করোনা পরিস্থিতিতেও আমাদের দেশে একের পর এক নির্বাচন হচ্ছে। ভোট শূণ্য দশমিক ৬ ভাগ পড়ক অথবা নাইবা পড়–ক নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অথর্ব প্রার্থীদের নাম ঘোষণা হচ্ছে। কখনো পরিবারতন্ত্র, কখনো স্বৈরতন্ত্রের প্রমাণ দিচ্ছে সরকার। সেই সকল কাজে যুক্ত থেকে কালোর বাসিন্দাদের মত করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার সহ প্রায় সকল কমিশনকর্তারা শাদাকে কালো বলছে, আর কালোকে শাদা বলছে। এরই মধ্য দিয়ে এবার প্রিয় সাহারা আপার শূণ্য হওয়া ঢাকা ১৮ আসনে পরিবারতন্ত্রের প্রমাণস্বরূপ অনেক যোগ্য নেতাকে বাদ দিয়ে, ত্যগি নেতাকে লাত্থি দিয়ে আমাদের জাতির পিতার কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একমাত্র কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে মনোনয়ন দিয়েছে। ভোট হোক বা না হোক গতানুগতিকভাবে বরাবরের মত নির্বাচন কমিশন থেকে তাঁকে নির্বাচিত ঘোষণাও করা হবে। বাংলাদেশ পাবে আরেকজন নতুনমুখ, ৪৬ বছরের তরুণ প্রতিনিধি। এভাবে বাংলাদেশকে ক্রমশ অন্ধকারে রেখে ক্ষতির যে তালিকা লম্বা করা হচ্ছে, তার ভাগিদার হিসেবে বরাবরের মত অবিরত ইতিহাসে নূরুল হুদার নাম লেখা থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। একসময় হয়তো খন্দকার মোস্তাকের পথে হাঁটার অপরাধে জুতার মালাও পরাবে পরবর্তী প্রজন্ম।
বাংলাদেশের রাজনীতিকে কলুষিত করেছে ছাত্র রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি এবং নির্বাচন কমিশনের স্বেচ্ছাচারিতা-চাটুকারিতা। তারপরও স্বপ্ন নিয়ে আমার মত কিছু মানুষ সততা- মেধা- যোগ্যতা ও একাগ্রতাকে কাজে লাগিয়ে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছে ছাত্র-যুব-জনতার কল্যাণের জন্য। কিন্তু তা ভেস্তে যাচ্ছে বারবার নির্বাচন কমিশনে নিয়োজিত যুদ্ধাপরাধী-দুর্নীতিবাজ-জঙ্গী-জামায়াত-শিবিরের মদদপুষ্ট একশ্রেণির অতি চাটুকারদের কারণে। আর এদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বরাবরের চাটুকার সাবেক সচিব-বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের প্রধান নূরুল হুদা। শুনতে একটু কটু হলেও সত্য এই যে, যদি তিনি নির্বাচন কমিশনের প্রধান না হতেন তাঁর ভাগ্নে সারাজীবনেও এমপি হতে পারতেন না।
দুর্নীতিবাজ আজিজ নির্বাচন কমিশনের প্রধান হলে আমরা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে মিছিল করেছিলাম। মিছিলে শ্লোগান ছিলো- ‘আইজ্যা রে আইজ্যা, লাগাইসনারে কাইজ্যা, জলদি কইরা বাইত যা।’ লক্ষ্য ছিলো দেশকে কালোহীন করা। কোন লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি না করে দেশ ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ছিলো সেই শ্লোগান।
অনেক আন্দোলন-সংগ্রামে মুক্ত করি নির্বাচন কমিশন, নিজেও মুক্তি হই দেড় বছর জেল খেঁটে। এমন নিদারুণ নির্বাচন কমিশন আবারও আসে। অবশ্য সেই সময়ও প্রচন্ড আন্দোলন সংগ্রামে মানুষ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে আসেনি। তবু দেশের নির্বাচন-ব্যবস্থাকে বিতর্কিত করে বিদায় নিয়েছে রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। আমি মনে করি- ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, রকিব ও চলমান কমিশন তার পাঁচ বছরের মেয়াদে তা ধ্বংস করে দিয়েছে।সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ-এর মত করে নূরুল হুদা কমিশনও হয়তো মনে করেন, তাঁর কমিশনের কোনো ব্যর্থতা নেই। কাজী রকিব চলে যাওয়ার আগের ইতিহাস হলো- ২০১২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রকিব কমশিনের পথচলা শুরু হয়। এর অধীনে জাতীয় সংসদ, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা, সিটি করপোরেশন ও জেলা পরিষদ নির্বাচন হয়েছে। কমিশন সচিবালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এত বেশি নির্বাচন করার সুযোগ অতীতের কোনো কমিশন পায়নি। এই কমিশনের অধীনে ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করেন। পরের বছর রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনে জয় পান বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরা।
