পাচার বলতে দেশের ভেতরে অথবা দেশের সীমানার বাইরে বিক্রয়, বিনিময় বা অন্য কোন অবৈধ কাজে নিয়োগের জন্য নারী, শিশু বা কোন ব্যক্তিকে স্থানান্তর করাকে বুঝায়। মানুষ নিয়ে ব্যবসা ও মুনাফাকারীরা শিশু, নারী বা কোন ব্যক্তিকে ফুসলিয়ে, অপহরণ করে, অবরুদ্ধ করে যে অবৈধ কাজ করে তাকেই পাচার বলে।
বিগত কয়েক দশকে সমগ্র বিশ্বজুড়ে নারী ও শিশু পাচারের মাত্রা আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ নারী ও শিশু পাচারের একটি উৎস এবং ট্রানজিট রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। প্রতিদিন এদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী ও শিশু বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত দিয়ে অথবা বিমান যোগে পাচার হয়ে যাচ্ছে। পাচারকৃত নারী ও শিশুদের নিয়োগ করা হচ্ছে পতিতালয়ে বা অন্যান্য ঝুঁকিপূণ এবং শ্রমঘন অমানবিক কর্মক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারী ও শিশুর এ ধরণের নির্মম পরিণতি কোন সচেতন নাগরিকের কাম্য নয়। সরকার, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও বেসরকারী সাহায্য সংস্থা নারী ও শিশু পাচার প্রতিরোধে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহন করেছে৷ এই পাচার প্রতিরোধে সবচেয়ে জরুরী হলো সমাজের সকল অংশের মাঝে নারী ও শিশু পাচার প্রক্রিয়া এবং এর ফলাফল সম্পকে সচেতনতা তৈরি করা। আন্তজাতিকভাবে নারী ও শিশু পাচারকে আধুনিকযুগের দাসপ্রথা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পাচার প্রতিরোধে সকলে একমত হলেও পাচার কাকে বলে-এ বিষয়ে বড় ধরণের বিভ্রান্তি রয়েছে। পাচারের উদ্দেশ্য, প্রকৃতি, পদ্ধতি সবই আগের তুলনায় অনেক জটিল হয়ে গেছে। অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের অনিয়মিত অভিবাসন অনেক সময় পাচারের মত ফলাফল তৈরি করছে।
সাধারণত: যে কোন ধরনের শোষণের উদ্দেশ্যে জোড় খাটিয়ে, ছল চাতুরী, ভয় ভীতি প্রদর্শন করে এবং চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে অথবা যাকে পাচার করতে চায় তার ওপর কতৃত্ব রয়েছে এমন ব্যক্তিকে আইন বহিভূত উপায়ে টাকা দেওয়া নেওয়া করার মাধ্যমে লোক সংগ্রহ, স্থানান্তর, আশ্রয়দান ও অথের বিনিময়ে গ্রহণ ইত্যাদি যেকোন কর্মকান্ডকে পাচার বলে গন্য করা হয়।
ইন্টারন্যাশনাল অগানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) এর ব্যাখ্য অনুযায়ী মানুষ পাচার তখনই ঘটে যখনএকজন অভিবাসী জাতীয় অথবা আর্ন্তজাতিক সীমান্ত অতিক্রম করে অবৈধভাবে (চাকুরি প্রাপ্তির নিমিত্তে, অপহৃত হয়ে, বিক্রিত হয়ে) কোন কাজে নিযুক্ত হন। পাচারকারী এই কর্মকান্ডের যেকোন পযায়ে ওই অভিবাসীকে প্রতারণা, পীড়ন বা অন্য যেকোন শোষণের মাধ্যমে তার মানবাধিকার লঙ্ঘন করে অথনৈতিক বা অন্য যেকোন প্রকার মুনাফা অর্জন করে।
বর্তমানে মানব পাচার এ দেশে সামাজিক ব্যধিতে পরিনত হয়েছে। বাংলাদেশের মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ অনুযায়ী, ‘মানবপাচার’ অর্থ কোনো ব্যক্তিকে ভয় দেখিয়ে, বল প্রয়োগ বা প্রতারণার মাধ্যমে তাঁর আর্থ-সামাজিক, পরিবেশগত বা অন্য কোনো অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে এবং টাকা-পয়সার বিনিময়ে বা অন্যকোন সুবিধা লাভের জন্য তাঁর উপর নিয়ন্ত্রণ আছে এমন কারো সম্মতি নিয়ে এবং বাংলাদেশের ভিতরে বা বাইরে যৌন শোষণ, শ্রম শোষণ অথবা অন্যকোন শোষণ বা নিপীড়নের