নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না চালের দাম। অথচ দেশে পর্যাপ্ত চাল মজুদ রয়েছে। তারপরও চালের দাম বেড়েই চলেছে। এমনকি সরকারের চাল আমদানির ঘোষণাতেও মূল্যবৃদ্ধিতে কোনো প্রভাব পড়ছে না। বরং সরকারের কঠোর নির্দেশ উপেক্ষা করে মিল মালিকরা চাল সংগ্রহ অভিযানে আশানুরূপ সাড়া দেয়নি। বরং বাজারে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তার প্রভাবে পাইকারি ও খুচরা বাজারে সরু, মাঝারি ও মোটা- সব চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। করোনার মধ্যে এমনিতেই অনেকের আয় কমেছে। এ অবস্থায় চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ বেশি চাপে পড়েছে। খাদ্য অধিদফতর, মিল মালিক এবং চাল বাজার সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কয়েকদিনেই মিল মালিকরা চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৪ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। মিলাররা ধানের দাম বৃদ্ধির কথা বলে চালের দাম বাড়াচ্ছে। অথচ এখন বাজারে তাদের কম দামে কেনা ধানের চাল। ঈদের পর থেকেই সরবরাহ সমস্যার কথা বলে মিল মালিকরা এক দফা দাম বাড়ায়। মূলত মিলগুলোর কারণেই চালের দাম বাড়ছে। ধান ও চালের বাজার তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে। বড় অটো রাইস মিলে হাজার হাজার টন ধান কিনে মজুদ রাখে। মৌসুমের সময় মিলগুলো প্রয়োজন মতো ধান কিনে রেখেছে। ফলে দু-চারদিন ধরে ধানের দাম বাড়লে তাতে চালের দাম বাড়ার কথা নয়। কিন্তু বাস্তব চিত্র উল্টো।
সূত্র জানায়, মিল মালিকরা চুক্তি অনুযায়ী সরবরাহ না করায় বোরো মৌসুমে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার মাত্র তিন ভাগের এক ভাগ ধান ও চাল সংগ্রহ হয়েছে। চলতি বছর সরকার সাড়ে ১৯ লাখ টন বোরো ধান-চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। ৩৬ টাকা কেজি দরে মিলারদের কাছ থেকে ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল ও ৩৫ টাকা কেজিতে দেড় লাখ টন আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু মিল মালিকরা চুক্তিমূল্যে সরকারকে চাল সরবরাহ না করে গড়িমসি করছে। তারা সরকারের চাল কেনার দর বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু সরকার ওই দাবি নাকচ করে প্রয়োজনে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারপরও দেশের সব মোকামে চালের দাম উর্ধ্বমুখী। একসঙ্গে সব মিল একই হারে দাম বাড়িয়েছে। বর্তমানে মণপ্রতি ধানের দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। ওই কারণে মিল মালিকরাও দাম বাড়িয়েছে। তবে চাল আমদানির খবরে সবাই শঙ্কিত। তাতে কেনাবেচা কমেছে। মিলগুলোতে প্রতিদিন চাল মজুদ হচ্ছে। বর্তমানে দেশে ধান ও চালের সঙ্কট নেই। নতুন করে বন্যায় ক্ষতি না হলে আপাতত চালের বাজার বাড়ার কোনো কারণ নেই। তবে বাজারে মোটা চাল নেই। চাহিদা না থাকায় মোটা জাতের চাল হঠাৎ করেই উধাও। পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ের বিক্রেতাদের মতে, মিলাররা সরকারি গুদামে মোটা চাল সরবরাহ দেয়ার কারণে বাজারে কোথাও ওই চাল মিলছে না।
সূত্র আরো জানায়, মিল মালিকরা বলছে ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাজারে চালের দাম বেড়েছে। তাই খরচ বেশি হওয়ায় সরকারকে চুক্তি অনুযায়ী চাল দেয়া সম্ভব হয়নি। কোন কোন মিল মালিকের মতে, সরকার ও অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ত্রাণ হিসেবে চাল বিতরণ করায় বাজারে মোটা চালের সরবরাহ কমেছে। ফলে গোটা চালের বাজারে তার প্রভাব পড়েছে। তবে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, মিল মালিকদের কারণে চালের দাম বেড়েছে। এখন মিলগুলোতে ধান ও চালের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। মৌসুমের