গত ৩০ বছরের রেকর্ড ভেঙে তিস্তার পানি দোয়ানী পয়েন্টে এবার বিপৎসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপরে প্রবাহিত হয়। এবার ধরলার পানিও শিমুলবাড়ি পয়েন্টে ছিলো বিপৎসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার বেশি। ফলে দুই দফা বন্যায় লালমনিরহাটে এবার কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
অবকাঠামোগত ক্ষয় ক্ষতির পাশাপাশি ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে সেতু, কালভার্ট, রাস্তাঘাট, মৎস্য খামার ও নানান জাতের ফসল।
বুধবার (২২ জুলাই) সকাল সাড়ে ১১টায় জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবু জাফর লালমনিরহাটে বন্যায় এই ক্ষতির কথা নিশ্চিত করেছেন।
এবছর জেলার পাঁচটি উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ মারাত্মকভাবে বন্যা কবলিত হয়েছিল। এতে ৫শ ৭২টি পুকুরের মাছ ও এক লক্ষ পোনা ভেসে গেছে। ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৬ লাখ টাকা।
লালমনিরহাট জেলা মৎস কর্মকর্তা এএসএম রাসেল বলেন, খামারিদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা হবে। এরইমধ্যে বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ঘুরে দাঁড়াতে খুব বেশী বেগ পেতে হবে না বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে কৃষি বিভাগের ২শ ৭৭ হেক্টর জমির আউশ ও আমন ধানের বীজতলা ভেসে গেছে। আসছে আউশ আমন মৌসুমে বীজ তলার সংকটের আশঙ্কায় আছেন চাষীরা। যদিও ভাসমান বীজতলার ওপর ভরসা করছে দপ্তরটি। এছাড়াও সাড়ে ৮ হেক্টর জমির ভুট্টা, সাড়ে ১০ হেক্টর জমির বাদাম, সবজি ও মরিচ তলিয়ে গেছে। ক্ষতির পরিমান নিরূপন করা হয়েছে ৫৫ লাখ ৫০হাজার টাকা।
বানের পানিতে ভেসে গেছে কয়েক হাজার হাস-মুরগি ও গরু-ছাগলের খাদ্য। আনুমানিক ক্ষতির পরিমান ধারনা করা না গেলেও চরম সংকটে পড়েছেন উৎপাদনকারী ও খামারিরা। পাশাপাশি দুর্গত এলাকায় গৃহপালিত এসব পশুর নানা রোগব্যাধীও দেখা দিয়েছে।
তিস্তার চরাঞ্চল ও নদী তীরবর্তী এলাকার রাস্তা-ঘাট ডুবে যাওয়ায় চরাঞ্চল গুলো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো। বন্যার পানি কমলেও গবাদি পশু-পাখি নিয়েও চরম বিপাকে চরাঞ্চলের মানুষ গুলো।
তিস্তার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জেগে ওঠা চরে বাদাম ও ভুট্টাসহ নানা জাতের সবজি চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করত চরাঞ্চলের মানুষ। অনেকেই গবাদি পশু পালন ও মাছ চাষ করেও সংসারের চাকা সচল রেখেছেন। গত এক মাস ধরে থেমে থেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় চরাঞ্চলের চাষিদের উঠতি ফসলের ক্ষেত বন্যার পানিতে ডুবে যায়। ভেসে যায় শত শত পুকুরের মাছ। বিশেষ করে বাদাম ক্ষেতের অভাবনীয় ক্ষতি হয়েছে চলমান বন্যায়। চরাঞ্চলের সব থেকে লাভবান ফসল বাদাম, এ বছর বন্যায় ডুবে যাওয়ায় তা ঘরে তুলতে পারেননি চাষিরা।
এছাড়াও নদীতীরবর্তী ২৭টি স্থানে ভাঙ্গন দেখা দেওয়ায় সাড়ে ১০ কিলোমিটার নদীপাড় ও ছয়টি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আড়াই কিলোমিটার বিলীন হয়েছে বলে জানিয়েছে পাউবো। পরিস্থিতি মোকাবেলায় এরইমধ্যে জরুরী কাজের অংশ হিসেবে কাজ শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। লালমনিরহাট পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, উদ্ধোর্তন কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো অবগত রয়েছেন। টেকসই পদক্ষেপ নিতে নানা কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।
এবারের বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা এলাকার বেশ কিছু স্থান। তিস্তা নদী ভারতীয় অংশে ভাঙছে না, অনবরত ভাঙছে বাংলাদেশি অংশে। ফলে বিলীন হচ্ছে দহগ্রাম আঙ্গরপোতার বিস্তীর্ণ এলাকা। এখানকার সর্বস্ব হারানো পরিবারগুলো দ্রুত ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেয়ার আবেদন জানিয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, সীমান্তের ওপারের মেখলিগঞ্জ দিয়ে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রামে প্রবেশ করেছে ভারতের সিকিমে উৎপত্তি হওয়া নদী তিস্তা। এরপর কিছুটা পথ বেয়ে দহগ্রাম ইউপির সর্দারপাড়া নামক এলাকা। ওইদিন রাতেই তিস্তার পানি বৃদ্ধিতে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজ এলাকায় সবগুলো গেট বন্ধ করে দেয়। এতে পানির গতি পরিবর্তন হয়ে দহগ্রামের সর্দারপাড়া নামক এলাকায় ঢুকে পড়ে তিস্তার পানি।
চলতি বন্যায় ক্ষতির মুখে পড়েছে এলজিইডি বিভাগও। ২শ মিটার সংযোগ সড়ক ও ১০ কিলোমিটার সড়ক ভেঙে ক্ষতি হয়েছে অন্তত ২ কোটি টাকা। এর বাইরে ফুলবাড়ি-লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কের ৩০কিলোমিটারে বিভিন্ন স্থানে গর্ত ও ভাঙনে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ।
বিভিন্ন স্থানে সরকারি-বেসরকারি বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ঘরবাড়ি ভেঙে গেলেও অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিরূপন করতে পারেনি জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর। তিনি বলেন, বন্যা ও নদী ভাঙনের কবল থেকে বাঁচিয়ে জেলার উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে নদী শাসন ও টেকসই পদক্ষেপ নেয়া এখন জরুরী পড়েছে।
এব্যাপারে সরকারের আন্তরিকতারও অভাব নেই। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ চলমান রয়েছে বলেও জানান তিনি।