কোরবানির ঈদ ঘিরে এবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে জাল টাকার কারবারীরা। অসাধু চক্রের ওই অপতৎরতা রোধে কঠোর অবস্থান নিয়ে মাঠে নেমেছে পুলিশ। ইতিমধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ইতিমধ্যে দেশী-বিদেশী জাল টাকার কারবারি চক্রের অর্ধশতাধিক সক্রিয় গ্রুপের খবরন জোরদার অভিযান শুরু করেছে। জাল টাকার কারবারীদের প্রধান টার্গেট থাকে পশুরহাটে আসা ব্যাপারীরা। দেশব্যাপী ওই চক্রের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। জালনোট বাজারে ছড়িয়ে দিতে নানা কৌশল বেছে নেয়া হয়। তবে ওসব চক্রের অপতৎপরতা নিষ্ক্রিয় করতে ইতিমধ্যেই গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, জাল টাকার চক্রের সদস্যদের বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তথ্য সংগ্রহ করছে। ইতিমধ্যে বেশকিছু চক্রের মুভমেন্ট পাওয়া যাচ্ছে। তবে কিছু কিছু ঘটনা ঢাকার বাইরে ঘটছে। ঢাকায়ও তৎপরতা চালানোর চেষ্টা করা হবে। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলো জাল টাকার কারবারীদের অপতৎপরতা রোধে কঠোর অবস্থান নিয়ে মাঠে রয়েছে। যে কোনো সময় জালনোট তৈরি কারবারীদের গ্রেফতারে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
সূত্র জানায়, বিভিন্ন সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী উদ্ধার করা শতাধিক কোটি জাল টাকার মধ্যে ভারতীয় রুপী, ইউএস ডলারসহ বিভিন্ন দেশের মুদ্রা রয়েছে। ওসব অভিযানে জালনোট তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জামাদি ল্যাপটপ, প্রিন্টার, ডাইস, কাটার, কোটি কোটি টাকার সমপরিমাণ জাল নোট প্রস্তুতের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল কাগজ, কালি, জলছাপ দেয়ার সমাগ্রী উদ্ধার করা হয়। অভিযান পরিচালনাকারীর মধ্যে র্যাব, পুলিশ, সিআইডি, ডিবি, গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট রয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর এবং ভাটারা থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৪ কোটি টাকা সমমানের জালনোট (১০০০ টাকার নোট) এবং ৪০ লাখ টাকা সমমানের (৫০০ ও ২০০০ রুপীর নোট) ভারতীয় রুপীসহ একটি চক্রের ৬ সদস্যকে আটক করে র্যাব-২। গ্রেফতারের পর তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আটক হওয়া আসামিরা খুব নিখুঁতভাবে জালনোট তৈরি করে আসছিল। চক্রের সদস্যরা ১০০ টাকার নোট পানিতে সেদ্ধ করে টাকার রং তুলে শুকিয়ে গেলে ওই টাকার কাগজের ওপর ৫০০ টাকার ছাপ দিতো। এতে টাকার গোপন নকশা, জলছাপ ও নিরাপত্তার সুতা অক্ষুণœœ থাকতো। তাছাড়া গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কদমতলীতে অভিযান চালিয়ে ৪৫ লাখ টাকা সমমানের জালনোটসহ একটি চক্রের তিন সদস্য গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ। অভিযানে গ্রেফতার হওয়া আসামিদের কাছ থেকে জালনোট তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম, একটি ল্যাপটপ, একটি প্রিন্টার, একটি পেনড্রাইভ এবং চার বান্ডিল কাগজ জব্দ করে গেয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।
সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে সারাদেশে জাল টাকার কারবারী চক্রের বিরুদ্ধে প্রায় দেড় হাজার মামলা বিচারাধানী রয়েছে। গত ১০ বছরে দেশের বিভিন্নস্থানে অভিযান চালিয়ে দেশী-বিদেশী জাল টাকার কারবারি চক্রের প্রায় ৫ হাজার সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। তার মধ্যে একই ব্যক্তি একাধিকবার গ্রেফতার হওয়ার পরও জামিনে বের হয়ে আবারো জাল টাকার কারবারে তৎপরতা চালাচ্ছে এমন নজিরও রয়েছে। তাছাড়া গ্রেফতারকৃত জাল কারবারীর মধ্যে নারী সদস্যও আছে। কিন্তু ৭-৮ মাস বা বছরখানেক পর তারা কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে পুরনো পেশায় ফিরে যাচ্ছে। কারাগার থেকে বের হওয়ার পরপর পুরনো সব সঙ্গী ও সহযোগীদের নিয়ে তারা স্থান পাল্টে আবার শুরু করছে জালনোট তৈরির কারবার। মূলত বিভিন্ন উৎসবকে টার্গেট করে বাজারে জালনোট ছাড়তে চক্রের সদস্যরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। তবে বর্তমানে জালনোট চক্রের যেসব সদস্য জামিনে বের হয়েছে এবং যাদের বিরুদ্ধে জালনোট প্রস্তুতের অভিযোগ বা তথ্য রয়েছে তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তাছাড়াও দেশব্যাপী পশুরহাটগুলোতে জালনোট বিস্তার রোধে এবং বাজার থেকে জালনোট উদ্ধারে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। একই সঙ্গে পশুরহাটগুলোতে ব্যাপারি ও ক্রেতা-বিক্রেতা এবং অন্য ব্যবসায়ীদের লেনদেনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে অনুরোধ জানিয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তারা।
এদিকে র্যাব সদর দফতরের তথ্যানুযায়ী বাহিনীর প্রতিষ্ঠালগ্ন (২০০৪ সাল) থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে এক হাজার ১৫১টি অভিযানে ১ হাজার ৮৮৮ জন দেশী-বিদেশী জালনোট প্রস্তুতকারী ও কারবারি গ্রেফতার হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে এক হাজার ১০০টি মামলা দায়ের করে র্যাব। ওসব অভিযানে ১১ কোটি ২০ লাখ ৬১ হাজার ৭৯৪ টাকা সমমানের জালনোট (দেশ) জব্দ করে। তাছাড়াও অভিযানে বিদেশী জালনোট ৪৫ লাখ ৪৯ হাজার ৯১৭ টাকা, ৪ কোটি ৩৬ লাখ ৭৫ হাজার ৬০০ ভারতীয় রুপী, ১৫ লাখ ৫৬ হাজার ২৯২ ইউএস ডলার, ৪৭ হাজার ইউরো, ১৫ হাজার ১৮০ সৌদি রিয়াল, ৮ হাজার ৫৬০ ইরাকী দিনার, ১৪ হাজার ২৭ ইউএই মুদ্রা, ২ লাখ মিয়ানমারের কোয়াট, ৩ হাজার ৪০০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত, ৫১ হাজার ৫০ পাকিস্তানী রুপী, ২ লাখ ৫০ হাজার তুরস্কের টাকার জালনোট/মুদ্রা জব্দ করা হয়। তাছাড়াও পুলিশের বিভিন্ন থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের অভিযানে অসংখ্য জালনোট তৈরির কারবারি গ্রেফতার হয়েছে।
অন্যদিকে সিআইডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, একাধিক চক্র জাল টাকা ও ভারতীয় রুপী তৈরি করে মজুদ রাখা এবং রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে সরবরাহ করছে। গোয়েন্দারা ওসব চক্রের সঙ্গে ভারতীয় একাধিক জালনোট প্রস্তুতকারক চক্রের যোগাযোগ থাকার তথ্য পেয়েছে। জাল টাকার কারবারি চক্র আসন্ন কোরবানি ঈদের বাজারে বিপুল পরিমাণ জাল টাকা ছাড়ার পরিকল্পনা নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের নেটওয়ার্ক শনাক্ত এবং জড়িত অন্যদের গ্রেফতারে কাজ চলছে। করোনাকালীন এ সময়ে জাল টাকার এ ছড়াছড়ি দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে দুর্বল করে দিতে পারে। জাল টাকার একটি বিশাল সিন্ডিকেট দেশের অভ্যন্তরে কাজ করছে। কিছুদিন জেলে থাকার পর আবার বেরিয়ে এসে একইভাবে তারা জাল টাকার কারবার শুরু করে। আসন্ন ঈদ-উল আজহাকে কেন্দ্র করে কোটি কোটি টাকার জাল নোট ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনার খবরের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।