদা মেটাতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বসবে পশু বিক্রির অস্থায়ী হাট; দুটি পর্যায়ই করোনা সংক্রমণের হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত।
আমি যে যন্ত্রণাকাতর রাজনৈতিক-প্রশাসনিক কর্তাদেরকে দেখছি; প্রায় সবাই-ই দেশ-মানুষকে করোনা পরিস্থিতিতে আন্তরিকতার পরিবর্তে দিচ্ছে ছলা-কলা আর কষ্টময় বর্তমান। যে কারণে নিরন্ন মানুষ ঢাকা ছাড়ছে, ছাড়ছে বিভাগীয় শহরগুলোও। ঈদুল ফিতরের সময় অবাধে ঢাকা ছাড়ার মাধ্যমে বিষয়টি প্রমাণ হয়েছে। কাজেই এবার দুটি ধাপেই নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য সরকারেরই প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।
কেউ কারো কথা শোনে না। শুনলে, ধর্ম-মানবতা আর দেশের কথা ভুলে আসন্ন ঈদুল আজহায় ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৩০টি অস্থায়ী কোরবানি পশুর হাট বসানোর প্রক্রিয়া শুরু হতো না। বরং বলা হতো এবার কোরবানীর পশুর হাট বসবে না। যেভাবে বিষয়টিকে এড়িয়ে গেছে সৌদি আরব সহ উন্নত দেশগুলো। সৌদি আরব তো এবার হজ্বেও ব্যাপারেও করেছে চরম কড়াকড়ি। তার মধ্যে কিভাবে যে, জাতির এই ক্রান্তিকালে কোরবানী পশুর হাট নিয়ে ভাবছে, তা আমার বোধগম্য নয়।
এরই মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন জানিয়েছে- (ডিএসসিসি) ১৮টি ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বসবে ১২টি হাট। সাথে সাথে গাবতলীর স্থায়ী পশুর হাটেও চলবে কোরবানির পশু বেচাকেনা। ঢাকার বাইরের হাটগুলো ইজারার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। ভাবতেই বোকা মনে হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে, তাদের এতসব নির্দেশনা বাংলাদেশের জন্য কেন দেয় বোকার মত! যেখানে করোনা মহামারীর প্রেক্ষাপটেও কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। এসব হাটে পশু কেনাবেচা করতে বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগম হবে। আমি মনে করি- এই কোরবানী পশুর হাটের মধ্য দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ বা সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। ফলে দেশে করোনার সংক্রমণ কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। এছাড়া কোরবানি উপলক্ষে অনেক মানুষ গ্রামে যাবে। ফলে ঈদুল ফিতরের তুলনায় কোরবানিতে আরও ব্যাপক হারে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে। এমনকি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যেতে পারে। চাঁদ ওঠা সাপেক্ষে আগামী মাসের শেষে ঈদুল আজহা অনুষ্ঠিত হবে। তার উপর সরকার কোন কার্যত পদক্ষে না নিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেককে দিয়ে বলিয়েছে যে, কোরবানি একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এখানে বাধা দেয়ার সুযোগ নেই। কোরবানি উপলক্ষে প্রতিবছর হাট বসে। এবারের প্রেক্ষপট ভিন্ন হলেও তার কোনো ব্যতিক্রম ঘটছে না। তবে বর্তমান সময়ে যেন সামাজিক দূরত্ব মেনে হাট পরিচালিত হয়, সেখানে যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। কোরবানির পশুর হাটটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন। তাই হাট স্থাপনের ক্ষেত্রে তাদের লক্ষ রাখতে হবে যেন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় হাট বসানো না হয়। হাটে যেন পর্যাপ্ত ফাঁকা জায়গা রাখা হয়। নয়তো সংক্রমণ অনেক বেড়ে যেতে পারে।
প্রকৃত অর্থেই কোন নিয়ম না মেনে চলে না কেউ, সরকারের কথাও শোনেনি কেউ। তখন যানবাহন বন্ধ ছিল, এখন বাস, ট্রেন, লঞ্চসহ সব ধরনের যানবাহন চালু রয়েছে। তবে আমাদের অনুরোধ থাকবে- যার যার অবস্থান থেকে ঈদ পালন করুন। যদি একান্তই গ্রামে যেতে হয়, তাহলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। নয়তো সংক্রমণ বাড়বে, স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর প্রচন্ড চাপ পড়বে। তখন সবাইকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া কষ্টকর হয়ে পড়বে। এভাবে বলার একটাই কারণ, আর তা হলো- দেশকে করোনা পরিস্থিতিতে রক্ষার জন্য নিবেদিত থাকার পাশাপাশি সবাই সরকারি সহযোগিতার জন্য দাবী তুলুন-নিরন্ন মানুষদেও কথা ভেবে হলেও, ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়া-চাকুরী হারা মধ্যবিত্ত-নিন্মবিত্তদের কথা ভেবে হলেও সতর্ক থাকুন। এই সব গরু খাওয়ার চেষ্টা থেকে সরে এসে ধর্মকে প্রকৃত অর্থে পালন করুন। ধর্ম মানবতার মুক্তি দেয়; অতএব, ধর্মকে করোনা পরিস্থিতিতে মানবতার কল্যাণের জন্য নিবেদন করুন। শুধুমাত্র প্রতিযোগিতার কোরবানীর জন্য প্রতি বছর পশু যারা কেনেন, নির্মম মহামারি করোনাকালে তারা অন্তত জাতিকে মুক্তি দিন। গরুর গোস্ত দেয়ার বদলে গরু না কিনে সেই টাকায় চাল-ডাল কিনে নিরন্ন মানুষদের মাঝে দান করুন। দেখবেন মহান আল্লাহ খুশি হবেন। যা এই ওয়াজিব কোরবানীর চেয়েও বেশি উপকারে আসবে আপনার ধর্ম-মানবতা ও সমাজের জন্য।
