বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প সংস্থার (বিসিআইসি) বগুড়া বাফার গুদামের ২৩৯ মেট্রিক টন সার বিক্রি করে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। বৃহস্পতিবার দুদকের উপপরিচালক আবু বক্কর সিদ্দিক বাদী হয়ে এই মামলা করেন। মামলা করা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত কার্যালয় বগুড়ায়।
মামলার আসামিরা হলেন, বগুড়া বাফার গুদামের সাবেক ইনচার্জ ও ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মো. আনোয়ার হোসেন। আর গুদামের দ্বিতীয় শীর্ষ পদের তৎকালীন কারিগরি কর্মকর্তা (উৎপাদন) মো. নাজমুল ইসলাম ভূঁইয়া।
গত বছরের ৩১ জানুয়ারি এই দুই কর্মকর্তাকে বগুড়া বাফার গুদাম থেকে বদলি করা হয়। আনোয়ার হোসেন জামালপুরের যমুনা সার কারখানায় ব্যবস্থাপক হিসেবে রয়েছেন। এই জায়গায় কারিগরি কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন নাজমুল ইসলাম।
দেশে কৃষকদের জন্য সার উৎপাদনের পাশাপাশি ঘাটতি পূরণে সার আমদানি করে বিসিআইসি। এসব সার যেসব গুদামে আপৎকালীন মজুত করা হয়, তাকে বাফার গুদাম বলে। দেশের ২৪টি বাফার গুদামের একটি বগুড়ার তিনমাথা এলাকায় অবস্থিত। এর ধারণক্ষমতা ১২ হাজার মেট্রিক টন। বগুড়ার সার নিয়ে আসা হয় সাধারণত সাউথ ডেলটা ট্রেডার্স, পোটন ট্রেডার্স, নওয়াব ট্রেডার্সসহ বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। নিয়ম অনুয়ায়ী, পরিবহন ঠিকাদার সার সম্পূর্ণভাবে বুঝিয়ে দিলে গুদামের ইনচার্জ একটি রসিদ দেবেন। সেই রসিদ দেখিয়ে ঠিকাদারেরা তাদের প্রাপ্ত টাকা বুঝে নেবেন। পরে বগুড়া গুদাম থেকে বিভিন্ন এলাকায় সার সরবরাহ করা হয়। আর সার বিক্রির টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার কথা।
তবে বগুড়া বাফার গুদাম থেকে ৩৩ লাখ ৪৬ হাজার টাকার সার বিক্রির টাকা সরকারি কোষাগারে জমা পড়েনি। বগুড়া বাফার গুদাম সূত্রে জানা গেছে, আনোয়ার হোসেন ও নাজমুল বদলির পর নতুন কর্মকর্তার দায়িত্ব গ্রহণের সময়ই পৌনে ২৩৯ মেট্রিক টন সার জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে। আনোয়ার হোসেনকে সরানোর পর বাফার গুদামের ইনচার্জ করা হয় ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) আকতারুল ইসলামকে। তিনি দায়িত্ব নিতে গিয়ে দেখতে পান, গুদামের সারের টাকা ব্যাংকে জমা পড়েনি। জেএফসিএলের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) ওয়ায়েছুর রহমান বিষয়টি খতিয়ে দেখা শুরু করেন।
বিষয়টি বিসিআইসির প্রধান কার্যালয়ের নজরে আসে। সংস্থাটির মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) মো. মঞ্জুর রেজা জেএফসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর একটি চিঠি দেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, বগুড়া বাফার গুদামের নিবন্ধনে সারের হিসাবের গরমিল রয়েছে। ব্যাংক হিসাবের সঙ্গে গুদামের হিসাবের অমিল ও গুদামের সরবরাহ করা পরিবহন ঠিকাদারদের সারের অনিয়ম বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। চিঠি পাওয়ার পর জেএফসিএল তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির আহ্বায়ক করা হয় জেএফসিএলের উপপ্রধান হিসাবরক্ষক দুলাল উদ্দিনকে।
এই তদন্ত কমিটি গত বছরের ৪ আগস্ট জেএফসিএল কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ২৩৯ মেট্রিক টন সার বগুড়া বাফার গুদাম থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। অথচ ওই সারের টাকা ব্যাংকে জমা পড়েনি। ওই সারের মূল্য ৩৩ লাখ ৪৬ হাজার টাকা।
গত বছর তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক দুলাল উদ্দিন মোবাইলে বলেন, তাদের তদন্তে গুদামের ২৩৯ মেট্রিক টন সারের অনিয়ম ও ১ হাজার ৭৯৩ দশমিক ৬৩ মেট্রিক টন সার লোপাটের প্রমাণ মিলেছে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুদামের কর্মকর্তারা জড়িত। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুদামের ২৩৯ মেট্রিক টন সারের অনিয়মের ক্ষেত্রে তৎকালীন গুদাম ইনচার্জ আনোয়ার হোসেন এবং কারিগরি কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম সমানভাবে দায়ী।
তবে নাজমুল ইসলাম তখন থেকেই বিষয়টি অস্বীকার করে আসছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি এক বছর হলো বগুড়া বাফার গুদাম থেকে চলে এসেছি। আমি এগুলোর সঙ্গে নেই।’
আনোয়ার হোসেন তখন মোবাইলে বলেছিলেন, ‘গুদামের ২৩৯ মেট্রিক টন সার ভুলে হয়তো কারও কাছে গেছে। বিষয়টি নিয়ে আমি কাজ করছি। এর মধ্যে কিছু সারের খবর পাওয়া গেছে। আর অন্য সারের বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। বিষয়টি তদন্ত হচ্ছে। আরও তদন্ত কমিটি গঠন হবে।’
সূত্র জানায় সার কেলেঙ্কারির এই ঘটনা নিয়ে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সদস্য ছিলেন বগুড়া দুদক কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক আমিনুল ইসলাম। তিনি বৃহস্পতিবার বিকেলে মোবাইলে জয়যুগান্তরকে বলেন, তদন্তে বগুড়া বাফার গুদামের ২৩৯ মেট্রিক টন সার বিক্রির টাকা আত্মসাতের বিষয়টি প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এই সার বিক্রি করে সারের ৩৩ লাখ ৪৬ হাজার টাকা (সরকারি মূল্য) তারা সরকারি কোষাগারে জমা দেননি। সরকারি এসব টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।