গ্রীষ্মের তাপদগ্ধ প্রকৃতিকে সজল বষর্ণে সিক্ত করে দিয়ে স্ব-গৌরবে প্রকৃতিতে এসেছে বর্ষা। খালে বিলে টইটুম্ভর বর্ষার পানি। আর বর্ষা ঋতুকে কেন্দ্র করে স্বরূকাঠী উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী জেলা ও উপজেলার বিল ও চরাঞ্চলের মানুষের যাতায়াত, ব্যাবসা-বাণিজ্যেসহ নানা কৃর্ষি কাজ উপলক্ষ করে স্বরূপকাঠীতে বসেছে বিখ্যাত নৌকার ভাসমান হাট। পিরোজপুর জেলা ও বরিশাল বিভাগের বিল অঞ্চলের মানুষের উপরিক্ত কাজে শত বছর ধরে স্বরূপকাঠীর সন্ধ্যা নদীর শাখা খালে আটঘরে জলে ডাঙ্গায় চলে আসছে এ নয়নাভিরাম নৈাকার হাট। সভ্যতার বিকাশে নানা ইঞ্জিন চালিত ট্রলার ও ষ্টিমারের রাজত্ব থাকলেও প্রতি বছর বর্ষা ঋতুতে এ অঞ্চলের মানুষের যাতায়াত ও যাবতীয় ছোটখাট ব্যাবসা-বাণিজ্যে কদর বাড়ে নৌকার। তাইতো উপজেলার এই ভাসমান নৌকার হাটে বিভাগের দূর-দূরান্ত থেকে আসা ক্রেতা, বিক্রেতা ও নৌকার হাট দেখার উৎসুখ জনতার ভীড়ে আটঘরে সরগম হয়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দিত নৌ সাম্রজ্য। সপ্তাহে প্রতি শুক্রবার কুড়িয়ানার আটঘরের খালে ও রাস্তার উপর প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বসে দক্ষিণ বঙ্গের বৃহত্তম এই নৌকার হাট। সরেজমিনে শুক্রবার নৌকার হাট ঘুড়ে নৌকা ক্রেতা, বিক্রেতা ও হাট দেখা কৌতহূলি হাজারো মানুষের ভীড় দেখে মনে হল কালের গর্ভে বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য যেন স্বরূপকাঠীতে সবই আছে। স্বরূপকাঠী কাঠ ব্যাবসায় খ্যাত উপজেলার ১০ ইউনিয়নের ১৩ টি গ্রামের প্রায় দেড় সহস্রাধিক পরিবার বশং পরম্পপরায় এ পেশা দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করে আসছে বলে জানান স্থানীয়রা। এ হাটে পাশ্ববর্তী উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নৌকার হাটে আসেন শতাধিক ক্রেতা, বিক্রেতারা। ঝালকাঠীর পাষন্ডা গ্রাম থেকে আসা নৌকা মিস্ত্রি সঞ্জয় গরামী(৩৫) জানান, ১৫ বছর ধরে সে এ নৌকার হাটে আসছে। আজকের হাটে সে ৭টি নৌকা এনেছে বেচা-বিক্রি খুব ভাল বলে মনে হয়েছে তার কাছে। তিনি আরো জানান, নৌকার আকার ও প্রকারভেদে ৭০০ টাকা থেকে শুরু করে ৫ হাজার টাকার নৌকা ওঠে এ হাটে। আমড়া, আম, রেইনট্রি, কড়াই ও চাম্বল কাঠ তৈরী হাটে আসা সিংহ ভাগ নৌকা। হাটে আসা একাধিক নৌকা বিক্রেতা ও স্থানীয়দের কাছে জানা যায়, বর্ষা মৌসুমে অত্র উপজেলার দেশ বরণ্য কুড়িআনার আপেল খ্যাত পেয়ারা, আমড়া, চাই দিয়ে মাছ ধরা এবং গো খাদ্য সংগ্রহে নৌকার কদর বেশি থাকে। স্থানীয় নৌকা ব্যাবসায়ী ফরিদ মিয়া জানান, অত্র অঞ্চলের মানুষেরা নৌকায় করে খালের মধ্য ছোট খাট ব্যাবসা বানিজ্যে করে থাকে। সে কারণে পেনিস নৌকার চাহিদা একটু বেশি। নৌকা মিস্ত্রি আলিম বলেন, একটি পেনিস নৌকা তৈরিতে তার এক থেকে দেড় দিন সময় লাগে। কাঠ ও মজুরি মিলিয়ে তার খরচ পড়ে ৬০০-৭০০টাকা। যা তিনি ৪০০-৫০০ টাকা লাভে বিক্রি করেন। উপজেলার চামী গ্রাম থেকে আসা নৌকা ব্যাবসায়ী মোঃ জহিরুল জানান, ৩০ বছর পর্যন্ত সে এই নৌকার হাটে আসছে। সে জানায়, প্রতি জৈষ্ঠ্য থেকে বাংলা আশ্বিন মাস পর্যন্ত এ হাটে নৌকা কেনা-বেচা ধুম থাকে। তবে আষাঢ় ও শ্রাবণে বেচা-বিক্রিতে মহা ব্যাস্ত থাকে হাটের নৌকা বিক্রেতারা। ঝালকাঠীর বিনয়কাঠি থেকে আসা নৌকা ক্রেতা মোঃ সাইদুল বলে উঠলেন, এবছর হাটে নৌকার দাম বেশি। গত বছর যে নৌকা ২৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে সে নৌকা এবার ৩০০০-৩৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বলদিয়া থেকে নৌকার হাটে আসা নৌকা মিস্ত্রি সাদিক জানান, ১৯৭৪ সাল থেকে সে নিজ হাতে নৌকা বানিয়ে একসাথে ২৫-৩০ টি নৌকা নিয়ে হাটে আসে। তিনি জানান, একটি ১২ হাতি নৌকা তৈরীতে একজনের সময় লাগে ৩-৪ দিন। যাহার মজুরি ও কাঠ মিলিয়ে খরচ পড়ে ২২০০-২৫০০ টাকা। যা ৮০০-১০০০ টাকা লাভে সে বিক্রি করে থাকে। সাদিক আরো বলেন, এবছর নৌকা তৈরীতে কাঠপাটসহ সব কিছুর মজুরি বৃদ্বিতে নৌকার দাম বেশি বলে তিনি দাবি করেন। নৌকা ব্যাবসায়ী ও হাটের স্থানীয়রা জানান, প্রতি বছর এ মৌসুমে বরিশালজেলা সহ দক্ষিণাঞ্চলের দূর-দূরান্ত থেকে সহস্রাধিক নৌকা ক্রেতা ও ব্যাবসায়ীরা বড় বড় ট্রলার ও নসিমন যোগে এসে এক সাথে ১৫-২০ টি নৌকা কিনে অনত্র নিয়ে যায়। তারা জানান, প্রতি হাটে এই খালে তিন থেকে আড়াই হাজারেরও বেশি নৌকা বিক্রির উদ্দেশে পসরা সাজিয়ে থাকেন ব্যাবসায়ীরা। নৌকার বিক্রির সময় সাতে বৈঠা দেওয়া হয়না। তাই আলাদা করে নৌকা কেনার পরে বৈঠা কিনতে হয় বৈঠা ব্যাবসায়ীদের কাছে। দুবির হাট থেকে আসা বৈঠা ব্যাবসায়ী মোঃ মহাসিন বলেন, ৭৫ টাকা থেকে শুরু করে আকার ও কাঠ অনুযায়ী ৩০০ টাকায় বিক্রি হয় একেকটি বৈঠা। হাটে আসা একাধিক নৌকা মিস্ত্রি ও ব্যাবসায়ীরা জানিয়েছেন, উপজেলার স্বরূপকাঠী এবং মিয়ারহাট ও ইন্দ্রেরহাট থেকে তারা সহজলভ্যে কাঠ কিনে হাটে আসা এসকল নৌকা তৈরী করে থাকেন। উপজেলার শেকেরহাট, দলহার, কুড়িয়ানা, আতা, বেঙ্গুলি ও ডুবিরহাট, একতা, পঞ্চবেকিরসহ এখানকার মানুষেরা নৌকা তৈরীতে পারদর্শী।হাটে আসা নৌকা ব্যাবসায়ীরা জানিয়েছেন, হাটের ইজারাদাররা তাদের নিকট থেকে প্রতি ১০০টাকায় ১০-১২ টাকা খাজনা নিচ্ছে। যা অন্যন্যেবারের তুলনায় বেশি। এছাড়াও হাটে ব্যাবসায়ীদের বসার জন্য কোন ব্যাবস্থা করেনা ইজারাদাররা। তাই রোদে পুড়ে ও বৃষ্টিতে ভিজে তাদের ব্যাবসা করতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তারা। নৌকার হাটের ইজারাদার মনোজ কুমার জানান,“ এখানে কোন অতিরিক্ত খাজনা নেওয়া হয়না। আর যেহেতু হাটটি বসে থাকে রাস্তাসহ খালের ভিতরে। তাই এখানে বসার কোন ব্যাবস্থা করা যাচ্ছেনা।