নিউ ইয়র্কের রচেস্টারে নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ ডানিয়েল প্রুডকে ‘শ্বাসরোধ’ করে হত্যার ঘটনায় সাত পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। রচস্টারের মেয়র লাভলি ওয়ারেন সাত পুলিশকে বরখাস্তের ঘোষণা দিয়ে বলেন, সমাজের ভেতর শেকড় গেড়ে বসা বর্ণবিদ্বেষের কারণেই এ মৃত্যু। গত মার্চে পুলিশি হেফাজতে মারা যান প্রুড। গ্রেপ্তার করার সময় পুলিশ তাকে ‘স্পিট হুড’ পরিয়ে রাস্তায় মুখ চেপে ধরলে শ্বাসরোধ হয়ে প্রুড মারা যান বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও তখন ঘটনাটি আড়ালে থেকে গিয়েছিল। তার দুই মাস পর গত মে তে মিনিয়াপোলিসে পুলিশি হেফাজতে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড নিহতের ঘটনায় বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের জন্ম দেয়। শুরু হয় ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন। বিবিসি জানায়, এতদিন চুপচাপ থাকলেও গত বুধবার প্রুডের পরিবারের সদস্যরা এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রুডকে শ্বাসরোধে হত্যার অভিযোগ আনে। রচেস্টারের মেয়র লাভলি ওয়ারেন। ছবি: রয়টার্সরচেস্টারের মেয়র লাভলি ওয়ারেন। ছবি: রয়টার্সরচেস্টারের মেয়র কী বলেছেন? বৃহস্পতিবারের সংবাদ সম্মেলনে মেয়র ওয়ারেন বলেন, ‘‘আমি আজ কাউন্সিলরদের মতামতের বিপক্ষে গিয়েই প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করছি। একই সঙ্গে আমি অ্যাটর্নি জেনারেলকে এ বিষয় তদন্ত শেষ করার আহ্বান জানাচ্ছি। ‘‘ডানিয়েল প্রুড আমাদের পুলিশ বিভাগ, আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এবং আমাদের সমাজ দ্বারা উপেক্ষিত হয়েছেন। এমনকি আমার দ্বারাও তিনি উপেক্ষিত হয়েছে। আমরা তাকে ব্যর্থ করে দিয়েছি।” প্রুডে মার্চে মারা গেলেও মাত্র গত মাসের শুরুতে তিনি বিষয়টি জানতে পারেন জানিয়ে মেয়র আরো বলেন, ‘‘নগরীর পুলিশ প্রধান সময়মত আমাকে প্রুডের মৃত্যুর বিষয়ে জানাতে ব্যর্থ হয়েছেন। ‘‘প্রুডের মৃত্যু প্রমাণ করে দিয়েছে, আমাদেরকে অতীতেও অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। আজও আমাদেরকে সেই একই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে।” প্রুডের পরিবারের অভিযোগের পর জনগণের দাবির মুখে গত বুধবার পুলিশের বডি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ প্রকাশের পর তার মৃত্যুর বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সামনে আসে। এ বিষয়ে ওয়ারেন বলেন, ভিডিওতে যা দেখা যাচ্ছে আর পুলিশ প্রধান তাকে যা জানিয়েছিলেন তা ‘সম্পূর্ণ ভিন্ন’। ‘‘তিনি আমাকের প্রাথমিকভাবে মাদকের অতিরিক্ত ব্যবহার কে এর কারণ হিসেবে জানিয়েছিলেন। ‘‘আমি ব্যক্তিগত ভাবে এবং পেশাগত ভাবে পুলিশ প্রধান লা’রন সিংলেটারির উপর গভীর হতাশ।’’ এ ঘটনায় পুলিশ প্রধানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কিনা সে বিষয়ে মেয়র এখনই কিছু জানাননি। একই দিন পুলিশ প্রধান সিংলেটারি দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তার বিভাগ এ ঘটনা জনগণের থেকে আড়াল করার চেষ্টা করেনি। ‘‘এটা আড়াল করা হয়নি। আমাদের কাজ হচ্ছে এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে মেডিকেল ইনভেস্টিগেশন করা এবং ওই রাতে ঠিক ওই কাজই করা হয়।” নিউ ইয়র্কের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস গত এপ্রিলে এ ঘটনার তদন্ত শুরু করে। কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। নিউ ইয়র্কের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো ‘যত দ্রুত সম্ভব’ এ মামলা শেষ করার আহ্বান জানিয়েছেন। ডানিয়েল প্রুডের সঙ্গে কী হয়েছিল? প্রুডের ঘটনায় তার ভাই, জো পুলিশ ডেকেছিলেন। ওয়ারহাউসে কাজ করা প্রুড ৫ সন্তানের জনক; তিনি সেদিন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। বিবিসি জানায়, গত ২৩ মার্চ জো তার ভাইয়ের তীব্র মানসিক সমস্যার কথা জানিয়ে নিউ ইয়র্কের রচেস্টারের পুলিশকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হতে অনুরোধ করেন। “আমি আমার ভাইয়ের সাহায্যের জন্য পুলিশ ডেকেছিলাম, তাকে মেরে ফেলতে নয়,’’ বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে এমনটাই বলেছেন জো। পুলিশ উপস্থিত হওয়ার আগে প্রুড হাল্কা তুষারপাতের মধ্যে নগ্ন হয়ে রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করছিলেন। তিনি ‘আমি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত’ বলেও চিৎকার করছিলেন। বডি ক্যামেরার ফুটেজে ঘটনাস্থলে পুলিশ আসার পর প্রুডকে কর্মকর্তাদের নির্দেশ মানতে দেখা গেছে। পুলিশের কর্মকর্তারা যখন তাকে মাটিতে শুয়ে হাত পেছনে রাখতে বলেন, তখনও তিনি ‘অবশ্যই, অবশ্যই’ বলেছেন। এরপরই হঠাৎ করে প্রুড উত্তেজিত হয়ে ওঠেন; ঘিরে থাকা কর্মকর্তাদের গালি দেন ও থুতু নিক্ষেপ করতে থাকেন। তবে ফুটেজে তাকে কখনোই পুলিশের কাজে শারীরিকভাবে বাধা দিতে দেখা যায়নি। প্রুড পুলিশকে জানান, তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। এরপরই পুলিশ সদস্যরা তাকে ‘স্পিট হুড’ পরিয়ে দেন। বিশেষ তন্তু দিয়ে বানানো জালের মতো এই ‘স্পিট হুড’ মূলত সন্দেহভাজনদের থুথু বা শ্লেষ্মা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীদের রক্ষা করে। সমালোচকদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে এই ‘স্পিট হুড’ ব্যবহারের বিরোধিতা করে আসছেন। তারা বলছেন, এটি কেবল বিরক্তিকর ও অপমানজনকই নয়, যার মাথা ও মুখ এই ‘স্পিট হুড’ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হবে তার ‘প্যানিক অ্যাটাক’ হতে পারে।
এমনকী আটক ব্যক্তির শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা হচ্ছে কি না, এই আবরণের কারণে তা বোঝাও দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে, বলছেন তারা। ভিডিওতে এরপর পুলিশের এক সদস্যকে দুই হাত দিয়ে প্রুডের মুখ রাস্তার উপর ঠেসে ধরতে এবং ‘থুথু দেওয়া বন্ধ কর’ বলতে শোনা গেছে। এরপর প্রুড শান্ত হয়ে ও নির্জীব হয়ে যান। অ্যাম্বুলেন্সে তোলার আগে স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রুডের জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এক সপ্তাহ পর, ৩০ মার্চ তার লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়।