উদ্দেশ্যে ক্রয় বা বিক্রয়, সংগ্রহ বা গ্রহণ, নির্বাসন বা স্থানান্তর, চালান বা আটক করা বা লুকিয়ে রাখা বা আশ্রয় দেয়া। উল্লেখ্য, পাচারের শিকার ব্যক্তির বয়স ১৮ বছরের কম হলে বল প্রয়োগ, প্রতারণা বা প্রলোভন দেয়া হয়েছে কি না তা বিবেচনা করার দরকার নেই বরং শোষণ বা নিপীড়ন হলেই তা মানবপাচার প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট। অপরাধের মাত্রাভেদে আইনের মধ্যে মানবপাচারের বিভিন্ন রকম শাস্তির বিধান রঢেছে। এ আইনের ৬ ধারা অনুসারে মানব পাচার নিষিদ্ধ করে এর জন্য অনধিক যাবজ্জীবন কারাদ- এবং কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদ- এবং কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ধারা ৭ অনুসারে সংঘবদ্ধ মানবপাচার অপরাধের দন্ড মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদ- বা কমপক্ষে সাত বছর সশ্রম কারাদ- এবং কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা অর্থদন্ড।
এ ছাড়া এ আইনের ধারা ৮ অনুসারে অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা, ষড়যন্ত্র বা চেষ্টা চালানোর দন্ড হিসেবে অনধিক সাত বছর এবং কমপক্ষে তিন বছর সশ্রম কারাদ- এবং কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা অর্থদন্ড রাখা হয়েছে। ধারা ৯ অনুসারে জবরদস্তি বা দাসত্বমূলক শ্রম বা সেবা প্রদান করিতে বাধ্য করার দন্ড অনধিক ১২ বছর এবং কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদ- এবং কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড। ওই আইনের ধারা ১০ অনুসারে মানবপাচার অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্যে অপহরণ, চুরি এবং আটক করার দন্ড এবং মানব পাচারের অপরাধ সংঘটনের অভিপ্রায়ে বা যৌনশোষণ ও নিপীড়নের শাস্তি অনধিক ১০ বছর এবং কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদ- এবং কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত রাখা হয়েছে। নবজাতক শিশু অপহরণ বা চুরির দন্ড অনধিক যাবজ্জীবন কারাদ- এবং কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদ- এবং কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড রাখা হয়েছে। এ আইনের পতিতাবৃত্তি বা অন্য কোনো ধরনের যৌনশোষণ বা নিপীড়নের জন্য আমদানি বা স্থানান্তরের দন্ড অনধিক সাত বছর এবং কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদ- এবং কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড রাখা হয়েছে। এ আইনের অধীন অপরাধগুলো আমলযোগ্য, আপস অযোগ্য এবং অ-জামিনযোগ্য।
হতাশার বিষয় হলো, নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মানবপাচার অব্যাহত রয়েছে। প্রশ্ন হলো, এ ধরনের সুনির্দিষ্ট আইন থাকার পরও কেন তা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না? অধিক জনসংখ্যা, অসচেতনতা, দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব, দ্রুত নগরায়ন, মাদক ও যৌন ব্যবসা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি বাংলাদেশকে এশিয়ার অন্যতম শিশু ও নারী পাচারের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করেছে। আবার সুখী ও উন্নত জীবনের প্রলোভনে পড়ে আশ্রয়হীন; অসহায় ও হতাশাগ্রস্ত শহরমুখী নারী ও শিশুরাও পাচারের কবলে পড়ে। একশ্রেণির মুনাফালোভী ব্যবসায়ী চক্র নারী ও শিশুদের চাকরি, বিবাহ, ভালোবাসা বা অন্য কিছুর প্রলোভন দেখিয়ে তাদের বিদেশে পাচার করে চলেছে। বছরের পর বছর এসব পাচারকৃত নারী ও শিশু শারীরিক ও যৌন নির্যাতন সহ্য করছে এবং ব্যবহৃত হচ্ছে কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট এর ট্রাফিকিং ইন পারসন্স (টিআইপি) রিপোর্ট গত ২০১৯ অনুযায়ী, প্রতিবছর অনেকেই অনিয়মিত চ্যানেলগুলির মাধ্যমে পাচার হন এবং পাচারকারীদের হাতে শোষণ এবং নির্যাতনের শিকার হয় এই মানুষগুলো। যারা অবৈধভাবে বা অনিয়মিতভাবে বিদেশে যায় বা যেতে বাধ্য হয় তারা সীমাবদ্ধ চলাচল, ঋণচুক্তি, জোরপূর্বক শ্রম, যৌন নিপীড়ন, জোরপূর্বক বিবাহ এবং দাসত্বের মতো সমস্যায় পরেন। মানবপাচার প্রতিরোধে জনসচেতনতার বিকল্প নেই। নিজেকে এবং অন্যান্যের পাচারের হাত থেকে রক্ষা করুন, নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে সহায়তা করুন। আপনার অধিকারগুলো জানুন এবং সব সময় সেগুলো আদায় করার চেষ্টা করুন। পছন্দের দেশ বা চাকরিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে ঝুঁকিগুলো যাচাই করুন। আপনার ভবিষ্যৎ আপনি নিজেই স্থির করুন এবং জেনে ও বুঝে আপনার সিদ্ধান্ত নিন। নিবন্ধিত শ্রম অভিবাসী উপায়গুলো জেনে নিন। যেসব সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থা পাচার প্রতিরোধে কাজ করে তাদের সঠিক তথ্য দেয়া ও সহায়তা করা কর্তব্য। দেশের বাইরে যাওয়ার পূর্বে এটা অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে যেসব ব্যক্তি যোগাযোগ করছে এবং দিক নির্দেশনা দিচ্ছে তারা নিয়োগদাতার বৈধ এবং আইনগত স্বীকৃত প্রতিনিধি কিনা। এ অন্যদিকে এ অবক্ষয় প্রতিরোধে বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্রের পরিচয় জানা এবং মেয়ের অভিভাবকের ছেলের পারিবারিক অবস্থান সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়া প্রয়োজন। পাচারের পরিণতি সম্পর্কে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং পরিবারের সবাইকে সচেতন করা কর্তব্য। কাজের লোক নিয়োগ করার ক্ষেত্রে ছবি তুলে রাখা এবং প্রাক-পরিচয় যাচাই করে নেয়া আবশ্যক। বাড়ির শিশুকে নাম, ঠিকানা ও ফোন নম্বর মুখস্থ করানো, অপরিচিত লোকের দেয়া কোনো খাবার বা জিনিস যাতে গ্রহণ না করে সে বিষয়ে পরিবার থেকেই শিশুকে সচেতন করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে এ বিষয়ে তথ্যকেন্দ্র পরিচালনা করা প্রয়োজন, যাতে পাচার, শোষণ, অবহেলা, নির্যাতন বা অন্য যে কোনো নেতিবাচক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থার অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব হয়। পাশাপাশি মানবপাচার রোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে দারিদ্র্যের কারণে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা এবং বেকারদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। মানবপাচারের বিষয়টি এখন উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। এটি ঠেকাতে আমাদের দারিদ্র্য কমাতে হবে। বৃদ্ধি করতে হবে তরুণদের দক্ষতা। একইসাথে যারা বিদেশে যেতে আগ্রহী তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি পাচার রোধে আইনগুলো কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার, যাতে পাচারকারীরা দ্বিতীয়বার এই অপরাধ করতে ভয় পায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। নারী ও শিশুদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য