কোটি কোটি নিরন্ন মানুষকে খাবার দিতে না পারলেও, বাড়ি ভাড়া সমস্যার সমাধান করতে না পারলেও, গণপরিবহন ভাড়া স্বাভাবিক করতে ব্যর্থ হলেও কোরবানী দিতে উৎসাহিত করছে সরকার। যে কারণে উত্তর শাহজাহানপুরের মৈত্রী সংঘ মাঠ এলাকার খালি জায়গা, হাজারীবাগের ইনস্টিটিউট অব লেদার টেকনোলজি মাঠ সংলগ্ন খালি জায়গা, কামরাঙ্গীরচরের ইসলাম চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে দক্ষিণ বুড়িগঙ্গা বাঁধ পর্যন্ত খালি জায়গা, পোস্তগোলা শ্মশান ঘাট এলাকার খালি জায়গা, শ্যামপুর বালুর মাঠ সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, মেরাদিয়া বাজারের আশপাশের খালি জায়গা, আরমানিটোলা মাঠ সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, গোপীবাগ বালুর মাঠ ও কমলাপুর স্টেডিয়াম সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, যাত্রাবাড়ীর দনিয়া কলেজ সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, ধূপখোলা মাঠ সংলগ্ন খালি জায়গা, সাদেক হোসেন খোকা মাঠ সংলগ্ন ধোলাইখাল ট্রাকস্ট্যান্ড এলাকা, আফতাবনগরের (ইস্টার্ন হাউজিং) ব্লক-ই, এফ, জি ও এইচ এবং সেকশন-১ ও ২ এর খালি জায়গা, আশুলিয়া মডেল টাউনের খালি জায়গা এবং লালবাগের রহমতগঞ্জ খেলার মাঠের আশপাশের খালি জায়গায় আগের মতই কোরবানীর পশুর হাট বসবে, মেয়র-কাউন্সিলরদের পাশাপাশি স্থানিয় নেতা পাতিনেতারা গরু কিনবেন, হাসিলের টাকার ভাগ পাবেন, হাট ইজারার ভাগ পাবেন; আর পুলিশ-প্রশাসন পাবে তাদের হিস্যা। সেই হিসেবের সূত্রতায় এগিয়ে আছে ঢাকা উত্তরও। এবার ১২টি স্থানে পশুর হাট বসানো হবে- ভাষানটেক রাস্তার নির্মাণাধীন অব্যবহৃত-পরিত্যক্ত অংশ এবং পাশের খালি জায়গা, ভাটারা সংলগ্ন এলাকা, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের খেলার মাঠ, বাড্ডা ইস্টার্ন হাউজিংয়ের খালি জায়গা (আফতাবনগর), মোহাম্মদপুর বুদ্ধিজীবী সড়কের পাশে পুলিশ লাইনের খালি জায়গা, মিরপুর সেকশন-৬ (ইস্টার্ন হাউজিং)-এর খালি জায়গা, উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের ১ নম্বর ব্রিজের পশ্চিমের অংশ এবং ব্রিজের পশ্চিমে গোলচত্বর পর্যন্ত সড়কের ফাঁকা জায়গা, উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টরের বৃন্দাবন থেকে উত্তরদিকে বিজিএমইএ পর্যন্ত খালি জায়গা, কাওলা শিয়ালডাঙ্গা সংলগ্ন খালি জায়গা। ডিএনসিসিতে আরও একটি স্থান হাটের জন্য নির্ধারণ করার প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়া দুই সিটিতে আরও ৬টি হাট স্থাপনের পরিকল্পনা চলছে।
‘যত যাই করুক-মরুক জনগন’ ভাবটা যেন এমন, তা না হলে সরকার-সংশ্লিষ্টদেরকে বারবার বলার পরও- এ নিয়ে লেখার পরও কেন এই গরুর হাট, কাদের স্বার্থে? যেখানে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের কনসালটেন্ট ও করোনা সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ডা. মোশতাক হোসেন কয়েক দফায় বলেছেন- এই করোনা কালে কেন কোরবানি উপলক্ষে পশুর হাট বসবে? যেখানে হাট বসবে, সেখানে জনসমাগম হবে। আবার কোরবানির ঈদ উপলক্ষে মানুষ ঢাকা থেকে গ্রামমুখী হবে, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাওয়া-আসা করবে। এতে রোগটির সংক্রমণ আরও ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়বে।
এখন গড়ে ৩৫০০ আক্রান্ত হচ্ছে; আর কোরবানীর গরু খাওয়ার প্রতিযোগিতার পর তা কতটা ছড়াবে, তা অনুমান করে বলা মুশকিল। তবে দেশে করোনা সংক্রমণ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ার শঙ্কা আছে বলে আমিও একমত। অবশ্য সেই পরিস্থিতির উত্তরণে যদি সরকারের পাশাপাশি উচ্চবিত্তরা কোরবানির অর্থ দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া এবং গ্রামে যাওয়া থেকে বিরত থকে, তাহলে ভয়াবহতা এড়ানো সম্ভব হবে।
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি