কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার নদীর পানি সামান্য কমে তা এখনো বিপদসীমার উপর প্রবাাহিত হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির তেমন কোন উন্নতি হয়নি। বরং মাস ব্যাপী এ দু’টি নদীর পানি বিপদসীমার উপর থাকায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। এ অবস্থায় নদী বেষ্টিত এ জেলার নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলের প্রায় ৪লক্ষাধিক বন্যা দূর্গত মানুষ খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশনের অভাবে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। অধিকাংশ কৃষক পরিবার গো-খাদ্যের অভাবে তাদের গবাদি পশু নিয়ে অবর্ণনীয় কষ্টে দিন পাড় করছেন। এই দীর্ঘ সময় পানিবন্দি থাকা দূর্গম চরাঞ্চলের পরিবারগুলো বন্যা আরও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার পূর্বাভাস পেয়ে বাধ্য হয়ে ঘর-বাড়ি ছেড়ে পরিবার-পরিজন, গৃহপালিত পশু ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে উঁচু এলাকায় আশ্রয় নিতে শুরু করেছে । এতে করে উঁচু বাঁধ, পাকা সড়ক ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাড়ছে বন্যা দূর্গত মানুষের সংখ্যা।
ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়ের মশালের চর, বালাডোবার চর ও যাত্রাপুর ইউনিয়নের পোড়ার চর, চর যাত্রাপুরসহ কয়েকটি চরের বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা মূলত ব্রহ্মপুত্রের পানি কমে যাওয়ার আশায় দীর্ঘ এক মাস বা তারও বেশি সময় ধরে নৌকায় এবং ঘরের ভিতর এক বুক আর গলা পানিতে মাঁচাং, চালের সাথে ঠেকিয়ে বসবাস করে আসছিল। কিন্ত অন্যান্য বছরের রেকর্ড ভেঙ্গে এবার এক মাসেরও বেশি দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে বন্যা। আপাতত পানি নেমে যাওয়ার কোনো লক্ষণ বোঝা যাচ্ছে না। এই দীর্ঘ সময়ে তারা মূলত বন্যার পানির উপর খাওয়ার কষ্ট, ঘুমানোর কষ্ট, বিশুদ্ধ পানির সংকট, স্যানিটেশনের কষ্ট, গৃহপালিত পশু খাদ্যের কষ্টকে শিকার করে দিন পাড় করছিল। এভাবে বসবাস করায় তাদের সমস্যাগুলো আরো বেড়ে যাওয়ায় তারা বাধ্য হয়ে উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিতে শুরু করেছে বলে ভুক্তভোগীরা জানায়। ফলে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে বাড়ছে বন্যা দূর্গতদের সংখ্যা।
জেলার বন্যা কবলিত দূর্গম এলাকার চর ও দ্বীপ চরগুলো ঘুরে দেখা গেছে, সেখানকার বেশির ভাগ চরের বাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে। পরিবার-পরিজন, গরু, ছাগল, ভেড়া উঁচুতে রেখে ২/৩জন করে বন্যার্ত মানুষ নৌকায় করে এসে ঘর-বাড়ি পাহাড়া দিচ্ছে। গত এক সপ্তাহ পূর্বে যে চরগুলোতে দূর্গত মানুষজন নৌকায় ও ঘরের ভিতর কষ্ট করে বসবাস করে আসছিল সেখানকার বেশিরভাগ ঘর-বাড়ি এখন ফাঁকা পড়ে আছে।
ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার চর যাত্রাপুর ইউনিয়নের চর যাত্রাপুরের ইয়াছিন আলী জানান, নদের অববাহিকায় তারা ১০টি পরিবার বসবাস করছিলেন। তারা কষ্ট করেই এতোদিন বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু এই এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পানি নামবে নামবে করে নামছে না। পানিতে ছোট ছোট বাচ্চা, গরু, ছাগল নিয়ে আর কতদিন থাকা যায়। তাই পার্শ্ববর্তী উঁচু সড়কে আশ্রয় নিয়েছেন তারা। এখন পালা করে নৌকায় বসে থেকে দিন-রাত ঘর-বাড়ি পাহাড়া দিতে হচ্ছে। বিশেষ করে পানির ¯্রােতে ঘর-বাড়ি ভেসে যাওয়া কি-না সে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে অনেকে।
অন্যদিকে কিছু চরের ঘর-বাড়িতে এক কোমর ও হাঁটু পানি থাকায় সেসব চরের বাসিন্দারা পানির মধ্যেই কষ্ট করে জীবন যাপন করছে।
এদিকে বন্যা কবলিত এলাকার সংশ্লিষ্ট ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানগণ তাদের কোন খোঁজ -খবর নিচ্ছেন না বলে আশ্রয়স্থলে থাকা মানুষজন অভিযোগ করেন। দূর্গত এলাকাগুলোতে সাংবাদিক দেখলে তারা ছবি তুলতে বাঁধা দিয়ে খাদ্য সহায়তা না পাওয়ার ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
এ ব্যাপারে সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো: আইয়ুব আলী সরকার ও বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারমম্যান বেলাল হোসেনের সাথে কথা বললে তারা বন্যা কবলিত মানুষের কষ্টের কথা স্বীকার করে জানান, তাদের ইউনিয়নে যে পরিমান বন্যা কবলিত পরিবারের সংখ্যা রয়েছে এবং যে পরিমান ত্রাণের চাল বরাদ্দ পেয়েছে তা দিয়ে অর্ধেক পরিবারকে দেয়া সম্ভব হয়নি।
জেলা প্রশাসক মো: রেজাউল করিম জানান, জেলার ৯ উপজেলায় বন্যার্তদের জন্য এ পর্যন্ত ১৯০ মেট্রিক টন চাল, ৯ লাখ টাকা, শিশু খাদ্যের জন্য ২ লাখ, গো-খাদ্যের জন্য ৪ লাখ টাকা ও ৮ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। তাদের কাছে আরো ত্রাণের চাল ও টাকা মজুদ আছে। প্রয়োজনে সেগুলোও বিতরণ করা হবে বলেও জানান তিনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডে নির্বাহী প্রকৌশলী মো: আরিফুল ইসলাম জানান, গত ২৪ ঘন্টায় ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। ব্রক্ষপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৭৩ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৬০ সেন্টিমিটার এবং ধরলার পানি সেতু পয়েন্টে বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।