বাংলাদেশ রেলওয়ে করোনাকালে পণ্য পরিবহনের সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি। করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে দীর্ঘসময় রেলওয়ের যাত্রী পরিবহন সেবা বন্ধ ছিল। ওই সময় রেলের আনুষঙ্গিক সুবিধাগুলো অব্যবহৃত থাকলেও পণ্য পরিবহন খাতে রেলওয়ে তা ব্যবহার করতে পারেনি। গত কয়েক মাসে রেলের পণ্য পরিবহনের তুলনামূলক চিত্র পর্যালোচনায় তা স্পষ্ট বেরিয়ে এসেছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হলে ২৬ মার্চ থেকে রেলের প্রতিদিনকার চলাচল করা ৩৪৮টি ট্রেনের মধ্যে প্রায় ৩১৭টিই দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। ৬৭ দিন পর অর্থাৎ ৩১ মে থেকে প্রথম দফায় ৮ জোড়া এবং ৩ মে থেকে আরো ১১ জোড়া যাত্রীবাহী ট্রেন রেলওয়ে চালু করে। ১৫ আগস্ট পর্যন্ত আর নতুন যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করেনি। এ সময়ে রেলের ইঞ্জিনসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ও প্রকৌশলগত সুবিধা অলস বসে ছিল। এ সময়ে সড়কপথে পরিবহন সংকট, ঝুঁকির কারণে পরিবহন শ্রমিকদের অভাব এবং সড়কপথের পরিবহন খরচ তুলনামূলক বেশি হলেও রেলপথে পণ্য পরিবহনে ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করতে পারেনি রেলওয়ে। বাংলাদেশ রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রেলওয়ের যাত্রী পরিবহন খাতে লাভের পরিবর্তে ভর্তুকি দিয়ে সেবা পরিচালনা করতে হয়। মূলত পণ্যবাহী ট্রেন সেবা খাত থেকে রেলের অপারেটিং আয় হয়। তবে রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা হিসেবে জনগণকে সেবা প্রদানের কারণে যাত্রীবাহী ট্রেনকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে পণ্য পরিবহনে খাতটি প্রায়ই অবহেলিত থেকে যায়। রেলওয়ে ট্রেন পরিচালনার আনুষঙ্গিক সুবিধা সংকটের কারণে চাহিদা অনুপাতে পণ্যবাহী ট্রেন চালাতে পারতো না। কিন্তু করোনাকালে পণ্যবাহী ট্রেন পরিচালনার আনুষঙ্গিক সুবিধার সঙ্কট না থাকলেও রেলওয়ে তা কাজে লাগাতে পারেনি। রেলের যে কোনো ট্রেন পরিচালনার প্রধান শর্ত হচ্ছে ইঞ্জিন, বিএফসিটি, ওয়াগন, কোচ, লোকবল, ভালো মানের রেলপথ, ত্রুটিহীন সিগন্যালিং ব্যবস্থা ইত্যাদি। মালবাহী ট্রেন পরিচালনার জন্য রেলওয়ে দীর্ঘদিন ধরে ইঞ্জিন সংকটে ভুগছিল। প্রতিদিন সারা দেশে প্রায় ৩০টির বেশি মালবাহী ট্রেন চলাচল করলেও চাহিদার তুলনায় কম ইঞ্জিন পাওয়া যেতো। আর মালবাহী ট্রেন পরিচালনার জন্য যেসব ইঞ্জিন সরবরাহ করা হতো সেগুলো ছিল সবচেয়ে নিম্নগতির এবং পুরনো। তবে নভেল করোনা ভাইরাসের সংকটকালে সারা দেশে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকলে ইঞ্জিন সরবরাহে কোনো সমস্যা ছিল না। তারপরও ওই সময়ে গুডস পরিবহন খাতে আয় বাড়েনি। একই সময়ে রেলের অপারেশনাল কাজে নিযুক্ত লোকবলের সিংহভাগই অলস বসে থাকলেও সেটিও কাজে লাগাতে পারেনি রেলওয়ে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের গুডস পণ্য পরিবহন হিসেবে দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত রেলওয়ে পণ্য পরিবহন করেছে ২ লাখ ১৯ হাজার ৯০ টন। অথচ ২০১৯ সালের মার্চ-জুন পর্যন্ত চার মাসে পণ্য পরিবহন করেছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার ২৩৯ টন। ওই কারণে রেলের এ খাতে আয় প্রায় ৫ কোটি টাকা কমে নেমে এসেছে ১৯ কোটি ২৭ লাখ ১৩ হাজার ৭৫০ টাকায়। মার্চে পূর্বাঞ্চলে ৮২ হাজার ৫৭৮ টন পণ্য পরিবহনের পর এপ্রিলে পণ্য পরিবহন নেমে আসে মাত্র ৩৬ হাজার ৫২ টনে। তারপর মে মাসে পরিবহন বেড়ে ৪৮ হাজার ৯১৩ এবং জুনে কিছুটা বেড়ে ৫১ হাজার ৫৪৭ টনে উন্নীত হয়। যদিও ২০১৯ সালের মার্চে ৭২ হাজার ৯৪৭ টন, এপ্রিলে ৬২ হাজার ৪৮৯, মে মাসে ৬৬ হাজার ৭৯৭ ও জুনে পণ্য পরিবহন হয়েছিল ৬৩ হাজার ৬ টন। করোনাকালে রেলপথে কনটেইনার, জ্বালানি, খাদ্যশস্যের মধ্যে সরকারি খাদ্যপণ্য পরিবহন বেড়েছে। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ১৯ হাজার ৩৯৭ টন সরকারি খাদ্যশস্য রেলে পরিবহন হলেও চলতি বছরের একই সময়ে (চার মাস) পরিবহন হয়েছে ৩৭ হাজার ৩৩৭ টন। তার মধ্যে মার্চে ৪ হাজার ৯০৮ টন, এপ্রিলে ১৩ হাজার ৭০৫ টন, মে মাসে ১০ হাজার ৮৬ টন ও জুনে সরকারি খাদ্যশস্য পরিবহন হয়েছে ৮ হাজার ৬৩৮ টন। তাছাড়া কনটেইনার পরিবহনেও নাজুক পরিস্থিতি পার করছে রেলওয়ে। মার্চে ৫০ হাজার ৭৮ টন কনটেইনার পণ্য পরিবহন করলেও এপ্রিলে তা ৮ হাজার ৮৯৯ টনে নেমে আসে। তারপর মে মাসে কিছুটা বেড়ে ২২ হাজার ৮২৭ টনে উন্নীত হলেও জুনে এসে ফের কমে ১৬ হাজার ৮৩৬ টনে নেমে যায়।