মানব পাচার বন্ধ করতে হবে। আর এজন্য সমাজের সচেতন জনগোষ্ঠিকে পাচারের বিরুদ্ধে দুর্লঙ্ঘ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, মানবপাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশ বর্তমানে যে ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে তা যথেষ্ট নয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের তৈরি ট্রাফিকিং ইন পার্সন বা টিআইপি ২০১৪ রিপোর্টে বলা হয়েছে, মানবপাচার প্রতিরোধে যেসব পুলিশ কিংবা সরকারি কর্মকর্তা কাজ করছেন, তাদেরকে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণও দেয়া হচ্ছে না। এছাড়াও কাজের জন্যে যারা বিদেশে যাচ্ছেন রিক্রুটিং এজেন্সির কাছেও তারা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন বলে রিপোর্টে বলা হয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক বাংলাদেশি নারী ও পুরুষ, স্বেচ্ছায় বিভিন্ন দেশে কাজ করতে গিয়ে এমন পরিস্থিতির শিকার হন যা বাধ্যতামূলক শ্রমের নির্দেশক। মানব-পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশের বর্তমান ভূমিকা যথেষ্ট নয় উল্লেখ্ করে এই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে যে পাচার হওয়া ব্যক্তিদের সুরক্ষা ব্যবস্থাও সন্তোষজনক নয়।
আইন বাস্তবায়নে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ এবং এ-সংক্রান্ত মামলা পরিচালনায় উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে এই রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশে পাচার প্রতিরোধ বিষয়ক সরকারি টাস্ক ফোর্স বলছে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের হার কমেছে। টাস্ক ফোর্সের প্রধান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কামালউদ্দিন আহমেদ বলছেন, নিয়মিতভাবেই বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলছে।
“সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে সারাদেশে আমাদের মানবপাচার প্রতিরোধ বিষয়ে যেসব কমিটি আছে বিশেষ করে ২০টি মানবপাচারপ্রবণ জেলায় সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ প্রশাসন এবং সীমান্ত-রক্ষী বাহিনী সবাইকেই বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে মামলা পরিচালনা বিষয়ে প্রসিকিউটরদেরও ট্রেনিং দেওয়া হয়।”
তবে দীর্ঘদিন ধরে অভিবাসন ইস্যু এবং মানব-পাচার নিয়ে কাজ করছে এমন সংগঠন রামরুর গবেষক তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ট্রেনিং দেওয়া হলেও তার ধারাবাহিকতা এবং পুরো প্রক্রিয়ায় সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।
“তাদের আগেও ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে কিন্তু তার ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। নারী ও শিশু পাচার এবং শ্রমিক অভিবাসনের মাধ্যমে যারা এই পাচারের শিকার হচ্ছে তাদের একত্র করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে এই ট্রেনিং-এর আওতায় রাখতে হবে।”
সমন্বয় না থাকায় মামলার সংখ্যাও কম বলে জানান তসনিম সিদ্দিকী। মার্কিন রিপোর্টে বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির জালিয়াতি এবং প্রতারণার তথ্য সম্পর্কে তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, বর্তমানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় শ্রমিক পাঠানোর কারণে একদিকে এজেন্সিগুলোর দৌরাত্ম্য অনেকটাই কমেছে। তবে অন্যদিকে এর আড়ালে বাড়ছে কাজের লোভ দেখিয়ে গোপন প্রতারণার ঘটনা।