নির্বাচনী অনিয়ম শুরু থেকেই ছিলো বলে অভিযোগও রয়েছে। এরপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে। এ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ নেয়নি। প্রায় ভোটারবিহীন এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দেড় শতাধিক প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। এরপর ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম দুই পর্ব মোটামুটি সুষ্ঠুভাবে শেষ হয়। প্রথম দুই ধাপে বিএনপি-সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীরাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জয় পান। পরের ধাপগুলোতে দেশব্যাপী কেন্দ্র দখল করে ব্যালট পেপারে সিল মারার সংস্কৃতি শুরু হয় এবং বেশির ভাগ উপজেলায় আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। গত বছরের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ঢাকার দুই সিটি এবং চট্টগ্রাম সিটির নির্বাচন নিয়েও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ আছে। এই কমিশনের অধীনে সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে তার আগে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সীমাহীন অনিয়মের মধ্য দিয়ে। এ দুটি নির্বাচনে অনেক জায়গায় বিএনপির মনোনীত প্রার্থীরা মনোনয়নপত্রও জমা দিতে পারেননি। অনেক জায়গায় ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অনিয়মে অংশ নেন। কিন্তু কমিশন থেকে এসব অনিয়ম প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
আমি একজন লেখক হিসেবে-বাংলাদেশের রাজনীতিতে সর্বকনিষ্ট রাজনৈতিক প্লাটফর্মের চেয়ারম্যান হিসেবে বরাবরই গভীরভাবে দেখেছি যে, আইনে অনিয়ম প্রমাণিত হলে নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের আছে। কিন্তু রকিব কমিশন ইউপি নির্বাচনে অনিয়ম-সংক্রান্ত প্রার্থীদের অভিযোগ আমলেই নেয়নি। উল্টো এক চিঠিতে সব প্রার্থীকে আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে চাঁদপুরের চরভৈরবী ইউনিয়নের এক প্রার্থী হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন। হাইকোর্ট কমিশনকে অভিযোগ নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। কমিশন সেই আদেশ আমলে নেয়নি। এ জন্য হাইকোর্ট কমিশনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ তোলেন। এ ঘটনায় সিইসি ও চার কমিশনার গত ২৬ নভেম্বর আদালতে গিয়ে নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। উপজেলা নির্বাচনের পর বিরোধী দলসহ সমালোচকদের অনেকে বর্তমান কমিশনকে ‘মেরুদন্ডহীন’ বলে আখ্যায়িত করেছিল। এ বিষয়ে নিজেদের ব্যাখ্যা তুলে ধরতে গিয়ে কমিশনার জাবেদ আলী টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে কোমর দুলিয়ে বলেছিলেন, ‘মেরুদন্ড তো ঠিকই আছে।’
আর হুদা কমিশন? লজ্জায় মাথা কাটা যায় অবস্থা। যদিও সুষ্ঠু নির্বাচনের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সময় লাগে, কিন্তু ভাঙতে সময় লাগে না। দুই দশকে অন্য কমিশন যা অর্জন করেছে, রকিব আর হুদা কমিশন তা বিসর্জন দিয়েছে। নতুন কমিশন আগের অবস্থানে ফিরে যেতে চাইলে তাকে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে।
তবু বরাবরের মত চোরের মা’র বড় গলা শুনতেই হবে- ‘আমরা নির্বাচন-ব্যবস্থাকে দুর্বল অবস্থায় নিয়ে যাইনি। দেশে কথায় কথায় মারামারি বেড়ে গেছে। এটা একধরনের সামাজিক অবক্ষয়।’ দেড় শতাধিক আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার বিষয়ে রকিব বলেছিলেন- বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার বিষয়টি আইনেই আছে। মাঠ ছেড়ে দিলে তো প্রতিপক্ষ গোল দেবেই। এটা রাজনীতির খেলা।
