জামালপুরের যমুনা সার কারখানা কেন্দ্রিক গড়ে উঠা তারকান্দি ট্রাক মালিক সমিতি, ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন ও ট্যান্সপোর্ট মালিক সমিতির নেতাদের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে কারখানার এরিয়ার ১৯ জেলার বিসিআইসির তালিকাভুক্ত সার ডিলাররা। এসব নেতাদের বেপরোয়া চাঁদাবাজির প্রতিবাদে সম্প্রতি কারখানা থেকে ইউরিয়ার সার উত্তোলন বন্ধ করে দেয় ভুক্তভোগি ডিলাররা। প্রভাবশালী নেতাদের নানা ধরণের হুমকী ও ব্যবসায়ীরা টিকতে পারছেন না ভুক্তভোগী ডিলাররা।
জানাযায়,দেশের সর্ববৃহৎ দানাদার ইউরিয়া সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান যমুনা সার কারখানা। এই কারখানা থেকে জামালপুর, শেরপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ছাড়া উত্তরবঙ্গের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৯ জেলার বিসিআইসির তালিকাভুক্ত সার ডিলাররা সার উত্তোলন ও কৃষকদের মাঝে বিক্রি করে থাকেন। কারখানা থেকে প্রতিদিন এসব জেলায় শত শত মেট্রিক টন সার সরবরাহ হয়ে থাকে। এতে করে সার কারখানা কেন্দ্রিক গড়ে উঠে ট্রাক মালিক সমিতি, ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন ও ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি। এই সুযোগে বছরে প্রায় ৫ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে আসছে ট্রাক মালিক সমিতি, ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন ট্র্যান্সপোর্ট মালিক সমিতি। বোরো ও রোপা-আমন মৌসুমের ইউরিয়া সারের ব্যাপক চাহিদা থাকায় নানা অজুহাতে প্রভাবশালী এসব নেতারা মাসে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগি ডিলারদের।
সার ডিলার ও ট্যান্সপোর্ট এজেন্সির মালিকদের অভিযোগ, ট্রাক মালিক ও ট্রাক শ্রমিক নেতারা রাজনৈতিক ছত্রছাঁয়ায় স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বেপরোয়া চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কোন ডিলার বা ব্যবসায়ী প্রতিবাদ করতে সাহস পান না। অনেক ডিলার তাদের চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানী স্বীকারসহ লাঞ্চিত হয়ে থাকেন। এসব কারণে জামালপুর জেলার বাইরে উত্তবঙ্গের বিসিআইসির তালিকাভুক্ত ইউরিয়া সার ডিলাররা সরাসরি সার উত্তোলন না করে ট্র্যান্সপোর্ট এজেন্সির মাধ্যমে যমুনার সার কারখানা থেকে সার উত্তোলন করে আসছেন।
ডিলাররা জানিয়েছেন,১২ মেট্রিক টন অথাৎ এক ট্রাক সার উত্তোলন করতে গেলে স্থানীয় ডিলারদের কাছ থেকে জামালপুর জেলা ট্রাক মালিক ও শ্রমিক সংগঠণ ৪শ’ টাকা চাঁদা নেয়া হলেও উত্তরবঙ্গ ও বাইরের জেলার ডিলাদের ট্রাকের ভাড়ার উপর শতকরা ১০ ভাগ হিসেবে চাঁদা দিতে হয়। এতে ১২ মেট্রিক টন সার উত্তোলন করতে উত্তরবঙ্গের ডিলারদের দেড় হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। এ ছাড়া প্রতি বস্তা সার উত্তোলনের সময় মালিক সমিতিকে চাঁদা দিতে হয় ১ টাকা ৫০ পয়সা। এতে ১২ মেট্রিক টন (এক ট্রাক) সারের জন্য আরো ১৮০ টাকা বাড়তি চাঁদা গুনতে হয়। এ ছাড়া আমদানীকৃত নষ্ট হওয়া সার যাতে না দেয়া হয় সেই জন্য ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ট্রাক প্রতি দিতে হয় ২ থেকে ৩ হাজার টাকা। ঘাটে ঘাটে এসব চাঁদা দিতে গিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে যমুনা সার কারখানার ১৯ জেলার ডিলাররা।