মানব-পাচার প্রতিরোধ নিয়ে দীর্ঘদিন কর্মরত যশোরভিত্তিক সংগঠন যশোর রাইটস্-এর প্রধান বিনয়কৃষ্ণ মল্লিক মনে করেন, এ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের চেয়ে বেশি দরকার সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতি দূর করা। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই বিচারের আশায় উদ্যোগ নিলেও প্রশাসনের সহায়তা মেলে না। “সাম্প্রতিক সময়ে বৈধভাবে পাসপোর্ট-ভিসা দিয়েই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অনেককে। এক কাজের কথা বলে নিয়ে যাওয়ার পর অন্য কোনও কাজ কিংবা অন্য কোনও এলাকায় রাখা হচ্ছে। রিক্রুটিং এজেন্টদের একাধিক লাইসেন্স থাকায় কখনো একটি লাইসেন্স বাতিল হলেও অন্য নামে তারা ঠিকই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে,”
মানব-পাচার প্রতিরোধে ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার একটি আইন করে, যার সর্বোচ্চ শাস্তি ধার্য করা হয় মৃত্যুদ-। এর অধীনে বিভিন্ন জেলায় বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনারডড, কাজ চলছে।
তবে এসব আদালতে খুব কম সংখ্যায় পাচারকারীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে মার্কিন রিপোর্টে
২০২০ ইং সালের ২৫ জুন বৃহস্পতিবার বলা হয়েছে মানব পাচার (ট্রাফিকিং ইন পারসনস - টিআইপি) প্রতিবেদন মানব পাচার বিষয়ে বিদেশের সরকারগুলোকে যুক্ত করতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রধান কূটনৈতিক উপকরণ। এটি সরকারি পর্যায়ে পাচার-বিরোধী প্রচেষ্টায় বিশ্বের সবচেয়ে বিশদ সম্পদ এবং এটি মানবাধিকার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটিতে বৈশ্বিক নেতৃত্ব দানে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকারের প্রতিফলন। অ্যাম্বাসেডর রিচমন্ড ২০২০ টিআইপি প্রতিবেদন এবং মানব পাচার রোধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা বিষয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
ওয়াশিংটন ফরেন প্রেস সেন্টার, ওয়াশিংটন ডিসি
সঞ্চালক: হ্যালো। আমি ব্রুস জনসন। ২০তম বার্ষিক মানব পাচার প্রতিবেদন প্রকাশ বিষয়ে ফরেন প্রেস সেন্টারের ভিডিওকনফারেন্স ব্রিফিংয়ে স্বাগতম। বৈঠকের হোস্ট এখন সকল সাংবাদিকের মাইক্রোফোন মিউট করে দেবেন। প্রশ্ন করতে আহ্বান না করা পর্যন্ত দয়া করে আপনাদের মাইক্রোফোন মিউট রাখুন। যদি সম্ভব হয়, অনুগ্রহ করে আপনার নাম, প্রতিষ্ঠানের নাম এবং প্রতিষ্ঠান যে দেশের সেই দেশের নাম প্রদর্শনের জন্য আবার লিখুন। আমার সহকর্মীরা আমাদের পাওয়া আরএসভিপি তথ্য ব্যবহার করে সাংবাদিকদের নাম পুনরায় লিখে নেবেন। যেসব সাংবাদিকের নাম ও প্রতিষ্ঠান তালিকাভূক্ত হয়েছে, প্রশ্নোত্তরে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে এবং প্রাথমিকভাবে এফপিসি সাংবাদিকদের আহ্বান করা হবে। ‘জুম’ পর্দার নিচের দিকে “রেকর্ড” বাটনে ক্লিক করে আপনারা এই ব্রিফিং রেকর্ড করতে পারেন, এবং আমরাও এই ব্রিফিংয়ের ট্রান্সস্ক্রিপ্ট পাঠিয়ে দেবো এবং আমাদের ব্রিফিংকালে আপনাদের যদি কোনো কারিগরি সমস্যা দেখা দেয়, আপনারা চ্যাট ফিচার ব্যবহার করতে পারেন, সেক্ষেত্রে মিটিং হোস্ট অথবা আমার এফপিসি সহকর্মীদের কেউ সহায়তা করার চেষ্টা করবে। জুম অধিবেশন ব্যর্থ হলে বা সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে যে কেউ অনুগ্রহ করে লিংকে ক্লিক করে পুনরায় যোগ দেবেন এবং আমাদের বুনিয়াদি নিয়ম হলো এটি রেকর্ডে থাকবে।
এখন আমি আমাদের ব্রিফিংকারীকে পরিচয় করিয়ে দেবো এবং এখানে আসার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাব। অ্যাম্বাসেডর জন কটন রিচমন্ড মানব পাচার পরিবীক্ষণ ও প্রতিরোধ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জের দায়িত্ব পালন করছেন এবং ডিপার্টমেন্টের মানব পাচার পরিবীক্ষণ ও প্রতিরোধ কার্য্যালয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ২০১৮ সালে সিনেট সর্বসম্মতিক্রমে তার নিয়োগ নিশ্চিত করে এবং মানব পাচার প্রতিরোধে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক কর্মকা-ে নেতৃত্ব দেওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারে পাচার-বিরোধী প্রচেষ্টাসমুহের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁকে নিয়োগ দেন।
বিশ্বব্যাপী মুক্তির লড়াইতে একটি বিশিষ্ট ক্যারিয়ার অনুসরণের পর অ্যাম্বাসেডর রিচমন্ড মানব পাচার রোধে নিবেদিত ফেডারেল সরকারের সর্বোচ্চ পদে উন্নীত হয়েছেন।
টিআইপি প্রতিবেদন এখনও বিশ্বজুড়ে মানব পাচার বিষয়ক তথ্যের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাপকাঠি। এটি ১৮৮টি দেশের পরিস্থিতি তুলে ধরে, তুলে আনে মামলা পরিচালনা, সুরক্ষা ও প্রতিরোধ - এই তিন ক্ষেত্রে দেশগুলো কেমন করছে। সরকারগুলো কিভাবে আরো ভালো করতে পারে, সে বিষয়েও কিছু সুপারিশ থাকে প্রতিবেদনে। আমরা একটি র্যাংকিং দিয়ে থাকি এবং মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করার অভিন্ন লক্ষে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের কোন কোন বিষয়ে উন্নতি ঘটাতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এরকম একটি বিবরণীও থাকে। কাজেই প্রতিবেদনটি কর্তৃত্বমূলক, এটি কেবলই এক রোগনির্ণয়ের উপায় নয় এবং এটি এমন এক প্রদিবেদন যা বছরের পর বছর ধরে পরিবর্তন ঘটাতে পেরেছে। আমরা অবশ্যই দেখেছি টিআইপি প্রতিবেদন ও এটির দিকনির্দেশনার ওপর ভিত্তি করে অনেক দেশ পরিস্থিতির উন্নতি ও পরিবর্তন ঘটিয়েছে। প্রতিবেদনটির একটি রেটিং কাল আছে - আমাদের তথ্য সংগ্রহের সময়কাল প্রত্যেক বছরের ১ এপ্রিল থেকে ৩১ মার্চ এবং এ কারণে এই বছরকালে সরকারগুলোর কর্মকা-ই কেবল টিআইপি প্রদিবেদনে মূল্যায়ন করা হয়।
আরেকটা জিনিস মনে রাখার মতো, তা হলো টিআইপি প্রতিবেদন এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের তুলনা করে না। বরং এটি প্রতিবেদনের সময়কালে একটি দেশের প্রচেষ্টার সঙ্গে আগের সময়কালে ওই দেশের প্রচেষ্টার তুলনা করে, কাজেই এটি একটি দেশকে তার নিজের সঙ্গেই পরিমাপ করে। কাজেই আমরা একটি অঞ্চলের দ্বিতীয় সারির কোনো দেশকে নিয়ে আরেক অঞ্চলের দ্বিতীয় সারির আরেকটি দেশের সঙ্গে তুলনা করবো না এবং একই জিনিস প্রত্যাশা করবো না। এখানে আসলে দেখার বিষয় হলো প্রচেষ্টা বৃদ্ধি পেয়েছে কিনা, যতোই দিন গড়াচ্ছে, আমরা টেকসই উন্নতি দেখতে পাচ্ছি কিনা এবং আমি মনে করি এগুলো টিআইপি প্রতিবেদন পাঠে এবং অনুধাবনে আপনাদের সহায়তা করবে।
এ বছর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়: আগের বছরের তুলনায় এবার আমরা ২৩টি দেশের অবনমন এবং ২২টি দেশের উন্নয়ন দেখেছি।
মো: হায়দার আলী সভাপতি জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা