সংসারে অভাব থাকলেও স্বামী ও দুই-ছেলে নিয়ে সুখের কমতি ছিল না জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার পুনট ইউনিয়নের আরতি রানী রবিদাসের (৩৩) কুড়েঘরে। হঠাৎ আরতি রানী রবিদাসের সুখের সংসারে আসে অজ্ঞাত এক জটিল রোগ। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তার স্বামী মতিলালা রবিদাস শারীরিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তিনি ধীরে ধীরে পঙ্গুত্বের দিকে এগিয়ে যান। তিনি হারিয়ে ফেলেন চলাচল। পরে কোন একসময় তিনি চিকিৎসার অভাবে সেই অজ্ঞাত রোগে মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর দুঃখ ভুলতে না ভুলতে আরেক দুঃখের ঢেউ আছড়ে পড়ে আরতি রানীর অভাবী সংসারে। তার স্বামীর মত একই ধরনের অজ্ঞাত রোগের শিকার হয় তার বড় ছেলে শ্রী সজল রবিদাস(১৬)। গতবছরের সেপ্টেম্বর মাসে ২৮ তারিখে তার বড় ছেলে শ্রী সজল রবিদাস মারা যান। বর্তমান একই সমস্যা দেখা দিয়েছে তার ছোট ছেলে শ্রী সহোদেব রবিদাস (১৪)। তিনি গত আট মাস থেকে নিথর দেহ নিয়ে এখন বাড়িতে পড়ে আছেন। তার মায়ের সাহায্য ছাড়া তিনি খাওয়া দাওয়া, চলাফেরা ও প্রসাব-পায়খানা কিছুই করতে পারেন না। প্রথমদিকে যা অর্থ ছিল তাই দিয়ে তার স্বামী ও বড় ছেরের চিকিৎসা করিয়েছেন আরতি রানী রবিদাস। কিন্তু পরে আর অভাবের কারণে ছোট ছেলে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেনি তিনি। সেই থেকে বিনা চিকিৎসায় ঘরে পড়ে রয়েছেন তারা ছোট ছেলে। একদিকে অর্থাভাবে চিকিৎসার অভাবে চোখের সামনে তিলে তিলে সন্তানের মৃত্যুর দিকে ধাবিত হওয়া আর অন্যদিকে সংসারের অভাব অনটন তার জীবনে নেমে এসেছে অমানিশার অন্ধকার। বর্তমান রানীর পরিবার দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কালাই উপজেলার পুনট ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের পুনট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যলয়ের সন্নিকটে কয়েকটি ঘর নিয়ে রবিদাস সম্প্রদায়ের বসতি আছেন। তারই মধ্যে হাফ শতকের উপরে ভাঙ্গা দুটি ঝুপরি ঘরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বিধবা আরতি রানী ও অজ্ঞাত জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়া তার এক ছেলে নিয়ে খুব কষ্টে জীবন-যাপন করছেন।
সেখানে দেখা হলো বিধবা আরতি রানী রবিদানের সঙ্গে। তাকে সাংবাদিকের পরিচয় দিলে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে দু’চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলেন, দাদা-এক সময় স্বামী মতিলাল রবিদাস ও দুই ছেলে শ্রী সজল রবিদাস, শ্রী সহোদেব রবিদাস নিয়ে আমাদের সংসার খুব ভালোভাবে চলছিল। আমার স্বামী পুনটহাটে জুতো সেলাই করে আমাদের সংসার চলত। কোন এক অজ্ঞাত জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ করে আমার স্বামী মারা যায়। প্রাথমিক ভাবে ঐ রোগের লক্ষণীয় বিষয়গুলো ছিলো-সে চলাফেরার সময় তার শরীর কাঁপতো। তার হাত-পা সবসময় অবশ হয়ে থাকত। সে কোন কিছু ধরতে ও ঠিকমত চলাচল করতে না পেরে প্রতিবন্ধী মতো হয়ে থাকত। তার মুখ বাঁকা হত এবং কথাগুলো ছিলো অস্পষ্ট। কোন কিছু ঠিক মতো খেতে পারতন সে। তার স্বাস্থ্য ধিরে ধিরে অনেক খারাপ হচ্ছিল। পরবর্তীতে তার শরীরে অসম্ভব ঝাঁকুনি বা কাঁপুনি ছিল। পথ চলতে চলতে হঠাৎ করে সে মাটিতে পড়ে যেতো। কিছুদিন পরে আমার সাহায্য ছাড়া সে খাওয়া দাওয়া, চলাফেরা ও প্রসাব-পায়খানা কিছুই করতে পারত না। অবশেষে ঐসব কারণে তার পেশাগত জুতা মেরামতের কাজ একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। আর সেই থেকে আমাদের সংসারে এলো অনেক অভাব-অনটন। তখন আমি বাধ্য হয়ে অন্যোর বাড়িতে ঝি এর কাজ করে স্বামী ও দুই