সার ডিলার ও ট্যান্সপোর্ট এজেন্সির মালিকরা বলেন, প্রতি বছর সাড়ে ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ মেট্রিক টন সার কারখানা ডিলারদের মাঝে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এই পরিমাণ সার পরিবহণ করতে প্রায় ৩৫ হাজার ট্রাকের প্রয়োজন হয়। সার পরিবহণ করতে প্রতি ট্রাকে গড়ে ১ হাজার ৫শ টাকা হিসেবে সাড়ে ৪ কোটি এবং প্রতি বস্তা ১টাকা ৫০ পয়সা হিসেবে এক কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে থাকেন পরিবহণ সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেটের কতিপয় প্রভাবশালী নেতা। এ ছাড়া আমাদানীকৃত সার নিয়ে মালিক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হাতিয়ে নেয় কোটি টাকা। এতে প্রতিবছর ৫ থেকে ৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ট্রাক মালিক সমিতির ও শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা। যা ট্র্যান্সপোর্ট এজেন্সির মাধ্যমে সার ডিলারদের কাছে পাঠানো সারের খরচ বাবদ ট্র্যান্সপোর্ট এজেন্সির মালিকদের চালান বই যাচাই করলেই এই চাঁদাবাজির সঠিক তথ্য বেরিয়া আসবে।
তারা আরো বলেন, ২০১৮ সালের শেষ দিকে যমুনা সার কারখানায় আগুন লেগে এক বছরেরও অধিক সময় কারখানা বন্ধ থাকে। এ সময় বিসিআইসি বিদেশ থেকে আমদানি করা ইউরিয়া দিয়ে যমুনা সার কারখানা এরিয়ার ১৯ জেলার কৃষকদের সারের চাহিদা পুরণ করেন। কিন্তু যমুনার দানাদার ইউরিয়া সার উৎকৃষ্ট মানের হওয়ায় ফলন ভাল হয়। এতে এ অঞ্চলের কৃষকদের কাছে যমুনার উৎপাদিত সারে চাহিদা অনেক বেশী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সার ডিলার ও ট্র্যান্সপোর্ট এজেন্সির মালিকরা বলেন, বিদেশ থেকে আমদানি করা সার কারখানা কর্তৃপক্ষ খোলা আকাশের নীচে রাখায় রোদে শুকিয়ে এবং বৃষ্টিতে বীজে জমাট বেঁধে গুনগত মান নষ্ট হয়ে যায়। তাই এসব সার কৃষকরা নিতে চায় না। কিন্তু কারখানা কর্তৃপক্ষ আমদানীকৃত সার প্রতি ট্রাকে বাধ্যতামুলক ২ মেট্রিক টন সার ডিলাদের চাপিয়ে দিয়ে থাকে। ফলে ডিলাররা আর্থিকভাবে ক্ষতি শিকার হচ্ছে।
ডিলারদের অভিযোগ, তারকান্দি ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ মোজাম্মেলন হক মুকুল ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ আশরাফুল ইসলাম মানিক করাখানা বিপণনের ম্যানেজার ওরেছুর রহমানের যোগসাজশে আমদানীকৃত সার কম দিয়ে ট্রাক প্রতি ২ থেকে ৩ হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। সব মিলিয়ে তারাকান্দি ট্রাক মালিক সমিতির নেতাদের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে ডিলাররা। ভুক্তভোগি ডিলারগণ মালিক সমিতির বেপোরা চাঁদাবাজি বন্ধে সংশিষ্ঠ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এবিয়য়ে তারাকান্দি ট্রাক মালিক সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বললে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ মোজাম্মেল হক মুকুল তিনি ট্র্যান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতিরও সভাপতি। তিনি এবং মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিলে তাদের নিজস্ব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এসব চাঁদাবাজি করে থাকেন। এসব চাঁদাবাজির ঘটনার সাথে কারখানার অন্যান্য কর্মকর্তা জড়িত নয় বলে দাবি করেন ডিলাররা।
এ বিষয়ে ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হক মুকুল এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তার বিরুদ্ধে এসব অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। সমিতির নিয়ম অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে বলে জানান।
এদিকে জামালপুর জেলা সার ডিলার সমিতির সভাপতি এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ চৌধুরী তিনি বলেন, ট্রাক মালিক সমিতির নেতারা ডিলারদের কাছ থেকে নানা ভাবে চাঁদা নেয়ার অভিযোগের বিষয়টি তিনি স্বীকার করে বলেন, এসব চাঁদা বন্ধের উদ্যোগ নেয়া অতীব জরুরী বলে মনে করেন।