রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) পওর বিভাগের বিতর্কিত নির্বাহী প্রকৌশলী কোহিনুর আলমকে অবশেষে শাস্তিমুলক বদলী করা হয়েছে। এর আগে দুই দফা বদলী করা হলেও অদৃশ্য খুটির জোরে রাজশাহীতেই থেকে অনিয়মের মাত্রা বাড়িয়েছিলেন তিনি। অবশেষে কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্তের পর সর্বশেষ ২০ আগস্ট বাপাউবো সদর দফতরের উপ-সচিব (প্রশাসন) সৈয়দ মাহবুবুল হক সাক্ষরিত এক আদেশ তাকে বদলি করা হয়। এর আগে বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকা- পরিচালনার অভিযোগে বিতর্কিত এই নির্বাহী প্রকৌশলী কোহিনুর আলমের বিরুদ্ধে জাতীয় দৈনিক ‘প্রতিদিনের সংবাদ, দৈনিক বার্তা ও সংবাদ সংস্থা এফএনএস’-সহ বিভিন্ন গনমাধ্যমে একাধিকবার ফলাও করে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যার প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট দফতর তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করেন। এরপর ওইসব অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ মিললে তাকে একাধিকবার শাস্তিমূলক বদলীর আদেশ দিলেও অদৃশ্য শক্তির জোরে তিনি এখানেই থেকে যান।
তার বিরুদ্ধে সর্বশেষ উত্থাপিত অভিযোগের তদন্ত শেষে গত ২০ আগস্ট জারীকৃত শাস্তিমূলক বদলীর এ আদেশে বলা হয়েছে, পরবর্তি তিন কর্মদিবসের মধ্যে নির্বাহী প্রকৌশলী কোহিনুর আলমকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বাপাউবো) আইসিজেড ঢাকায় নির্বাহী প্রকৌশলী (পুর) হিসেবে যোগদান করতে হবে। বাপাউবোর মহপরিচালকের অনুমোদনক্রমে এই বদলীর আদেশ জারি করা হয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। সে অনুযায়ী সোমবার (২৪ আগস্ট) তার যোগদানের কথা। তবে প্রাপ্ত তথ্যমতে যোগদান না করে আবারো বদলী ঠেকাতে তৎপরতা শুরু করেছেন। যার প্রমাণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট অফিসের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নতুন কর্মস্থলে যোগদানের জন্য কখনোই তিনি রাজশাহী অফিসের গাড়ি নিয়েই ঢাকায় যেতেন না। এর আগেও বদলীকৃত কোন স্যার এখানকার সরকারি গাড়ি নিয়ে যোগদান করতে যাননি।
পাউবো সূত্র জানায়, বদলী আদেশের পর পূর্বের কর্মস্থলের গাড়ি ব্যবহারে সরকারি অনুমতি নাই। কিন্তু গাড়ি নিয়ে এখন ঢাকায় অবস্থান করাতেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে তিনি বদলীর আদেশ ঠেকাতেই আবারো গেছেন। এর আগেও একইভাবে ঢাকায় গিয়ে তিনি বদলীর আদেশ ঠেকিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে স্থানীয় একটি সিন্ডিকেটকে হাত করে যা ইচ্ছে তাই করে যাচ্ছিলেন পাউবোর রাজশাহীর এই নির্বাহী প্রকৌশলী কোহিনুর আলম। এ প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে নিজ দপ্তরের কর্মচারী পেটানো থেকে শুরু করে ঠিকাদারদের সঙ্গে অনৈতিক লেনদেন, বেপরোয়া আচরণসহ বিভিন্ন কাজের ওয়ার্ক অর্ডারে জালিয়াতি ছাড়াও প্রাক্কলনে জালয়াতি এবং ই-টেন্ডারিংয়ে টেম্পারিং করে অবৈধভাবে দর প্রদানের মাধ্যমে পূর্ব নির্ধারিত ঠিকাদারকে কাজ প্রদানের অনেক অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, কোহিনুর আলমের এমন অনৈতিক কর্মকা-ে অধিনস্ত ঠিকাদার, কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। সর্বশেষ বদলীর আদেশে রাজশাহী পাউবোর সংশ্লিষ্টরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
