বিশেষ সুবিধা ও ছাড়ের পরও মহামারীকালে ফের বাড়তে শুরু করেছে ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণের অঙ্ক। তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা বেড়ে ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এই অঙ্ক মোট বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। মার্চ মাস শেষে যা ছিল ৯ দশমিক ০৩ শতাংশ। ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সুদে খেলাপি ঋণ পরিশোধের ‘বিশেষ’ সুযোগসহ নানা ছাড় দেওয়ার পরও এই চিত্র দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রোববার খেলাপি ঋণের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২০ সালের জুন মাস শেষে দেশের ৫৯টি ব্যাংক মোট ১০ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এরমধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ২৪ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। খেলাপির পরিমাণ ছিল ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। তবে অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, এটি খেলাপি ঋণের ‘প্রকৃত চিত্র এটা নয়’। বাংলাদেশ ব্যাংক ‘কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কম দেখিয়ে’ ব্যাংক খাতের জন্য ‘বিপদ’ ডেকে আনছে বলেও সতর্ক করেছেন তিনি। গত বছরের ডিসেম্বরে ১০ লাখ ১১ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপির অঙ্ক ছিল ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছরের মার্চ মাস শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। ওই সময়ে বিতরণ করা ৯ লাখ ৩৩ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা ঋণের ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ ছিল খেলাপি। গত এক বছরে প্রকৃতপক্ষে কোনো খেলাপি ঋণ আদায় হয়নি। গত বছরের ১৬ মে ঋণ খেলাপিদের মোট ঋণের ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সুদে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরে পরিশোধের সুযোগ দেয় সরকার। ‘বিশেষ’ ওই সুবিধার আওতায় জুন পর্যন্ত প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ ব্যাংকগুলো নবায়ন করেছে। এর অর্ধেকই করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিয়েও গত বছর বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। সবমিলিয়ে ৭৫ থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এর বাইরে জুন পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ অবলোপন (রাইট অফ) করেছে ব্যাংকগুলো। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের হিসাব থেকে এই অর্থ বাদ যাবে, যদিও তা আর ফেরত আসছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকই আরেক তথ্যে জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০০ জন ঋণগ্রহীতা আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে রেখেছেন। ফলে ঋণ খেলাপি হিসেবে তাদের নাম বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ তথ্য ব্যুরোতে (সিআইবি) উল্লেখ করা হয় না। এ রকম ঋণের পরিমাণ এখন ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো। এই সব খেলাপি ঋণ যোগ করলে দেশে এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় তিন লাখ কোটি টাকার মতো। চলতি বছরের মার্চ থেকে দেশে শুরু হয় মহামারী করোনাভাইরাসের প্রকোপ। এই সঙ্কটকালে ঋণ খেলাপিদের আরও সুবিধা দিয়েছে সরকার; আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কিস্তি না দিলেও খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে হচ্ছে না। এর আগে করোনাভাইরাসের কারণে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ঋণ শ্রেণিকরণে স্থগিতাদেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। মহামারীর প্রকোপ দীর্ঘায়িত হওয়ায় আরও তিন মাস বর্ধিত করা হয়েছে ওই সময়। অর্থাৎ চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোনো ঋণের শ্রেণিমান পরিবর্তন করা যাবে না। যে ঋণ যে শ্রেণিতে আছে, সে অবস্থাতেই থাকবে। গত ১৫ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে এ-সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে তথ্য দিচ্ছে, আসল অঙ্ক এর আড়াই গুণ বেশি। এ ধরনের মিনিংলেস তথ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করছে। এতে আমাদের ব্যাংকিং খাতের ভয়ানক ক্ষতি হচ্ছে। “ঋণ আদায় না করে, ঋণ খেলাপিদের নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা দিয়ে কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী মজা পাচ্ছে, তা আমার মাথায় ঢোকে না।” ঋণ খেলাপিদের বার বার ছাড় দিয়ে ‘ভালো’ ঋণ গ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে মন্তব্য করে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর বলেন, “এই ভুল সিদ্ধান্ত গোটা ব্যাংকিং খাতের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনবে বলে আমি মনে করি।” মনসুরবাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গত বছরের নভেম্বরে যে প্রতিবেদন দিয়েছিল, তাতে ‘আসল জায়গায় আঘাত’ করা হয়েছিল মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আইএমএফ বলেছিল, বাংলাদেশে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মধ্যে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার প্রবণতার শিকড় অত্যন্ত গভীরে। প্রভাবশালী, ওপর মহলে ভালো যোগাযোগ আছে এবং ধনী, এমন কিছু ব্যবসায়ী ঋণ ফেরত দেওয়ার কোনো তাগিদই অনুভব করেন না। এমনকি বাংলাদেশে আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও এখন নিচ্ছেন প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান এসব ঋণ গ্রহিতারা। আহসান মনসুর বলেন, “আমি ভেবেছিলাম, আইএমএফের ওই রিপোর্টের পর সরকারের কিছুটা হলেও টনক নড়বে। কিন্তু এখন দেখছি, কিছুই হয়নি।“ বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ‘ছাড়’ দেওয়ার কারণে এপ্রিল-জুন সময়ে নতুন করে কোনো ঋণ খেলাপি হয়নি। ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সুদে খেলাপি ঋণ পরিশোধের যে বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়েছে, মহামারীর কারণে সে সুযোগও নিতে পারেনি অনেকে। সে কারণেই এই তিন মাসে খেলাপি ঋণ কিছুটা বেড়েছে। পরের প্রান্তিকেই (জুলাই-সেপ্টেম্বর) তা কমে আসবে বলে আসা প্রকাশ করেন তিনি।