মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলায় বন্যা ও নদী ভাঙনের সাথে ভারি বর্ষণে পরিস্থিতি চরম আকার ধারন করছে। অতিবৃষ্টি ও উজানের অতিরিক্ত পানি প্রবাহের কারণে বৃহস্পতিবার পদ্মায় মাওয়া পয়েন্টে নদীর পানি বিপদসীমার ৭৪ সেন্টিমিটার এবং ভাগ্যকূল পয়েন্টে ৮৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
ফলে উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের সবকটি বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এসব ইউনিয়নের ৪৯টি গ্রামের ১৫ হাজারের বেশি পরিবার পানিবন্ধী হয়ে পড়েছেন। অনেক এলাকায় ঘরের মধ্যে কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর, কোথাও বুক সমান পানি। জেলার প্রধান সড়ক মাওয়া-বালিগাঁও-মুন্সীগঞ্জ সড়কের মালির অঙ্ক বাজারের পশ্চিম অংশে হাঁটুপানি উঠে গেছে। স্থানীয়রা বালুর বস্তা ফেলে সড়কটির ভাঙন রোধের চেষ্টা করছেন। তবে যে কোনো সময় জেলা সদরের সঙ্গে লৌহজং উপজেলা ও দক্ষিণাঞ্চলের সড়কপথে যাতায়াত বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকার কাঁচা ও পাকা রাস্তা বন্যার পানিতে ডুবে গিয়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। করোনা ও বন্যা পরিস্থিতির কারণে এখানকার শত শত মানুষ এখন কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া বন্যার পানি বৃদ্ধি এবং পদ্মায় ভাঙন শুরু হওয়ায় চরাঞ্চলের মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে চরাঞ্চলের কৃষকেরা তাদের গবাদিপশু, হাঁসমুরগী নিয়ে মহাবিপদে পড়েছেন। পদ্মার তীব্র স্রােতে একের পর এক বসতবাড়ি ও জমি বিলীন হয়ে গেছে। এক সপ্তাহে ওই ইউনিয়নের ৩ শতাধিক বাড়ি পদ্মাগর্ভে তলিয়ে গেছে। পদ্মার চরের শতভাগ বাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। ভাঙনের সাথে তালমিলিয়ে চরের বাসিন্দারা বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নিতে হিমসিম খাচ্ছে। ঘরবাড়ি সরিয়ে নিতে দিনমজুর পাওয়া যাচ্ছে না। আর পাওয়া গেলেও দ্বিগুণ মজুরী দিতে বাধ্য হচ্ছে।
উপজেলার লৌহজং-তেউটিয়া ইউনিয়নের পদ্মা তীরবর্তী পাইকারা গ্রামের সোহরাব হোসেনের সাথে কথা হয়। তিনি এদিন ট্রলারে ঘর বাড়ী ভেঙে এনে লৌহজং-তেউটিয়া ইউপি ভবনের সামনে নামাচ্ছিলেন। তিনি দুঃখভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, বসতবাড়ি-জমিজিরেত সব পদ্মা গিলে খেয়েছে। করোনার কারণে হাতে টাকাপয়সা নেই। বাড়িঘর অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে মিস্ত্রি ও শ্রমিকদের পারিশ্রমিক দিতে কষ্ট হচ্ছে। ১৩টি গরুবাছুর নিয়ে মহাবিপদে আছি। সামান্য একটু উঁচু রাস্তায় নিয়ে রেখেছি। ঝাউটিয়া চরের কৃষক মিজান ঢালী বলেন, করোনার জন্য এমনিতেই মরার মতো আছি, তার উপর এই বন্যা ও পদ্মার ভাঙনে আমরা কিভাবে বাঁচবো? গরুছাগল, ঘরবাড়ি নিয়ে কোথায় উঠব, মাথায় আসে না। অপর কৃষক আবুল মোল্লা বলেন, দুই যুগ আগে পদ্মার পেটে বসতবাড়ি ও জমি চলে যাওয়ার পরে এই চর জেগেছিল। এখানে গরুছাগল লালনপালন ও জমিচাষ করে দিন চলে যাচ্ছিল। ১৭ বছর পরে আবার নদীতে সব ভেঙে গেল। এখন আবার কোথায় যাবো, জানি না।
বেজগাঁও ইউনিয়নের বড় বেজগাঁও এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পাটাতনের টিনের ঘরগুলোতে পানি প্রবেশ করেছে। অনেক ঘরে পানি ছুঁই ছুঁই অবস্থা। ঘরের দরজার সামনে বসে মাটির চুলা ও শুকনো লাকরী গোছগাছ করছেন, কেউ কেউ রান্না করছিলেন। কথা হয় শিউলির সাথে তিনি বলেন, চারশ' হাত পাশেই পদ্মা নদী। বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়া এক সপ্তাহ আগে তাদের বাড়ির উঠানে পানি ওঠে। তিনদিন আগে রান্না ঘর, টিউবঅয়েল পানিতে ডুবে গেছে।থাকার ঘরেই রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া তাদের। দুদিন ধরে পানি আরও বেড়েছে। এতে থাকার ঘরটিও প্লাবিত হতে পারে। ওই এলাকার মো. আল-আমিন জানান, বন্যায় পানিবন্ধী হয়ে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে আছেন তারা। একই অবস্থা হলদিয়া ইউনিয়নের শিমুলিয়া এলাকায়। সেখানেও একসপ্তাহ ধরে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। দিনদিন পানি বেড়ে ওই এলাকার প্রায় ৪শ' পরিবার পানিবন্ধী আছে।
সেখানকার শাহিন কাদের বলেন, তাদের এলাকার মানুষজন করোনা ও বন্যার কারণে মানবেতর জীবনযাপন করছে। তবে সামান্য কিছু সরকারি সহযোগিতা তারা পেয়েছেন। তিনি বলেন, বাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সাপের ভয়, বন্যা, অভাব ও বাচ্চা পানিতে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটার ভয়ে দিন কাটছে তাদের।
লৌহজং উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সাজেদা সরকার জানান, বন্যার্তদের জন্য ১৭টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত আছে। আমরা গত দুদিনে ক্ষতিগ্রস্ত ৮০০ পরিবারের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করেছি। এ ছাড়া ৫৫০টি পরিবারকে ১০ কেজি করে ৫৫ মেট্রিক টন চাল দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কাবিরুল ইসলাম খান বলেন, প্লাবিত এলাকাগুলোর মধ্যে চরাঞ্চলের মানুষ গবাদিপশু নিয়ে বেশি বিপাকে রয়েছেন। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গবাদিপশু রাখার জন্য একটি বিশাল আকারের ছাউনি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী রয়েছে। ইতোমধ্যে বন্যাকবলিত দুই হাজার পরিবারের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। সাহায্য-সহযোগিতা অব্যাহত আছে। অন্যরাও দ্রুত ত্রাণসামগ্রী পাবে।