কোভিড-১৯ যা করোনাভাইরাস নামে পরিচিত। প্রাণঘাতী এই কোভিডকে মহামারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। যার প্রভাবে প্রায় ছয় মাসের অধিক সময় বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষ ঘরবন্দী। মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে এলোমেলো করে দিয়েছে এই ভাইরাসটি। ফলে সবাই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অতিবাহিত করছে জীবনযাপন। আগের মতো মানুষ আর মানুষকে বুকে জড়িয়ে নিচ্ছে না ভালোবাসার বন্ধনে। খুব বেশী জরুরী না হলে আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে মানুষ। এভাবে মানুষে মানুষে দূরত্ব অব্যাহত থাকলে মানুষের মধ্যে সম্পর্ক বিচ্ছেদের যে বিষ্ফোরণ ঘটবে তা হবে মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। ফলে মহামারির এই সময়ে সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি হলেও যেনো আপনজনের মধ্যে মনের দূরত্ব সৃষ্টি না হয়।
যদিও অদৃশ্য এই ভাইরাস পুরো বিশ্বকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। এই সময়ে মানুষ স্বাভাকিভাবেই পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন এমনকি জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি পর্যন্ত নিয়ে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। তবে সংকটময় এই পরিস্থিতিতে মানুষ যদি পরিবেশবিরোধী অভ্যাসগুলো ত্যাগ না করে, সেটা যে কতটা ভয়াবহ পরিনতির দিকে নিয়ে যেতে পারে তা কল্পনা করাও কঠিন। বিশ্বের কাছে একেবারে নতুন এই ভাইরাসের ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি। তাই সবাইকে নিরাপদে থেকে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার নীতি মেনে চলে এই ভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচতে হবে এটা যেমন সত্য তেমনি এই ভাইরাস কিভাবে ছড়ায় সেটাও মানুষকে জানতে হবে। পরিবেশ নিয়েও হতে হবে আরো সচেতন।
প্রায় আবদ্ধ ঘরে বিচ্ছিন্নতার জন্য অসহায় লাগতে পারে। প্রযুক্তির ব্যবহারে পরস্পরের খোঁজ রাখা খুব কঠিন নয়। বন্ধু আর স্বজনদের সঙ্গে ই-মেইল, টেলিফোন বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাহায্যে যোগাযোগ রাখা যেতে পারে সবসময়। করোনা সংক্রান্ত হঠাৎ কোনো সাহায্য প্রয়োজন হলে কীভাবে, কার কাছ থেকে শারীরিক ও মানসিক সমস্যার জন্য সাহায্য গ্রহণ করা যাবে, তার একটি আগাম পরিকল্পনা তৈরি করে রাখা যেতে পারে। সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে সাহায্যকারী এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধিসংক্রান্ত তথ্যসমূহ নিজে যেনে পরিবারের সদস্যদের ও অন্যান্যের জানিয়ে রাখা উচিৎ। তথ্যের জন্য কেবল নির্ভরযোগ্য বিজ্ঞানসম্মত উৎস, যেমন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয় বা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) ওয়েবসাইট, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা সরকার থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা বিশেষজ্ঞের দেওয়া তথ্য অন্যকে শেয়ার করা যেতে পারে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ ইস্যুতে বড়দের মতো শিশুরাও মানসিক চাপে ভুগতে পারে। এ সময় তারা মা-বাবাকে একটু বেশি আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়, উৎকণ্ঠিত হয়, নিজেকে গুটিয়ে রাখে, অস্থির হয়, রাগ করে কেউবা হঠাৎ করে বিছানায় প্রস্রাব করা শুরু করে। মানসিক চাপজনিত এ ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে তাদের কথাগুলো মন দিয়ে শুনতে হবে ও একটু বেশি সময় দিতে হবে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের সকল পর্যায়ে শিশুকে তার মা-বাবা ও পরিবারের সঙ্গেই রাখা উচিত এবং তাদের আলাদা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। হাসপাতালে ভর্তি, কোয়ারেন্টিন বা যেকোনো কারণে যদি আলাদা করতেই হয়, তবে টেলিফোন বা অন্য মাধ্যমের সাহায্যে যোগাযোগ রক্ষা করা এবং শিশুদের নিয়মিত অভয় দেওয়া অতীব জরুরী।
উল্লেখ্য, গত ৩০ জুন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাঠ প্রশাসন সমন্বয় অধিশাখার পাঠানো এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কোভিড-১৯ প্রতিরোধে সীমিত আকারে যান চলাচল এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মেয়াদ আগামী ৩ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ায় সরকার। এর আওতায় সরকারি-বেসরকারি অফিস আগামী ৩ আগস্ট পর্যন্ত খোলা থাকবে উল্লেখ করে দোকানপাট ও বিপণিকেন্দ্র ১ জুলাই সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খোলা রাখার অনুমতি দেওয়া হয়। এর আগে ১০ জুন করোনাভাইরাস মোকাবিলার পাশাপাশি জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাপন অব্যাহত রাখতে করণীয় সব কিছু করার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পরপরই ১৫ জুন দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলমান ছুটি আগামী ৬ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়। বলা হয়, করোনাভাইরাস জনিত বৈশ্বিক মহামারির কারণে শিক্ষার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘শুরুর দিকে জীবন ও জীবিকাকে সাংঘর্ষিক ভেবেছিলাম। তখন ভাবা হয়েছে জীবিকা বাদ থাক, জীবন বাঁচাই। পরে দেখলাম, এটা আমাদের বাস্তবতার সঙ্গে যায় না। এখন এভাবে টিকতে পারবো না বুঝতে পারছি। এখন তাহলে আমরা কী করতে পারি? ইতোমধ্যে অনেক মানুষ দরিদ্র হয়েছে, অনেকের চাকরি হুমকিতে, বেতন কমতে শুরু করেছে। এ পরিস্থিতিতে যদি কেউ বের হবেন না বলা হয় সেটি কেউ শুনতে চাইবে না। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানার (যেটা আমরা এখনও নিজে থেকে করি) ব্যাপক প্রচারণা এখনও দরকার। সেটা না মানলে সামাজিক শাস্তি যেটা শুরুর দিকে নেওয়া হচ্ছিল সেটা অব্যাহত রাখতে হবে।’ পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোতে নেই নিয়মের বালাই কোনও নিয়মবিধি না মেনে রাস্তায় নেমে আসা মানুষদের প্রস্তুত করার দায়িত্ব সরকারেরই ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সব মানুষ সব নিয়ম মানবে না। যদি বারবার তাদের নিয়মগুলো মানতে না বলা হয়, তাহলে একসময় তারা অস্বাভাবিক সময়টাকেই স্বাভাবিক ভেবে বসবে। এতে করে বিপদ বাড়বে।’
এ পরিস্থিতিতে বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া মোটেও ঠিক হয়নি উল্লেখ করে হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের পরিচালক ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা লক্ষ করেছি। মানুষের ভিতর করোনা নিয়ে আতঙ্ক জন্মাক সেটি যেমন আমরা চাইবো না। সংক্রমণের ভীতিটা অব্যাহত থাকুক সেটি চাইবো।’
এ পরিস্থিতিতে আমরা যদি জলবায়ু পরিবর্তনের দিকে দৃষ্টি দেই তাহলে দেখা যায় করোনা সংকটের মাঝে জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কারো নেই। আসলে এই সংকটের ফলে বিপর্যস্ত বিশ্ব অর্থনীতি চাঙ্গা করার প্রশ্নেই পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির বিষয়টি উঠে আসছে। বিজ্ঞানীরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে স্থির করা লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করার জন্য হাতে বেশি সময় নেই। বিশেষ করে করোনা সংকটের কারণে জাতিসংঘের কপ-২৬ পরিবেশ সম্মেলন ২০২১ সাল পর্যন্ত পিছিয়ে দেবার ফলে এই আশঙ্কা আরো বাড়ছে। পরিবেশবাদীরাও শিল্পক্ষেত্রে দূষণের মাত্রা সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছেন। তাঁদের মতে, এমন সব কোম্পানি সরকারি আর্থিক সহায়তা নিতে এগিয়ে আসছে, যেগুলি অতিরিক্ত দূষণের জন্য কুখ্যাত। গ্রিনপিস সংগঠনের মতে, পেট্রোলিয়াম, বেসামরিক বিমান চলাচল ইত্যাদি শিল্প করদাতাদের অর্থ কাজে লাগিয়ে আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছে।
এ পরিস্থিতিতে আমরা যদি অর্থনীতির দিকে দৃষ্টি দেই তাহলে দেখা যায় মহামারির বিস্তার অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশ ও ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গত চার দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। বিশ্ব ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এ বছর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গড়ে ১ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে আসতে পারে। অথচ ছয় মাস আগের দেওয়া পূর্বাভাসে এই প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৩ শতাংশ হবে বলা হয়েছিল। প্রকাশিত ‘সাউথ এশিয়া ইকোনমিক ফোকাস’ প্রতিবেদনে বৈশ্বিক ঋণদাতা সংস্থাটি এ পূর্বাভাস দেয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় অর্থনীতি ভারতের। ১ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া নতুন অর্থবছরে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ হতে পারে। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার সরকারি প্রাক্কলনের অর্ধেকেরও বেশি কমে ২ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে নেমে আসতে পারে। তবে সেটাও নির্ভর করছে করোনা সংকট মোকাবিলায় উপর।
বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালের শেষ দিকে দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক উন্নতির যে ধারা লক্ষ্য করা গিয়েছিল বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাস সংকটের নেতিবাচক প্রভাবে তা নষ্ট হয়ে গেছে। ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশে, নেপাল ও ভুটানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি রেখা খাড়াভাবে (শার্প ফল) নিচের দিকে নেমে যাবে। বাকি চার দেশ শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মালদ্বীপে প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়ে যেতে পারে। আফগানিস্তান (মাইনাস ৫ দশমিক ৯ থেকে মাইনাস ৩ দশমিক ৮ শতাংশ), মালদ্বীপ (মাইনাস ১৩ শতাংশ থেকে মাইনাস সাড়ে ৮ শতাংশ), পাকিস্তান (মাইনাস ২ দশমিক ২ শতাংশ থেকে মাইনাস ১ দশমিক ৩ শতাংশ) ও শ্রীলঙ্কা (মাইনাস ৩ শতাংশ থেকে মাইনাস দশমিক ৫ শতাংশ)। বিশ্ব ব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট হার্টউইগ শেফার বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশকে নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করে নিজ দেশের জনগণকে সুরক্ষা দেওয়াকে প্রাধান্য দিতে হবে। কারণ দরিদ্র মানুষেরাই সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে থাকেন।
শেষাংশে বলবো, করোনার সংক্রমণ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভুগছেন প্রায় সবাই। এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকে মনের ওপর তৈরি হয় বাড়তি চাপ। আতঙ্ক, অহেতুক রাগ বা অবসাদের লক্ষণও দেখা দিতে পারে। কিন্তু যেকোনো বিপদ মোকাবিলার সময় চাই ধৈর্য, দায়িত্বশীল আচরণ আর সাহস। কীভাবে এই সময় আপনার প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত, কেমন করে আপনি নিজের পরিবার-স্বজনদের নির্ভরতা দেবেন, সে সঙ্গে সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন করবেন সে দিকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে সবাইকে। সামাজিক দূরত্বের এই সময়ে অন্তত সম্পর্কের বাঁধনটাকে শক্ত করে ধরে রাখতে হবে। বিশেষ করে কারো বিশ্বাসে যেনো চির না ধরে।
লেখক : এম. শাহজাহান, সাংবাদিক