নির্লজ্জ যাকে বলে, তাকেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার করে পথ চলতে থাকে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রধান। এই করোনা পরিস্থিতিতে সারাবিশ^ স্থবির হলেও বাংলাদেশে সব ঠিক রেখে একেতর পর এক নির্বাচন দিয়ে যাচ্ছে, খসড়া তৈরি করছে, কয়েকটি খাদক টাইপ দলকে টিকিয়ে রেখে বাকিগুলোকে বাতিলের ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় প্রস্তাবিত নতুন আইন কার্যকর করে সহজেই রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন বাতিল করতে পারবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। শুধু এখানেই শেষ নয়; বর্তমান আইনে নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত তিনটি শর্তের মধ্যে একটি পূরণ করতে পারলেই যে কোনো রাজনৈতিক দল নিবন্ধনযোগ্য বিবেচিত হয়। কিন্তু নতুন আইনে দলগুলোকে তিনটি শর্তের মধ্যে দুটি পূরণ করতে হবে। ২৬ আগস্ট কমিশন সভায় রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন-২০২০-এর খসড়া অনুমোদন করতে সভা করবে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। রাজনৈতিক দলসমূহের নিবন্ধন আইন-২০২০ নামে আইনের খসড়া প্রস্তুত করেছে নির্বাচন কমিশন। এক যুগ আগে একটি নিবন্ধন শর্ত পূরণ করেই দল নিবন্ধন পেয়েছে। আগামীতে দুটি নিবন্ধন শর্ত পূরণ করতে হবে আগ্রহী দলকে।
ইসির নতুন খসড়া আইনে নিবন্ধন শর্তাবলিতে রাখা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব পর্যায়ের কমিটি ন্যূনতম শতকরা ৩৩ ভাগ সদস্য পদ নারী সদস্যদের জন্য সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা থাকতে হবে। কমিশনে প্রদেয় বার্ষিক প্রতিবেদনে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিবরণ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া ইসিতে নিবন্ধন আবেদন করার তারিখ হতে পূর্ববর্তী দুটি সংসদ নির্বাচনে দলীয় নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে কমপক্ষে একটি আসনে জিততে হবে। অথবা সংসদ নির্বাচনের যে কোনো একটিতে দরখাস্তকারী দল নির্বাচনে প্রদত্ত মোট ভোটের শতকরা ৫ ভাগ ভোট পেতে হবে। অথবা দলের কেন্দ্রীয় কমিটি, সক্রিয় কেন্দ্রীয় দপ্তর, অন্যূন এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর জেলা দপ্তর, অন্যূন ১০০ উপজেলা বা মেট্রোপলিটন থানার প্রতিটিতে কার্যকর দপ্তরসহ ন্যূনতম দুইশ ভোটার সদস্য হিসেবে দলের তালিকাভুক্ত থাকতে হবে।
আরো একটি বিষয় হলো- খসড়া আইনের ৪(৩) ধারায় শর্ত প্রতিপালন না করার কারণে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিলের সুযোগ পাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। এতে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতির মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর শর্তাদি পূরণ সম্পর্কে তদন্ত করে প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসের মধ্যে কমিশনের কাছে প্রতিবেদন উপস্থাপন করবে। কমিশনের বিবেচনায় কোনো রাজনৈতিক দল শর্তাদি পূরণে ব্যর্থ হলে ধারা-১১ অনুসারে সেই রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করা হবে। নির্বাচন কমিশনের তিনটি শর্তের অন্তত দুটি পূরণ করতে না পারলে নতুন কোনো রাজনৈতিক দল নিবন্ধিত হতে পারবে না। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইনের খসড়ায় এ শর্ত রেখেছে নির্বাচন কমিশন।
কিন্তু কাদের স্বার্থে তারা এসব করছে? কিসের স্বার্থে করছে? নির্বাচন কমিশন যদি দেশ-মানুষের কথা না ভাবে, তাহলে এই নির্বাচন কমিশন দিয়ে কি করবে বাংলাদেশ! আমরা আইজ্যারে আইজ্যার কাইজ্যা থামানোর জন্য নিবেদিত ছিলাম, আমরা রকিব কমিশনকে উল্টে দিয়েছি আর এই হুদা কমিশনকে কাঁত করতে লাগবে সর্বোচ্চ ছয় মাস। সেই সময় আমরা চাই না, বায়ান্নর বীর সৈনিকদের উত্তরসূরীরা চায় না। চায় সুষ্ঠুভাবে বাংলাদেশের রাজপথে যে রাজনৈতিকধারা গণমানুষের মুক্তির জন্য নিবেদিত থেকে কাজ করছে সেই রাজনৈতিকধারার নিবন্ধন দেয়া হোক। পাশাপাশি সকল ষড়যন্ত্রী সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে গণমানুষের মুক্তির পথ তৈরি করতে তারুণ্যের রাজনীতিকদেরকে কালোর বিরুদ্ধে লড়াই করার সুযোগ গড়ে দেয়াটাও নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। তা পালন না করলে অনশন-অবরোধ করে এই হুদাকে কঠিনতর শিক্ষা দেয়া হবে...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি