করোনা প্রাদুর্ভাবে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকের ঋণ বিতরণ কার্যক্রম। এজেন্টের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ এক মাসের ব্যবধানে ৯৯ শতাংশ কমে গেছে। তাছাড়া অনলাইনভিত্তিক লেনদেনও ২৬ থেকে ৭৬ শতাংশ কমে গেছে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ওপর করোনার সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এখন যতো দ্রুত সম্ভব উত্তরণের পথ খুঁজে বের করা ছাড়া বিকল্প নেই। তা না হলে বিপদ আরো বাড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এজেন্টের মাধ্যমে চলতি বছরের এপ্রিলে মাত্র ৩০ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। কিন্তু এক মাস আগেও তার পরিমাণ ছিল ৫৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ওই হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে এজেন্টের মাধ্যমে ব্যাংকের ঋণ বিতরণ ৯৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ কমেছে। ফেব্রুয়ারিতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। আর এপ্রিলে ওই সেবার মাধ্যমে ১১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। ওই হিসাবে করোনার ধাক্কায় এজেন্ট ব্যাংকিং লেনদেন কমেছে ৪৩ দশমিক ২৩ শতাংশ। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আওতায় ৬৭ লাখ ২৮ হাজার ৬৫৩ জন গ্রাহক হিসাব খুলেছে। ওসব হিসাবে জমা অর্থের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা। আর গত ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্রাহক ছিল ৫২ লাখ ৫৭ হাজার ৭৬৯ জন এবং আমানত স্থিতি ছিল ৭ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৪ মাসে গ্রাহক বেড়েছে ১৪ লাখ ৭০ হাজার ৮৮৪ জন এবং আমানত স্থিতি বেড়েছে ৯৮৮ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, যে স্থানে ব্যাংকের কোনো শাখা নেই বা শাখার মাধ্যমে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা অধিক ব্যয়বহুল ও লাভজনক নয়, ওরকম দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিগত ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর এজেন্ট ব্যাংকিং নীতিমালা জারি করে। শহরের চেয়ে গ্রামেই বেশি জনপ্রিয় এজেন্ট ব্যাংকিং। বর্তমানে ২২টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ৮ হাজার ৪২৯টি মাস্টার এজেন্টের আওতায় ১২ হাজার ৮২টি আউটলেটের মাধ্যমে এ সেবা দিচ্ছে। দেশে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ার আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় চেক ক্লিয়ারিং হয়েছে ২০ লাখ ১৫ হাজার ৪৯টি। কিন্তু এপ্রিলে চেক ক্লিয়ারিংয়ের সংখ্যা কমে মাত্র ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৭০৩টিতে নেমে আসে। ওই হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে ব্যাংকগুলোর চেক ক্লিয়ারিংয়ের পরিমাণ কমেছে ১৫ লাখ ৩৮ হাজার ৩৬৪টি। চেক ক্লিয়ারিং কমার হার ৭৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে চেকের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছিল এক লাখ ৮৬ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা। আর এপ্রিলে লেনদেনের পরিমাণ ৯৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকায় নেমে আসে। ওই হিসাবে চেকের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন কমেছে ৯১ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা, যা ৪৯ দশমিক ১৪ শতাংশ।
সূত্র আরো জানায়, দেশের ব্যাংকগুলোর ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকের সংখ্যা ১৫ লাখ ৯৯ হাজার ৮২৩টি। করোনা সংক্রমণের আগে ফেব্রুয়ারিতে ক্রেডিট কার্ডে মোট লেনদেন হয়েছিল ২২ লাখ ৮৬ হাজার ৮০০টি। এপ্রিলে ওই লেনদেন ১০ লাখ ৬৪ হাজার ৬৩৫টিতে নেমে এসেছে। ওই হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন কমেছে ১২ লাখ ২২ হাজার ১৫৬টি। ফেব্রুয়ারিতে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছিল এক হাজার ২১৮ কোটি টাকা। এপ্রিলে ওই লেনদেন ৫২৩ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। ফলে ক্রেডিট কার্ডে টাকার লেনদেন কমেছে ৫৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। সাধারণত কেনাকাটায় ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীরা কার্ডটির বেশি ব্যবহার করে। পস (পিওএস) মেশিনের মাধ্যমে বিল পরিশোধ করা হয়। এপ্রিলে ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকদের কেনাকাটায় বড় ধরনের ধস নামে। ফেব্রুয়ারিতে পসের মাধ্যমে ক্রেডিট কার্ডের লেনদেন ছিল ৭৯৫ কোটি টাকা। এপ্রিলে ওই লেনদেন মাত্র ২৮২ কোটি টাকায় নেমে আসে। বর্তমানে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৪১২ কোটি টাকা।
এদিকে গত ফেব্রুয়ারিতে ডেবিট কার্ডে লেনদেন হয়েছিল এক কোটি ৯৩ লাখ ৫৯ হাজার ৭৩টি। কিন্তু এপ্রিলে ওই লেনদেন এক কোটি পাঁচ লাখ ২৫ হাজারে নেমে এসেছে। ওই হিসাবে ফেব্রুয়ারির তুলনায় এপ্রিলে ডেবিট কার্ডে প্রায় ৯০ লাখ লেনদেন কম হয়েছে। অর্থাৎ ডেবিট কার্ডে লেনদেন কমেছে ৪৪ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে মোট লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা। কিন্তু এপ্রিলে ওই কার্ডের মাধ্যমে মাত্র ৮ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। ওই হিসাবে করোনায় ডেবিট কার্ডেও লেনদেন কমেছে ৪৩ দশমিক ৫৯ শতাংশ। ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলনের পাশাপাশি গ্রাহকরা পস মেশিনের মাধ্যমে কেনাকাটার বিল পরিশোধ করে। ফেব্রুয়ারিতে পসের মাধ্যমে ডেবিট কার্ডের লেনদেন ছিল ৪৭৮ কোটি টাকা, এপ্রিলে ওই লেনদেন মাত্র ১৪০ কোটি টাকায় নেমে আসে। বর্তমানে দেশের সব ব্যাংকের ডেবিট কার্ডধারী গ্রাহকের সংখ্যা এক কোটি ৯৩ লাখ ৭৭ হাজার ৭৯১।
অন্যদিকে ব্যাংকগুলোর প্রিপেইড কার্ড গ্রাহকের সংখ্যা ৫ লাখ ৩১ হাজার ছাড়িয়েছে। কিন্তু করোনার ধাক্কায় ওই কার্ডের লেনদেন তলানিতে নেমেছে। এপ্রিলে প্রিপেইড কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে মাত্র ৬১ কোটি টাকা। অথচ ফেব্রুয়ারিতে ওই কার্ডের মাধ্যমে ১৪২ কোটির টাকা লেনদেন হয়েছিল। তাছাড়া বর্তমানে দেশের ব্যাংকগুলোর ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবার গ্রাহকসংখ্যা ২৬ লাখ ৮৭ হাজার ৩০৪। ফেব্রুয়ারিতে ওই সেবা ব্যবহার করে লেনদেন হয়েছিল ৬ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। কিন্তু এপ্রিলে ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের লেনদেন মাত্র ৪ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। অর্থাৎ ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে লেনদেন কমেছে ২৬ শতাংশ। তাছাড়া ফেব্রুয়ারিতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছিল ৪১ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। এপ্রিলে ওই লেনদেন ২৯ হাজার কোটি টাকায় নেমে আসে। ওই হিসাবে মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবসায় লেনদেন কমেছে ২৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ।