রফতানির জন্য স্থানীয় ক্রেতারা বেশি দামে পাট কিনতে চাইলেও বাংলাদেশ জুট মিল কর্পোরেশন (বিজেএমসি) বাজার থেকে কম দামে মজুদ সমুদয় পাট বিক্রির চুক্তি করেছে। নিয়মানুযায়ী সরকারি সব পাটকল বন্ধ করে দেয়ার পর বিজেএমসি যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কোন প্রকার অনুমতি না নিয়েই একক ক্ষমতায় শর্ত শিথিল করে বিজেএমসি সমুদয় পণ্য প্রচলিত বাজার মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে বিক্রির চুক্তি করে। শুধু কম দামই নয়, বিশেষ সুবিধা দিয়ে একটি বিতর্কিত বিদেশী ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কাছে সমুদয় পাট পণ্য বিক্রি করা হয়েছে। এমন অবস্থায় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় ক্ষোভ প্রকাশ করে কারণ দর্শানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এমনকি বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলেছেন। এ ব্যাপারে অভিযোগ দায়েরের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে থেকেও বিষয়টি অনুসন্ধান করা হচ্ছে। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ক্রমাগত লোকসানের মুখে গত পহেলা জুলাই থেকে বিজেএমসির ২২ জুট মিল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবে নতুন আঙ্গিকে জুট মিলগুলো চালু করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সরকারের তরফ থেকে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা হলেও এখনো বিজেএমসিতে কাঁচা পাট সরবরাহকারী এবং অবসর গ্রহণাকারী কর্মকর্তাদের বকেয়া প্রদানে অর্থায়নের ব্যবস্থা হয়নি। এমন অবস্থায় আর্থিক সঙ্কট কাটাতে বিভিন্ন কারখানায় মজুদ প্রায় লক্ষাধিক টন পাট পণ্য বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে বিজেএমসি। এ ব্যাপারে সংস্থাটির তালিকাভুক্ত রফতানিকারকরা এগিয়ে এসেছে। যুগের পর যুগ ধরে এই রফতানিকারকরাই উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রফতানির মাধ্যমে বিজেএমসিকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে পাট পণ্য তথা পাটের বস্তার চাহিদা বাড়ছে। আফ্রিকার দেশ সুদানে কৃষি পণ্যের উৎপাদন ভাল হওয়ায় এ চাহিদা বাড়ছে। অনুকূল পরিবেশের কারণে সুদানে এ বছর বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে দেশটির কৃষি পণ্য মোড়কীকরণের জন্য প্রায় দুই লাখ বেল পাটের বস্তা প্রয়োজন হবে। সুদানের ক্রেতাদের কাছ থেকে অগ্রিম টিটিতে পণ্য বিক্রির জন্য স্থানীয় রফতানিকারকরা গত ৩ আগস্ট বিজেএমসির কাছে প্রস্তাব জমা দেয়। তাতে প্রতি ১০০ পাটের বস্তার দাম দেয়া হয় ৯০ ডলার করে। প্রস্তাবে ২৩৯ কোটি টাকা মূল্যের এক লাখ ৪ হাজার ৯৭৫ বেল পাটের বস্তা ক্রয়ের ফার্ম দর প্রদান করা হয়। আর তা চূড়ান্ত দর আকারে প্রদান করা হতে পারে আঁচ করতে পেরে বিজেএমসি সুদানের একটি চুক্তি খেলাপি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তড়িঘড়ি করে ৯০ ডলার থেকে ৩ ডলার করে কমিয়ে প্রতি ১০০ পাটের বস্তা ৮৭ ডলার দরে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। যা মোট বাজার মূল্যের চেয়ে ৯০ লাখ ডলার অর্থাৎ প্রায় ৮ কোটি টাকা কম। যেখানে চাহিদা বৃদ্ধির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের বস্তার দাম বাড়ছে এবং বাংলাদেশেরই বেসরকারি জুট মিলগুলো এখন প্রতি ১০০ পাটের বস্তা ৯৫ ডলারে বিক্রি করছে, যেখানে প্রস্তাবিত দরের চেয়ে ৩ ডলার করে কমিয়ে বিজেএমসির পাট পণ্য বিক্রি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শুধু তাই নয়, বিতর্কিত ওই কোম্পানির কাছে পাট পণ্য বিক্রির জন্য শর্তও শিথিল করা হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, পাট পণ্য রফতানি করার জন্য স্থানীয় ক্রেতাদের আগে ৫ শতাংশ অর্থ জামানত রাখতে হতো। কিন্তু বিজেএমসি আর্থিক সঙ্কট দূর করতে ওই জামানতের পরিমাণ বর্তমানে ৫০ শতাংশে নির্ধারণ করেছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে ওই বিদেশী কোম্পানি তাইফের সঙ্গে বিজেএমসি শুধু কম মূল্যেই চুক্তি স্বাক্ষর করেনি, ওই চুক্তিতে শর্ত শিথিল করে ৫০ শতাংশের স্থলে ১০ শতাংশ জামানত দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। আবার চুক্তি অনুযায়ী ৩ কর্মদিবসের মধ্যে ওই জামানত বা আগাম মূল্য পরিশোধের শর্ত থাকলেও ১০ কর্ম দিবস পেরিয়ে গেলেও আগাম মূল্য বিজেএমসিতে জমা দেয়া হয়নি। অথচ দেশের একটি শীর্ষ স্থানীয় পাট পণ্য রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান গত ৩ আগস্ট প্রতি ১০০ পাটের বস্তা ৯০ ডলার করে সুদানে বিক্রির একটি ফার্ম বিড বিজেএমসির চেয়ারম্যানের কাছে জমা দিয়েছে। ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ২৩৯ কোটি টাকা মূল্যমানের ১ লাখ ৪ হাজার ৯৭৫ বেল স্ট্যান্ডার্ড বি টুইল ব্যাগ সুদান কিনে নেবে। এ প্রসিঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুশতাক হোসেন বলেন, সুদান বাংলাদেশের পাট পণ্যের বড় ক্রেতা। বিজেএমসির এজেন্ট হিসেবে দেশীয় প্রতিষ্ঠানটি গত ১০ বছরে এক হাজার ১৫০ টাকা মূল্যেও প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার বেল জুট ব্যাগ সুদানে রফতানি করেছে। গত দুই বছর সুদানে অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা বিরাজ করে। বর্তমানে দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল হয়েছে এবং এ বছর সুদানে কৃষি পণ্যের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে এ বছর তাদের প্রায় দুই লাখ বেল পাটের ব্যাগের প্রয়োজন। বর্তমানে বিজেএমসির কাছে এক লাখ বেলের বেশি পাটের ব্যাগ মজুদ রয়েছে। ওই পণ্য সুদানে বিক্রির জন্য সেদেশের প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী ও কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। এই প্রচেষ্টার ফলে সুদান বাংলাদেশ থেকে পাট ক্রয়ে সম্মত হয়েছে। বিষয়টি চিঠি দিয়ে বিজেএমসির চেয়ারম্যানকে জানানো হয় এবং ফার্ম বিড জমা দেয়া হয়। এখন বিজেএমসির নিশ্চয়তা পেলে সুদান চলতি আগস্ট মাস থেকেই নগদ টিটিতে পণ্য ক্রয় করবে। কিন্তু বিজেএমসি না জানিয়ে সমুদয় পাট বাজার মূল্যের চেয়ে ৩ ডলার করে একটি বিতর্কিত সুদানী ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করার চুক্তি করেছে বিজেএমসি। তাতে সরকারের প্রায় ৮ কোটি টাকা লোকসান হবে। যে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে বিজেএমসি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে তার মালিকের নাম আব্দেল লতিফ। ১৯৯১ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার তাকে সুদানে বাংলাদেশের অনারারি কনসাল জেনারেল পদে নিয়োগ দিয়েছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ২০১৬ সালে বাংলাদেশের স্বার্থ বিরোধী কাজ করায় শাস্তিস্বরূপ সরকার তার ওই কূটনৈতিক মর্যাদা কেড়ে নেয়। তার আগের ওই প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন অপর একটি প্রতিষ্ঠান সেনকম ইন্টারন্যাশনাল বিজেএমসি থেকে ৩০ হাজার টন পাট পণ্য ক্রয়ের চুক্তি করেছিল। কিন্তু বার বার তাগাদা দেয়ার পরও ওই প্রতিষ্ঠান পাট পণ্য নেয়ার জন্য চুক্তির শর্ত অনুযায়ী অগ্রিম অর্থ জমা দেয়নি এবং পণ্য নেয়ার ব্যাপারেও কোন আগ্রহ দেখায়নি। ফলে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বিজেএমসি ওই চুক্তি বাতিল করে। অতীতে বহুবার এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। চুক্তি করেও এই তাইফ ইন্টারন্যাশনাল অগ্রিম অর্থ পরিশোধও করেনি এবং পণ্যও ডেলিভারি নেয়নি। ফলে বিজেএমসির আর্থিক লোকসানের শিকার হয়েছে। ফলে হঠাৎ করেই তড়িঘড়ি ওই খেলাপি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিজেএমসি কেন কম মূল্যে সমুদয় মজুদ পাট পণ্য বিক্রির জন্য উদ্যোগী হয়েছে তা নিয়ে খোদ মন্ত্রণালয় থেকেই প্রশ্ন তোলা হয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একটি সভায় এ নিয়ে পাটমন্ত্রী কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলেছেন।
এদিকে কম দামে পাট বিক্রির বিজেএমসির উদ্যোগের বিষয়ে বাংলাদেশ জুট গুডস এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগ প্রাপ্তির পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এ বিষয়ে তদন্ত করে দেখারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ জুট গুডস এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান এম সাজ্জাদ হোসেন সোহেল জানান, এ্যাসোসিয়েশনের ৮৩ জন সদস্য বিজেএমসিতে তালিকাভুক্ত। যুগ যুগ ধরে এই সদস্যরাই বিজেএমসির পাট পণ্য ভাল দামে রফতানি করে আসছে। তারা সুখে-দুখে বিজেএমসির সঙ্গে কাটিয়েছে। অথচ বিজেএমসির সমুদয় মজুদ পণ্য তালিকাভুক্ত সদস্যদের না জানিয়ে একটি বিদেশী বিতর্কিত ক্রেতার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশ জুট গুডস এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের জানিয়ে বিক্রি করলে বিজেএমসি বিশেষ উপকৃত হতো। এ ব্যাপারে গত ৬ আগস্ট একটি আপত্তিপত্র বিজেএমসির বরাবরে জমা দেয়া হয়েছে। মূলত বাংলাদেশ জুট গুডস এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন ঈদের পর প্রচলিত বাজার মূল্যে বিজেএমসির মজুদ পণ্য বিক্রির জন্য বিড প্রদানের প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু তালিকাভুক্ত সদস্যদের বিবেচনায় না নিয়ে কম মূল্যে পণ্য বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিস্থিতি জটিল করে ফেলা হয়েছে। এই অবস্থায় বিদেশী সংস্থার দ্বারস্থ না হয়ে ৮৭ মার্কিন ডলারের (প্রতি ১০০ ব্যাগ) বিক্রয় চুক্তি বাতিল করা উচিত।