সারাদেশের সব পুলিশ চেকপোস্ট সিসিটিভির ক্যামেরার আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ওই লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি প্রকল্প জমা দেয়া হয়েছে। কারণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাক্ষী-প্রমাণের চেয়ে তথ্যপ্রযুক্তিগত ক্লু যে কোনো তদন্তের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তি অনেক ঘটনায় তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। সিসিটিভির ফুটেজের তথ্য ধরে বাংলাদেশেও অনেক বড় বড় ঘটনার আসল কাহিনি জানা গেছে। গত ৩১ জুলাই টেকনাফের এপিবিএনের চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে সাবেক মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের মৃত্যুর ঘটনার পর আবারো সিসিটিভির গুরুত্ব আলোচনায় উঠেছে এসেছে। সংশ্লিষ্ট অনেকের মতে, ওই চেকপোস্টে সিসিটিভি বা দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের কাছে বডি ওর্ন ক্যামেরা থাকলে অনেক প্রশ্নের জট সহজেই খুলে যেতো। পুলিশ সদর দপ্তর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কক্সবাজারে সাবেক মেজর সিনহার মৃত্যু ঘটনার পর পুলিশ চাইছে দ্রুত সব চেকপোস্টে ক্যামেরা বসানো হোক। তাতে অনেক সময় পুলিশের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগের আঙুল তুললেও আসলে কী ঘটেছে তা সিসিটিভি বা বডি ওর্ন ক্যামেরাই সহজেই বোঝা যাবে। করোনার কারণে অনেক দিন ধরেই সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য না থাকলে কারো গাড়ি থামিয়ে ব্যাগ বা শরীর তল্লাশি করা হচ্ছিল না। বিভিন্ন জায়গায় চেকপোস্ট থাকলেও খুব বেশি প্রয়োজন না হলে তল্লাশি করা হচ্ছে না। কিন্তু কক্সবাজারের ঘটনার পর চেকপোস্টে যারা দায়িত্ব পালন করছে তারা আরো বেশি সংবেদনশীল। কারণ অনেক ঘটনার পরই দুই ধরনের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে সিসিটিভি বা বডি ওর্ন ক্যামেরা থাকলে মূল রহস্য বের করা বা আসল দৃশ্যপট জানা সহজতর হয়।
সূত্র জানায়, সড়ক-মহাসড়কে মূলত দুই ধরনের চেকপোস্ট থাকে। তার মধ্যে একটি হলো স্থায়ী। কূটনৈতিক এলাকায় এ ধরনের স্থায়ী চেকপোস্ট রয়েছে। আবার অনেক সময় অপরাধী ধরতে কৌশলগত অবস্থান থেকে হঠাৎ কোনো জায়গায় চেকপোস্ট বসানো হয়। স্থায়ী চেকপোস্টে সিসিটিভি ক্যামেরার বসানো যায়। তবে হঠাৎ চেকপোস্ট বসাতে হলে সেখানে সিসিটিভি ক্যামেরা নেয়া যায় না। ওই জায়গায় দায়িত্বরত সদস্যদের বডি ওর্ন ক্যামেরা থাকতে হবে। দিনে-রাতে যখনই চেকপোস্ট বসানো হয়, সেখানে যাতে পুলিশ সদস্যরা বডি ওর্ন ক্যামেরা সঙ্গে রাখে এবং তা চালু রাখে তা নিশ্চিত করা হবে। বিগত কয়েক বছর ধরে রাজধানীতে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের বডি ওর্ন ক্যামেরা দেয়া হয়। ওই ক্যামেরা দেয়ার পর গাড়ির চালক থেকে শুরু করে পথচারীরা রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে সাবধানে কথা বলছে। আবার ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরাও পথচারীদের সঙ্গে কথোপকথনে সতর্কতা বজায় রাখছে। তবে দেখা যাচ্ছে পুলিশ সদস্যরা অধিকাংশ জায়গায় বডি ওর্ন ক্যামেরা চালু রাখছে না।
সূত্র আরো জানায়, আইন-শৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ যেসব উদ্যোগ নিয়ে থাকে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে চেকপোস্ট। উন্নত বিশ্বে প্রায় সব চেকপোস্টই সিসিটিভির আওতাধীন। সেখানে দায়িত্ব পালনকারীদের কাছেও ক্যামেরা থাকে। অপরাধ দমনে তা যথেষ্ট কাজে আসে। বাংলাদেশেও একাধিক সময় চেকপোস্টে অনেক দাগী আসামি ও জঙ্গি ধরা পড়েছে। প্রায় ৬ বছর আগে রাজধানীর গাবতলীতে একটি চেকপোস্টে সন্দেহভাজন ৩ জনকে তল্লাশির সময় মাসুদ রানা নামে এক দুর্ধর্ষ জঙ্গি ধরা পড়ে। ওই চেকপোস্টে ছুরিকাঘাত করে পুলিশের এক সদস্যকে হত্যার পর মাসুদের দুই সহযোগী পালিয়ে যায়। পরে জানা যায় নব্য জেএমবির যে অংশটি হলি আর্টিসানে হামলা করেছিল; তাদের সহযোগী ছিল মাসুদ রানা। এভাবে অনেক সময় পুলিশের চেকপোস্টকে টার্গেট করে অপরাধী ও জঙ্গিদের হামলা চালাতে দেখা গেছে। গত এক বছরে ঢাকা ও চট্টগ্রামে একাধিক চেকপোস্ট ও ট্রাফিক বক্সের আশপাশে ছোটখাটো বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে অপরাধ দমনে প্রযুক্তির গুরুত্ব বিষয়ে অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, সিসিটিভি ফুটেজের কারণেই বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যারহস্য দ্রুত উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়েছে। বরগুনায় সিফাত হত্যার ঘটনার অনেক ক্লু সিসিটিভি থেকে বের হয়েছে। পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনায়ও অনেক রহস্যের জটও সিসিটিভি খুলে দেয়। সর্বশেষ পর্বতারোহী রেশমা নাহার রতœার সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনায় ৩৮২টি সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্নেষণ করে ঘাতক মাইক্রোবাস চালক নাঈমকে প্রেপ্তার করে পুলিশ। চেকপোস্ট সিসিটিভি ও বডি ওর্ন ক্যামেরার আওতায় এলে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে। অনেক সময় এমন অভিযোগ পাওয়া যায়- চেকপোস্টে তল্লাশির নামে নিরীহ মানুষের পকেটে ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক দিয়ে পুলিশই ফাঁসিয়েছে। আবার তল্লাশির নামে কারো কাছ থেকে টাকা, স্বর্ণালঙ্কারসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। চেকপোস্টে স্বর্ণালঙ্কারসহ দামি কিছু পাওয়া গেলে উদ্ধার তালিকায় তা ঠিকঠাক দেখানো হয় না এমন অভিযোগও রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে চেকপোস্টে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার এমন ধরনের অনিয়ম রুখতে সহায়তা করবে। চেকপোস্টে সাধারণ মানুষের সঙ্গে পুলিশ সদস্যরা কেমন আচরণ করে তা জানতে প্রতিদিন সিভিল ড্রেসে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সরেজমিন মনিটর করার নিয়ম থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা পালিত হয় না।
অন্যদিকে এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান জানান, সিসিটিভি বিলাসী কোনো পণ্য নয়। মডার্ন সিকিউরিটি সিস্টেমের অংশ। আরো আগেই পুলিশের সব চেকপোস্ট সিসিটিভির আওতায় আনা দরকার ছিল। শুধু চেকপোস্ট নয়; পুলিশের আর কী ধরনের স্পর্শকাতর স্থাপনা রয়েছে যেখানে সিসিটিভি লাগবে তাও খুঁজে বের করা দরকার। তবে শুধু সিসিটিভি লাগালেই হবে না; এর যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। কেননা অতীতের কিছু অভিজ্ঞতা সুখকর নয়।
এ প্রসঙ্গে ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম জানান, শিগগিরই ঢাকার ১০০ ক্রসিং পয়েন্টে ৬০০ সিসিটিভি ক্যামেরা বসছে। এর জন্য দরপত্রও হয়ে গেছে। চেকপোস্টে আসলে কী ঘটছে তা সঠিকভাবে জানতে সিসিটিভির আওতাধীন ও দায়িত্বরত সদস্যদের বডি ওর্ন ক্যামেরা কাজে আসে। বডি ওর্ন ক্যামেরাও সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু অনেক ঘটনার পর দেখা যায় পুলিশ সদস্যরা বডি ওর্ন ক্যামেরা চালু রাখেনি। ফলে আসল ঘটনা বের করা যায়নি।