কাহালু উপজেলার জামগ্রাম ইউনিয়নের শিয়ালা ভবানীপুরে বাস করেন বাউল দম্পত্তি সাহেব আলী ও নার্গিস বেগম। তাদের দুজনের মধ্যে সাহেব আলী জন্ম থেকেই অন্ধ আর শিশুকালেই মা-বাবা হারানো স্ত্রী নার্গিস বেগম তার একমাত্র সাহারা। তাদের নেই নিজেস্ব কোন জায়গা-জমি। করোনার মহামারিতে দুর্বিসহ জীবন যাপন করছে এই দম্পতি।
শিয়ালা ভবানীপুরে মাথা গুজবার জন্য এক টুকরো সরকারি জায়গায় উপর ছোট্ট মাটির বাড়িতে তাদের ঠাঁই হয়েছে মাত্র। বিভিন্ন এলাকায় বাউল গান করে কোনমতে চলে তাদের সংসার। গুণী বাউল শিল্পী হিসেবে এই দম্পত্তির পরিচয় সর্বত্র।
বিভিন্ন সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাদের মধুর কন্ঠে মুগ্ধ করেন দর্শক স্রােতাদের, কিন্তু বাউল গানের আসর ভেঙ্গে গেলে সহজে কেউ আর তাদের রাখেনা মনে।
সম্প্রতি এক সাক্ষাতকারে বাউল সাহেব আলী জানান, আমি জন্মান্ধ বলেই প্রথমে নিজ পরিবারেই ছিলাম অবহেলিত। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে আমি ছিলাম পিতা-মাতার দ্বিতীয় সন্তান। বুদ্ধির পর থেকেই নিজ পরিবার ও সমাজের মানুষ আমাকে দেখতো অনেকটা বাঁকা চোখে। আপনজন ও মানুষের কটাক্ষে জীবনটা বিষিয়ে উঠত প্রতিটা মুহুর্তে। মাত্র দশ বছর বয়সে মনের কষ্টে মহাস্থানগড় সুলতান বাবার মাজারে গিয়ে মানুষের দেওয়া ছিন্নি খেয়ে জীবন-যাপন শুরু করলাম।
অল্পদিনের মধ্যেই মহিমাগঞ্জের বাউল শামসুল হকের সাথে আমার পরিচয় হয়। তিনি আমাকে তার বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার পর তার সাথে হাট-বাজারে ও পথে-প্রান্তরে আসরে গিয়ে শুরু করলাম গান-বাজনা। সেখানে প্রায় ৮ বছর থাকার পর ওস্তাদ শামসুল হক মারা গেলেন। তিনি মারা যাওয়ার পর দুতারা গলায় ঝুলিয়ে ১৯৮৭ সালের দিকে ভারতের রায়গঞ্জে গিয়ে ওস্তাদ নিতাই বাউলের কাছে বাঁশি, হারমনিয়াম, ঢোল বাজানো শিখে চলে আসলাম নিজ দেশের মাটিতে।
এরপর পরিচয় হলো নওগাঁ জেলার রাণীনগর উপজেলার আবাদপুকুরের বাউল ময়েজ উদ্দিন শাহের সাথে। তার বাড়িতে থেকেই বিভিন্ন আসরে যেতাম বাউল গান গাইতে। ময়েজ উদ্দিনের পালিত কন্যা নার্গিসের সাথে জুটি বাঁধলাম আমি। দুজন মিলে হয়ে গেলাম বাউল দম্পত্তি।
নার্গিস বেগম জানান, আমার জন্মস্থান রাজশাহী জেলার বাঘমারা উপজেলায়। মা-বাবার তাদের চেহারা দেখেছি বলে আমার মনে নেই। রাণীনগরের বান্দাইখাড়া গ্রামের নানীর কাছে রাখা হয়েছিলো আমাকে। নানীর সংসারে অভাব-অনটনের কারণে আমার আশ্রয় হয় পালিত বাবা ময়েজ উদ্দিনের কাছে। সেখান থেকেই বাউল সাহেব আলীর সাথে বাঁধলাম ঘর-সংসার।
আমাদের দুজনের নেই কোনো লেখা-পড়া। অসতর্কতায় আমাদের ঘরে পাঁচ কন্যা ও এক পুত্র সন্তান। অনেক কষ্টে বিয়ে দিয়েছি ৩ কন্যার। এক ছেলে বিয়ে করে মসজিদে নামাজ পড়িয়ে কোনোমতে সংসার চালায়। ছোট দুই কন্যার একজন ষষ্ঠ ও আরেকজন সপ্তম শ্রেণীতে পড়াশনা করছে। আমরা দুজন জীবন-জীবিকার জন্য বিভিন্ন আসরে বাউল গান গাই।
করোনার মহামারিতে কোথাও গানের আসর হচ্ছেনা, তাই আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। অভাব-অনটনের এই সংসার এখন চালায় কেমন করে। তারপর দুই কন্যার পড়াশুনার খরচ যোগার করবো কি করে। সরকারি জায়গার উপর ছোট কুঠির কখন ভেঙ্গে পড়বে তার নাই ঠিক। এই বর্ষাকালে বড়ই ভয় কখন কি হয়। এই গুণী বাউল দম্পত্তি জানান, সরকারিভাবে একটি বাড়ি করে দিলে তাদের আর কোন আবদার থাকবে না।
এই দম্পতি সম্পর্ক কাহালু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মাছুদুর রহমান জানান, এই বাউল দম্পত্তির বাড়ি তৈরির জন্য তালিকা পাঠানো হয়েছে। সরকারি আর কোন সুযোগ থাকলে অবশ্যই তাদের জন্য ব্যবস্থা করা হবে।