চলমান বৈশিক মহামারী করোনা সঙ্কটে বড়ই কাহিল হয়ে পড়ছে দেশের শিক্ষাসূচি। প্রথমে চলতি বছরের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী বাতিল, দ্বিতীয়ত জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা বাতিল, প্রতিষ্ঠান খোলার ১৫ থেকে ২০ দিন পর এইচএসসি পরীক্ষার চিন্তা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ছুটি বাড়ানোয় সর্বোপরি করোনায় শিক্ষাসূচিতে যেমন নেমে এসেছে ভয়াবহ বিপর্যয়, তেমনই বাড়ছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে চলতি বছরের পুরো শিক্ষাসূচি তছনছ হয়ে গেছে। ৫ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী এখন ঘরে বন্দি। বাসগৃহে সীমিত আকারে লেখাপড়ার চর্চা থাকলেও কার্যত পড়াশোনার বাইরে এসব শিক্ষার্থীরা। কবে নাগাদ স্কুল-কলেজ খুলবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। পরীক্ষা নিয়েও নানা অনিশ্চয়তায় ভর করছে। সব মিলিয়ে পড়ালেখা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন কমবেশি ১০ কোটি শিক্ষার্থী-অভিভাবক।
গণমাধ্যে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, গত ১ সেপ্টেম্বর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কথা থাকলেও করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে তা খুলছে না। বরং ছুটি বাড়িয়েছে মন্ত্রণালয়। করোনায় সংক্রমণের হার ও মৃত্যু সংখ্যা না কমলে এ ছুটি ফের বাড়ানো হতে পারে। অভিভাবকদের বেশী শঙ্কা পরীলক্ষিত হচ্ছে পরীক্ষা নিয়ে। ৫ম শ্রেণির শিক্ষা সমাপনী বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। এইচএসসি, অষ্টম শ্রেণির জেএসসি, জেডিসি পরীক্ষার পরিবর্তে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে মূল্যায়ন পরীক্ষার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অন্তত শতাধিক পরীক্ষা বাতিল হয়েছে। বাতিল হয়েছে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ¯্রাধিক পরীক্ষাও। ফলে বড় ধরনের পরীক্ষা জটে পড়তে যাচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও। এই শিক্ষাজট কাটিয়ে উঠতে লেগে যেতে পারে কয়েক বছর।
এ দিকে করোনার কারণে অনলাইনে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তার খুব একটা সুফল মিলছে না। আবার অনলাইন পাঠদানে শহরের শিক্ষার্থীরা কিছুটা বইমুখী হলেও গ্রামের শিক্ষার্থীর বেলায় এই হার কার্যত শূন্য। কারণ গ্রামের শিক্ষার্থীরা অনলাইন সুবিধা পাচ্ছে না। এ ছাড়া করোনায় স্কুলের টিউশন ফি নিয়ে অভিভাবক ও স্কুল কর্তৃপক্ষের মধ্যে চলছে চরম বিরোধ। স্কুল কর্তৃপক্ষ পুরো টিউশন ফি চাইছে। আর অভিভাবকরা বলছেন, প্রতিষ্ঠান বন্ধ। পাঠদান নেই। তাই অন্তত ৫০ শতাংশ টিউশন ফি মওকুফ চাইছেন তারা। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ তা মানতে নারাজ। এ বিষয়টিও উদ্বেগের পাল্লা ভারী করছে অভিভাবকদের।
চলতি বছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে না। এই পরীক্ষা না নেওয়ার ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের সারসংক্ষেপে অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। গত ২৬ আগস্ট সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন এ তথ্য জানান। প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, আমরা এ বছর এই দুটি পরীক্ষা নিচ্ছি না। যদি স্কুল খোলা যায় তাহলে বিভিন্ন পদ্ধতিতে স্কুলেই বার্ষিক পরীক্ষা নিবো।
বার্ষিক পরীক্ষার ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আকরাম-আল-হোসেন জানিয়েছেন, এটা স্কুল কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে, আমরা তাদের দায়িত্ব দেবো। শিক্ষকরা যেভাবে প্রশ্ন করবেন সেভাবেই হবে, স্ব স্ব বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এই সিদ্ধান্ত দেবেন। তিনি বলেন, জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমিকে (নেপ) সেপ্টেম্বর, অক্টোবর এবং নভেম্বর মাসের জন্য তিনটি পাঠ পরিকল্পনা করতে বলা হয়েছিল। যেহেতু সেপ্টেম্বরে এখনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি তাই অক্টোবর এবং নভেম্বরকে সামনে রেখে যে পাঠ পরিকল্পনা করা হয়েছে এর ভিত্তিতে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা নিবে স্কুলগুলো। এ ছাড়া সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কীভাবে স্কুল খোলা যায়, সেই নীতিমালা ইতোমধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে। শিগিগরই তা জারি করা হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কবে খোলা হবে, সেই সিদ্ধান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় একসঙ্গে বসে নেবে। কবে স্কুল খোলা যাবে তা এখনও সীদ্ধান্ত হয়নি।
প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বার্ষিক পরীক্ষার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করা গেলে পাঠ্যক্রমের ৪০ শতাংশ পড়ানো হবে। আর নভেম্বরে শুরু করা গেলে পড়ানো হবে ২৮ থেকে ৩০ শতাংশ। অপরদিকে, করোনা পরিস্থিতি শুরুর আগে পাঠ্যক্রমের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পড়ানো হয়েছে। আগের ও পরের পঠিত মোট পাঠ্যক্রমের ওপর ডিসেম্বরের শেষের দিকে নেওয়া হবে বার্ষিক পরীক্ষা।