সন্তানসহ মোট চারজনের পেটের ভাত কোন মতে জোগার করতাম। সেই অবস্থায় টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় আমার স্বামী মারা যায়। স্বামীর মৃত্যুর কিছু দিন পরই আমার বড় ছেলে শ্রী সজল রবিদাস (১৬) এর একই ধরণের লক্ষণ দেখা দেয়। আমার কাছে জমানো কিছু অর্থ এবং আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীর কাছ থেকে ধার দেনা করে এলাকার বিভিন্ন চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হলেও অর্থাভাবে তাদের পরামর্শ মোতাবেক স্বাভাবিক চিকিৎসাসহ কিছু পরীক্ষা করানো আর সম্ভব হয়নি। পরে গতবছরের সেপ্টেম্বর মাসে ২৮ তারিখে আমার বড় ছেলে সজল রবিদাস মারা যান। আবার গত আট মাস থেকে আমার ছোট ছেলে শ্রী সহোদেব রবিদাস (১৪) এর শরীরেও আমার স্বামী ও বড় ছেলের যে অজ্ঞাত জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েছে, সেই রোগের উপসর্গ দেখা দিয়েছে। সে রাতে হঠাৎ চমকে ওঠে। তার হাত-পা অবশ হয়ে যায়। মুখ বাঁকা হয়ে কথাগুলো অস্পষ্ট হয়। শরীরের ঝাঁকুনি হয়। সে হাঁটে চাইলে দুই-এক পা পথ চলতে হঠাৎ করে মাটিতে পড়ে যায়। এখন সে প্রতিবন্ধী মতো হয়ে আছে। সে কোন কিছু ঠিক মতো খেতে পারেনা। এখন তার স্বাস্থ্য ধিরে ধিরে অনেক খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান আমার দু’চোখে যেন আঁধারে ঢেকে আসছে। স্বামীর হাফ শতকের উপরে ভাঙ্গা বাড়ী ছাড়া আমার কোন সম্পদ নেই। সরকারী-বেসরকারী ভাবে কোন সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছি না, কেউ খোঁজ-খবরও নেয়নি। আমি কোন কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছিনা। কী করব এই ছেলেকে নিয়ে। সংসার ও ছেলেকে নিয়ে অনেক বিপদে আছি। চিকিৎসা তো দূরের কথা অসুস্থ ছেলের মুখে ভাত যোগার করাই আমার পক্ষে অসম্ভব হচ্ছে। কোনমতে এদিক-সেদিক ভাবে ছোট খাটো কাজ করে পেটের ভাত যোগার করতে হচ্ছে। আবার কখন-বা নিকটজনের দয়া-দক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করে চলতে হচ্ছে। এইসব বলার শেষে না হতেই তিনি হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠলেন।
অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হওয়া উপজেলার পুনট ইউনিয়নে পুনটহাটের বাসিন্দ শ্রী সহোদেব রবিদাস (১৪) ভাঙ্গ ভাঙ্গ ভাষায় বলেন, এই অজ্ঞাত রোগ থেকে বাঁচতে চাই। এই রোগে আমার বাবা ও বড় ভাই মারা গেছে। ভালো হয়ে লেখা-পড়া করে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ ও মানুষের জন্য অনেক সেবা করতে চাই। সরকার, কোন সংস্থা বা কোন সহৃদয়বান ব্যক্তির সহায়তা ছাড়া এখন আর আমাদের কোন পথ নেই। আশা করি কেউ না কেউ এগিয়ে আসবেন আমার সু-চিকিৎসার জন্য।
বিধবা আরতি রানী রবিদানের এক প্রতিবেশি শ্রী স্বাধীন বলেন, একসময় সুন্দর চলছিল তাদের সংসার। হঠাৎ করে এক অজ্ঞাত রোগে অসুস্থ হয়ে আরতি রানীর স্বামী, বড় ছেলে মারা যায়। আবার ঐরোগের উপসর্গ দেখা দিয়েছে তার ছোট ছেলের। এখন তারা খুবই অসহায়।
উপজেলার পুনট ইউনিয়ন পরিষদের ৫নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আবদুল রাজ্জাক বলেন, সরকারি ও ব্যক্তিগত তহবিল থেকে আরতি রানীর পরিবারকে অনেক অর্থ এবং খাদ্য সহযোগিতা দেওয় হয়েছে।
উপজেলার সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান পলাশ বলেন, উপজেলার আরতি রানীকে বিধাবভাতা দেওয়া হয়েছে। আর তার ছেলেকে প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হবে।
কালাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোবারক হোসের পারভেজ বলেন, আমাদের কাছে তারা আসলে তার ছেলের চিকিৎসা বিষয়টি উপজেলা প্রশাসন পক্ষ থেকে নিয়ম অনুযায়ী আর্থিক সহযোগিতা করা হবে।