রাজশাহী পাউবোর ঠিকাদাররা জানান, কোহিনুর আলম গত ৬ মাস ধরে রাজশাহী পওর বিভাগে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। রাজশাহীতে যোগদানের পর থেকে তিনি সরাসরি ঠিকাদারদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা গ্রহনসহ নানা অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এর আগে একাধিকবার বদলী করা হলেও কালো টাকার জোরে বদলী ঠেকিয়ে রাজশাহীতে এসে আবারো অনৈতিক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড রাজশাহীর ঠিকাদার সমিতির কার্যকরি কমিটির উপদেষ্টা আসাদুল্লাহ ও সদস্য নূর-ই-আলম সিদ্দিকি সোমবার (২৪ আগস্ট) বিকেলে জানান, ‘প্রতিটি কথায় বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তিনি টেনে আনেন। অথচ বাস্তবে তিনি সরকারি বিরোধী ঠিকাদার পরিবেস্টিত হয়ে রাষ্ট্র ও পাউবো বিরোধী কর্মকা-ে লিপ্ত থাকেন, সরকার ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেন। তার দফতরে সব সময় বহিরাগত অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ঘিরে থাকেন। ফলে কোনো কাজের জন্য গেলে তার মনোনিত ঠিকাদার ছাড়া ওই দফতরে প্রবেশ করতে পারেন না। তারা অভিযোগ করেন, বর্তমানে তিনি পাউবোর রাজশাহী পওর বিভাগ ‘ব্যক্তিগত বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিনত করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এর আগে কোহিনুর আলম ২০০৫ সালে বাপাউবোতে যোগদানের পর চাঁপাইনববাগঞ্জ ও বগুড়ায় উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালনকালে শুরু হয় তার কুকর্ম। পরবর্তিতে তিনি সাতক্ষীরা ও ফেনীতে দায়িত্ব পালনকালেও নৈরাজ্য সৃস্টি করেন। শান্তিসরূপ তাকে একাধিকবার মাঠ পর্যায় থেকে ঢাকায় ক্লোজড করাও হয়। এরপর ক্ষমতার দাপট ও বোর্ডে ভুল তথ্য দেখিয়ে তিনি চলে আসেন রাজশাহীতে। পরে অনৈতিক ও নৈরাজ্যের কারণে চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি তাকে পুনরায় শান্তিমুলক ঢাকা সিইআইপিতে বদলী করা হলেও অদৃশ্য খুটির জোরে সে বদলীর আদেশ স্থগিত করে তিনি রাজশাহীতেই থেকে যান।
শুধু তাই নয়, বদলী আদেশ স্থগিতের পর রাজশাহী এসে আবারো বেপরোয়া হয়ে উঠেন তিনি। এবার অধিনস্ত কর্মীচারীদের লাঞ্চিত করার অভিযোগ উঠে। এ প্রেক্ষিতে অধিনস্ত কর্মচারিরা নির্বাহী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শণ ও অপসারন দাবিও করে। পাউবো রাজশাহীর পওর সার্কেলের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর কাছেও একাধিক অভিযোগ করেছেন কর্মচারিরা।
অভিযোগে আরো জানা যায়, নির্বাহী প্রকৌশলী কোহিনূর আলম অফিসে বহিরাগতদের নিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরী করেছেন। ফলে তিনি কাউকে কোনো কোয়াক্কা করেন না। অধিনস্ত কর্মচারিরা সারাক্ষণ তার হুমকি-ধামকির মুখে তটস্ত হয়ে থাকেন। যখন-তখন কর্মচারিদের ওপর তিনি মারমুখি আচরণ করেন। অকথ্য গালিগালাজ করে চরম হয়রানী ও কথায় কথায় চাকরিচ্যুতির হুমকি দেন।
এসব অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করে রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও রাজশাহী চেম্বারের সাবেক পরিচালক জামাত খান সোমবার (২৪ আগস্ট) বিকেলে মুঠোফোনের মাধ্যমে জানান, ‘নির্বাহী প্রকৌশলী কোহিনুর আলম রাজশাহীতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই দরপত্রে অনিয়ম, অনৈতিক কর্মকা- ও স্বেচ্চাচারি হয়ে উঠেন। এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি বদলীর আদেশ পেলেও তা ঠেকিয়ে আবারও এখানে ফিরে আসেন।’
অভিযুক্ত এ নির্বাহী প্রকৌশলী কোহিনুর আলমের শুধু বদলী কার্যকর-ই নয়, তার অপকর্মের জন্য উচ্চ পর্যায়ের তদন্তপূর্বক কঠোর শান্তির আওতায় নিতে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণের জন্যও দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্ট সমাজ সেবক জামাত খান।
সার্বিক বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী কোহিনুর আলমের সঙ্গে মুঠোফোনের মাধ্যমে জানতে চাইলে তিনি বলেন মিটিংয়ে আছি। এ সময় তার বিরুদ্ধে ঊত্থাপিত অভিযোগগুলো শুধু সঠিক কি-না জানতে চাইলে কোনো বক্তব্য না দিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে মুঠোফোন বন্ধ করে দেন। পরে পাউবো রাজশাহী পওর সার্কেলের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোখলেসুর রহমানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুঠোফোনে বলতে রাজি হন নি।