পরিকল্পনায় আগামী ২০ ডিসেম্বর শ্রেণি কার্যক্রম শেষ করার প্রস্তাব আছে। অক্টোবরে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করা গেলে আগে-পরে মিলিয়ে পাঠ্যবইয়ের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ পড়ানো শেষ করা হবে। আর নভেম্বরে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করা গেলে আগে-পরে মিলিয়ে ৬০ থেক ৬৩ শতাংশ পড়ানো সম্ভব হবে। সেই অনুযায়ী সিলেবাস পরিমার্জন করার কাজও শেষ হয়েছে। এ ছাড়া চলতি বছর স্কুল খোলা হলে শীতকালীন ছুটি বাতিল করা হবে।
গত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আগস্টেও এ পরীক্ষা নেওয়া যায়নি। কবে নেওয়া যাবে এ বিষয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। শুধু বলা হচ্ছে, পরীক্ষা শুরুর ১৫ থেকে ২০ দিন আগে পরীক্ষার সূচি প্রকাশ করা হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ১৫ থেকে ২০ দিন পর এই পরীক্ষা হবে। ১৪ লাখ পরীক্ষার্থীর এই পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল আলোচনায় বলেছেন, 'কবে নাগাদ অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে আমরা জানি না। অনেক কিছুই আমাদের পরিকল্পনায় রেখেছি। তবে এখন পর্যন্ত এইচএসসি পরীক্ষার কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার পরিস্থিতি হয়নি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর মার্চ মাসের আগে সাধারণত ক্লাস শুরু হয় না। আমরা যদি ফেব্রুয়ারির মধ্যে ভর্তি সম্পন্ন করতে পারি, তাহলে যারা এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবে তাদের এক দিনও সময় নষ্ট হবে না বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়ে।
করোনাভাইরাস মহামারি পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয়ভাবে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা হবে না। তবে বিকল্প হিসেবে এবার অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ বিদ্যালয়ে মূল্যায়ন করে তাদের নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করা হবে।
এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে গত ১ সেপ্টেম্বর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে চিঠি দেয়া হয় কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং সব শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যাদের।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২ সেপ্টেম্বর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের চিঠি দিয়ে ঢাকা বোর্ড বলেছে, করোনা সংক্রমণের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ২০২০ সালের জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা না নিয়ে স্ব স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে নবম শ্রেণিতে উন্নীত করা হবে।
চিঠিতে এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাসময়ে নির্দেশনা দেয়া হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কোন পন্থায় এই মূল্যায়ন করা হবে- তা এখনও স্পষ্ট করা হয়নি।
এর আগে গত ৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় পিইসি পরীক্ষা না নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। একই বৈঠকে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা না নেওয়ার ব্যাপারেও আলোচনা হয়েছিল। সে আলোকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সারসংক্ষেপ পাঠানো হয়েছিল। যা অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তবে জেএসসি-জেডিসির বিষয়ে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সারসংক্ষেপ পাঠানো নিয়ে কেউ মুখ খুলতে চাচ্ছেন না। তবে একটি সূত্র জানিয়েছে, শিক্ষাবিদরা পরীক্ষা বাতিলের পক্ষে মতামত দিলেও পরীক্ষা নেওয়ার পক্ষে রয়েছেন বোর্ড চেয়ারম্যানরা।
করোনাভাইরাস মহামারি পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয়ভাবে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা হবে না। তবে বিকল্প হিসেবে এবার অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ বিদ্যালয়ে মূল্যায়ন করে তাদের নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করা হবে।
এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে ইতোমধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে চিঠি দেয়া হয় কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং সব শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যাদের।
উল্লেখ্য, করোনার কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে সরকার। সর্বশেষ কিছুদিন আগে এই ছুটির মেয়াদ আগামী ৩রা অক্টোবর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।
(এম. কে. দোলন বিশ্বাস, সাবেক সহ-সম্পাদক, দৈনিক সংবাদ)