সময়ে কম দামে কেনা ধান থেকে তৈরি চাল এখন তারা দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। আর এখন ধানের দাম বৃদ্ধির অজুহাত দিচ্ছে। তবে মিলগুলো চুক্তি অনুযায়ী সরকারকে চাল সরবরাহ না করায় মজুদ বাড়াতে দ্রুত আমদানির পরিকল্পনা করছে সরকার। পাশাপাশি সঙ্কটের এ সময়ে খোলাবাজারে চাল বিক্রি অব্যাহত রয়েছে। তাছাড়া চাহিদার তুলনায় সরকারি খাদ্য গুদামে অনেক বেশি ধান, চাল এবং গম মজুদ রয়েছে। ফলে ধান-চালের কোনো সঙ্কট সৃষ্টির সুযোগ নেই। ঈদের আগ পর্যন্ত কৃষক পর্যায়ে অনেকেই ধান-চাল মজুদ করেছিল বিধায় সাময়িকভাবে দাম বেড়েছিল। এখন বাজারে সরবরাহ বেড়েছে। মূলত মিল মালিক হাজার হাজার টন ধান মজুদ করে রেখে ধানের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে রেখেছে।
এদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত সারাদেশে মোট ৬ লাখ ৫৯ হাজার ১৮৬ টন ধান ও চাল সংগ্রহ হয়েছে। তার মধ্যে ধানের পরিমাণ মাত্র এক লাখ ৮৩ হাজার ৮৪৩ টন। সিদ্ধ চাল সংগ্রহ হয়েছে ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৭৬৬ টন। আতপ চাল সংগ্রহের পরিমাণ ৬৪ হাজার ৯২২ টন। গুদামে ধান-চাল না আসায় সরকারের বোরো সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। আগামী ৩১ আগস্ট সংগ্রহ অভিযান শেষ হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় সাড়ে ১০ লাখ টন চাল সরকারি গুদামে মজুদ আছে। পর্যাপ্ত উৎপাদন ও সরবরাহ থাকার পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২২ মে চালের শুল্ক দ্বিগুণ বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। বর্তমানে চাল আমদানিতে মোট ৫৫ শতাংশ শুল্ক রয়েছে। তার মধ্যে আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ২৫ শতাংশ এবং অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ। তবে খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, চালের বাজার অস্থিতিশীল করলে শুল্ক কমিয়ে বেসরকারিভাবে আমদানি উন্মুক্ত করা হতে পারে। এখন কেস টু কেস ভিত্তিতে বেসরকারি খাতে চাল আমদানির জন্য অনুমতি দেয়া হয়।
অন্যদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টদের মতে, চলতি মাসের মধ্যে কোন কোন দেশ থেকে কী পরিমাণ চাল আমদানি করা হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এখন সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করা হচ্ছে। মিল ও বাজার পর্যায়ে পর্যাপ্ত চাল মজুদ রয়েছে। আমন ওঠা পর্যন্ত চালের ঘাটতি হবে না। তবে আমনের আবাদে ক্ষতি হলে বাজারে চাল সরবরাহ ঠিক রাখতে আগাম প্রস্তুতি নেয়া হবে। এখন চালের বাজার স্বাভাবিক রাখতে মনিটরিং জোরদার করা হচ্ছে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে ইতিমধ্যে বৈঠক করা হয়েছে। চাল মিলগুলো চুক্তি অনুযায়ী চাল সরবরাহ করেনি। তাদের এ মাসের মধ্যে চাল দিতে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সেজন্য তারা বাজার থেকে ধান কেনা বাড়ানোয় ধানের দাম বাড়তে পারে। তবে চালের বাজার স্বাভাবিক রাখতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে খাদ্য অধিদফতরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, করোনা দুর্যোগের এ সময়ে চালের দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়ানো উচিত নয়। মিলগুলো পর্যাপ্ত মজুদ আছে এমন বলে আমদানি না করার দাবি জানালেও সরকারকে চুক্তি অনুযায়ী চাল দিতে চাইছে না। যেসব মিল চাল দেয়নি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। চাল সংগ্রহ পর্যাপ্ত না হওয়ায় সরকারি মজুদ বাড়াতে আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে প্রক্রিয়া চলছে। বেসরকারিভাবে চাল আমদানির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।