করোনা প্রাদুর্ভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের পোলট্রি শিল্প। আশঙ্কাজনক হারে কমেছে ডিম ও মাংসের উৎপাদন। মূলত দেশে করোনা সংক্রমণের শুরুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজবে সাধারণ মানুষ ব্রয়লার মুরগির মাংস ও ফার্মের ডিম খাওয়া কমিয়ে দেয়ায় এ বিপর্যয় নেমে আসে। ইতিমধ্যে ওই খাতে প্রায় হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আর ছোট ও মাঝারি খামারিদের ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ পুঁজি হারিয়েছে। ডিমের উৎপাদন কমেছে এক-তৃতীয়াংশ আর মাংস উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। পোলট্রি শিল্প এখনো তা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আর এ ধারা অব্যাহত থাকলে ধ্বংসের মুখে পড়বে দেশের পোলট্রি খাত। বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশের পোলট্রি শিল্পে যুক্ত প্রায় ২০ লাখ নারীর অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ও সামাজিক অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করেছে। কোভিড মহামারী শুরুর আগে দেশে পোলট্রি খামারের সংখ্যা ছিল প্রায় এক লাখ। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে ৫০-৬০ শতাংশ ব্রয়লার খামার সাময়িক বা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। আর চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় ডিম পাড়া মুরগিও অনেক খামারি বিক্রি করে দেয়। ফলে ডিমের উৎপাদন ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। দ্রুত যদি ওসব খামারিকে সরকার থেকে কিছুটা পুঁজিও না দেয়া যায় তাহলে সামনে আরো বিপদ বাড়বে।
সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারিতে একেকটা ডিম ৮ টাকা করে বিক্রি হয়েছে। আর মুরগির কেজি ১৪০ টাকা আর মুরগির বাচ্চা ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মার্চে তা কমে অর্ধেকে নেমে আসে। আর শেষ দুই মাসে নতুন করে প্রায় ৩০ হাজার খামারি পুঁজি হারিয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, দেশে করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই একটি চক্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্রয়লার মুরগি ও ফার্মের মুরগির ডিম থেকে করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে বলে গুজব ছড়ায়। তারপর পণ্য পরিবহনে বাধা সৃষ্টি হওয়ায় সঙ্কট আরো বাড়ে। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে ক্ষুদ্র খামারিরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুত সহযোগিতা জরুরি, যাতে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারে। তা নাহলে পোলট্রি খাত পুঁজির সংকটে দেশের ডিম ও মুরগির মতো নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা। তাতে মানুষের পুষ্টি ও খাদ্যনিরাপত্তায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর সরকার কৃষি খাতের জন্য প্রণোদনা সহায়তা ঘোষণা করেছে তা পোলট্রি খাতের উদ্যোক্তাদের না দেয়া হলে ডিম ও মুরগির উৎপাদন আগের অবস্থায় কখনো ফিরে আসবে না।
এদিকে দেশের পোলট্রি শিল্পের বর্তমান অবস্থা সম্পকে বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সহ-সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ জানান, পোলট্রি খাতের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ব্যবসায়ী ও খামারিরা যতটুকু সহযোগিতা পাওয়ার কথা তা পাচ্ছে না। ফলে একের পর এক খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ডিমের দৈনিক উৎপাদন যেখানে সাড়ে ৪ কোটি হতো, সেখানে এখন পৌনে ৩ কোটিতে নেমে এসেছে। ব্রয়লার মুরগির মাংসের দৈনিক উৎপাদন হতো ৩ হাজার ২৭ টন, বর্তমানে হচ্ছে এক হাজার ৫০০ টন। এ কারণে মার্চ থেকে মে পর্যন্ত পোলট্রি শিল্পে প্রায় আট হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। জুলাই মাস নাগাদ পোলট্রি শিল্পের সঙ্গে জড়িত ১৫ থেকে ২০ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তার সঙ্গে তাদের ওপর নির্ভরশীল প্রায় ৪৫ থেকে ৫৫ লাখ মানুষের জীবনেও দারিদ্র্য নেমে আসার আশঙ্কাও বাড়ছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী স ম রেজাউল করিম জানান, সরকার পোলট্রি খাত সংশ্লিষ্টদের খোঁজখবর রাখছে। সারা দেশে ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের একটি তালিকা করা হচ্ছে। সে অনুযায়ী তাদের সহায়তা করা হবে। সরকার কৃষি খাতে প্রণোদনা দিয়েছে। এর বাইরেও পোলট্রি, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতের জন্য সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহযোগিতা করা হবে। সহজ ঋণ দেয়া হবে। পোলট্রি ও ডেইরি শিল্পের আর যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্য সবরকম ব্যবস্থা নিচ্ছে। মনে রাখতে হবে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মতে করোনা সংকটকালে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা প্রয়োজন। ডিম ও মুরগির মাংস এর সহজ ও স্বল্পব্যয়ী দুটি উৎস। প্রাণিজ পুষ্টির উৎস দুধ, ডিম, মাছ ও মাংসের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সব ব্যবস্থা নিয়েছে।