জীবিকার তাগিদ ওদের কে পঙ্গু বানিয়েছে। কোনকিছু না বুঝে কাজে ঝুঁকির গিয়েছিল ওরা। কাজটা যে কঠিন ও জীবন নিয়ে খেলা, তা তারা কেউই বুঝতে পারেনি। জীবন আর জীবিকার টানে কোন চিন্তা না করেই পল্লী বিদ্যুত লাইনের কাজ করতে গিয়ে এখন তারা পঙ্গু। কেউ হারিয়েছে দুই হাত। কেউ এক হাত, কেউ পা। হাত, পা হারিয়ে বিপন্ন জীবন পার করছেন তারা। এমনই গা শিউরে ওঠার ন্যায় ঘটনা গত কয়েক বছরে একের পর এক ঘটছে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার কচুয়া ইউনিয়নে। এদের দেখার বা খোঁজ নেওয়ার এখন কেউ নেই।
পল্লী বিদ্যুতের কাজে গিয়ে পঙ্গুত্বের শিকার উপজেলার চন্দনপাঠ গ্রামের ফারুক হোসেন জানায়, ২০০৮ সালের জানুয়ারী মাসে পল্লী বিদ্যুতের কাজ করতে যাই বগুড়ার সিলিমপুর মাদলায়। টানা কাজ করছিলাম, বুঝতে পারিনি। হঠাৎ ১১ হাজার ভোল্টেজের তারে হাত দিতেই ১৮ সেকেন্ডেই আমার জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। আমি অজ্ঞান ছিলাম। জেগে দেখি আমার এক হাত নেই। হাতটি কেটে ফেলা হয়। এমনটা শুধু ফারুকের ক্ষেত্রেই নয়। কথা বলতে বলতে কেঁদে ঘটনার বর্ণনা দেন, একই গ্রামের বাদশা মিয়া, এনামুল, বাবু, জাহিদুল, দছিবর। তাদের ভাগ্যেও ঘটেছে এই করুন পরিনতি। এদের কারো কারো হাত পা দুটোই কেটে ফেলা হয়। কারো দুই হাত কেটে ফেলা হয়। এখন তারা বাড়িতেই অতি কষ্টে দিন পার করছেন। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কিংবা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির পক্ষ থেকে এদের কারো খোঁজ খবর নেওয়া হয়নি।
একইভাবে দু হাত হারনো উপজেলার চন্দনপাঠ গ্রামের যুবক বাদশা মিয়া বলেন, ১১ হাজার ভোল্টেজের লাইন চালু রেখেই বিদ্যুতের তারের সংযোগ লাগাতে বলা হয়। বারবার বলেছি লাইন বন্ধ করা হয়েছে কি না। ঠিকাদার বললেন কাজ করো। সমস্যা হবে না। বুঝতে না পেরে চাপের মুখে সংযোগ স্থাপনের জন্য বিদ্যুতের তারে হাত দিই। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে খুঁটিতে ঝুলে যাই। এ অবস্থা দেখে অবস্থায় পালিয়ে যান ঠিকাদার। পরে বিদ্যুতের সংযোগ বন্ধ করে আমাকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। প্রাাণে বাঁচলেও হাত দুটো কেটে ফেলতে হয় আমার। এখন প্রতিবন্ধী হয়ে বেঁচে আছি। ঠিকাদারের আজ আমি ভুলে চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেলাম। পল্লী বিদ্যুতের কাজ করতে গিয়ে পঙ্গু হওয়ার এমন নির্মম ঘটনার এভাবেই বর্ণনা দিলেন বাদশা মিয়া। বার বার সেদিনের ঘটনার কথা মনে করে কেঁদে ওঠেন বাদশা মিয়া। ২০০৯ সালে সাঘাটার পার্শবতি মহিমাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন বাদশা। ২০১১ সালে এমএ মোত্তালিব টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। অনেক কষ্টে পড়াশোনা চালিয়ে বোনারপাড়া সরকারি কলেজ থেকে ২০১৭ সালে বিএ পাস করেন তিনি। বাদশা মিয়ার বাবা মোসলেম উদ্দিন বলেন, ঠিকাদার মোখলেছুর রহমানের খামখেয়ালীপনায় আমার ছেলে পঙ্গু হয়ে গেছে। কোনো ক্ষতিপূরণ না দিয়ে এখন হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন মোখলেছুর রহমান। তার ভয়ে অসহায় জীবনযাপন করছি আমরা। আমি এ ঘটনার উপযুক্ত বিচার চাই। এত বড় ক্ষতির পরও আমাদের কোনো সহযোগিতা করেনি ঠিকাদার কিংবা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। আমাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই।
এদিকে পল্লী বিদ্যুত সমিতির প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার সতীতলা গ্রামের মোহাম্মদ আলী জানান, গ্রাউন্ডিং না করার কারণে এমন দূর্ঘটনা ঘটেই চলেছে।
এ পর্যন্ত বাদশা মিয়ার মতো একই পরিনতি ভোগ করেছেন, উপজেলার কচুয়া ইউনিয়নের চন্দনপাঠ গ্রামের প্রায় ৩০ জন ব্যক্তি। ঠিকাদারের হয়ে পল্লী বিদ্যুতের কাজ করতে গিয়ে পঙ্গু হয়েছেন তারা। এসব ঘটনার জন্য ভুক্তভোগিরা দায়ী করছেন জনবল সরবরাহকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স সোহরাব এন্টারপ্রাইজের মালিক মোখলেছুর রহমান বলেন, সব ঘটনার জন্য ঠিকাদার দায়ী নয়। বাদশার বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা চলছে। এক সপ্তাহের মধ্যে বিষয়টি মীমাংসা করা হবে। তবে দুর্ঘটনার সময় বিদ্যুতের লাইন বন্ধ না করার জন্য ঠিকাদার দায়ী নয়। ঠিকাদারের কাজে নিযুক্ত সুপারভাইজার ও শ্রমিক সর্দারের বিষয়টি দেখার কথা। একই গ্রামের এনামুল ও বাবু ফেনি ও সিলেটে কাজ করতে গিয়ে অনুরূপ দূর্ঘটনার শিকার হন। তারাও এমন করুন পরিণতির কথা জানায়। এদিকে গত ১৫ বছরে একই গ্রাম থেকে একই কাজে দূর্ঘটনায় অকালে মৃত্যুবরণ করেন হাই, নুরু, রুবেল, জোবেদ আলী, শাহজাহান সহ নাম না জানা অনেকেই। ক্ষতিপূরণ তো দূরের কথা এদের পরিবারের খোঁজ খবর কেউ নেয় না।
অভিজ্ঞতা ছাড়া ঠিকাদারের লোকজন বিদ্যুতের কাজ করতে পারবে কি-না জানতে চাইলে গাইবান্ধা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বোনারপাড়া জোনাল অফিসের এজিএম আব্দুল হালিম বলেন, আমরা পল্লী বিদ্যুতের যেকোনো কাজ টেন্ডারের মাধ্যমে ঠিকাদারদের দেই। নতুন সংযোগ বা ট্রান্সফর্মার পরিবর্তনের জন্য পল্লী বিদ্যুতের নির্দিষ্ট ফরমের মাধ্যমে আবেদন করতে হয়। নিয়ম বহির্ভূতভাবে কাজ করতে গিয়ে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার জন্য ঠিকাদার দায়ী থাকবেন। যেহেতু টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ দেয়া হয় সেহেতু দুর্ঘটনার দায় নেবে না পল্লী বিদ্যুৎ।