সূত্র আরো জানায়, মালবাহী ট্রেনের ক্ষেত্রে ব্যবহারকারী স্টেকহোল্ডারদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল পণ্য পৌঁছাতে বিলম্ব। সড়ক ও নৌপথে যে সময়ে পণ্য পৌঁছে, ট্রেনে তার চেয়ে দ্বিগুণ সময় লাগে। যাত্রীবাহী ট্রেনকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আগে মালবাহী ট্রেনগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা পথিমধ্যে বা বিভিন্ন সেকশনে বসিয়ে রাখা হতো। যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল না করা বা সীমিত আকারে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করায় গত কয়েক মাসে বিরতিহীনভাবে মালবাহী ট্রেন পরিচালনার মাধ্যমে গ্রাহকদের সুবিধা দেয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু রেলের প্রচারণার অভাব, দক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবসায়ীদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় নভেল করোনাভাইরাসের সময়ে পণ্যবাহী ট্রেন পরিচালনায় জনপ্রিয়তা বাড়াতে পারেনি রেলওয়ের পরিবহন ও বাণিজ্যিক বিভাগ।
এদিকে রেলওয়ের দায়িত্বশীলদের মতে, নভেল করোনাভাইরাসের কারণে দেশের আমদানি-রফতানি কমে যাওয়ায় বিগত কয়েক মাসের পণ্য পরিবহন ও আয়ে প্রভাব পড়েছে। তাছাড়া জ্বালানি পরিবহনের পরিমাণ কমে যাওয়ায় রেলপথের আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। রেলপথে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা নিরুৎসাহিত হলেও রেলওয়ে শুধু বন্দর কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ। এ কারণে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দুর্যোগকালে রেলের মাধ্যমে বড় আকারের পণ্য পরিবহন কার্যক্রম চালু করতে ব্যর্থ হয়েছে রেলওয়ে।
অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের মতে, রেলওয়ে নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সারা দেশে পরিবহন ব্যবস্থাপনায় সংকট দেখা দিলে কৃষিজ পণ্য, আম ও কোরবানির ঈদের আগে পশু পরিবহনের একাধিক উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে ব্যবসায়ীদের পণ্য পৌঁছানোর বিষয়ে রেলের সদিচ্ছা থাকলেও উদ্যোগে ঘাটতি ছিল। বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা রেলে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে এখনো আস্থাহীন। করোনাকালে পরিবহন সংকট, পরিবহন শ্রমিক সংকট ছাড়াও বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা নানা সমস্যার মধ্যে ছিল। তারপরও সড়কপথের নানা সমস্যা সত্ত্বেও রেলপথে পণ্য পরিবহনে এগিয়ে আসেনি তারা। রেলপথে পণ্য পরিবহনের দীর্ঘসূত্রতা, গন্তব্যে পৌঁছতে বিলম্ব, পণ্য পৌঁছানোর পর অন্য একটি পরিবহনে করে নির্ধারিত মূল গন্তব্যে পণ্য নিয়ে যাওয়ার সমস্যায় ব্যবসায়ীরা রেলপথ বিমুখ। অথচ রেলের কনটেইনারসহ পণ্য পরিবহনকে বেগবান করতে ২০১৬ সালে রেলওয়ে কনটেইনার সার্ভিস করপোরেশন নামের একটি পৃথক কোম্পানি গঠন করে রেলওয়ে। সেজন্য একজন সার্বক্ষণিক ব্যবস্থাপনা পরিচালকও নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু বিগত পাঁচ বছরে কোম্পানিটির কার্যক্রম পূর্ণাঙ্গ রূপে চালু না হওয়ায় রেলপথে সম্ভাবনাময় পণ্য পরিবহন কার্যক্রমও বাড়াতে পারছে না রেলওয়ে।
এ প্রসঙ্গে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) সাদেকুর রহমান জানান, করোনাকালে যাত্রী পরিবহন বন্ধ থাকায় রেলপথে পণ্য পরিবহনের জন্য বন্দরসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বৈশ্বিক বিরূপ পরিস্থিতির কারণে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য কম হওয়ায় রেলওয়ে সুবিধা করতে পারেনি। আশা করা যায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে আগের মতো রেলপথে পণ্য পরিবহন আরো বাড়ানো সম্ভব হবে।