মানব পাচারের ঘটনায় মামলা হওয়ার পাশাপাশি বিশেষ অভিযান চালিয়ে পুলিশ আসামিদের গ্রেফতার করছে। পাশাপাশি পুলিশি তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেলে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। কিন্তু সিংহভাগ মামলার আসামিরা বিচার শেষে খালাস পেয়ে যায়। গত দুই বছরে নিষ্পত্তি হওয়া ৮১ শতাংশেরও বেশি মানব পাচারের মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছে। মাত্র ১৩টি মামলায় আসামিরা দ-িত হয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের মতে, আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হলেও আসামি খালাসের হার বেশি হওয়ার পেছনে আর্থিক ক্ষতিপূরণ পেয়ে ভুক্তভোগীর মামলা পরিচালনার অনীহাই মূলত দায়ি। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্বল অভিযোগপত্রে পার পেয়ে যাচ্ছে মানব পাচারকারীরা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানব পাচার প্রতিরোধ সেলের তথ্যানুযায়ী বিগত ২০১৮ সালে মানব পাচার প্রতিরোধ আইনের সর্বমোট ৩১টি মামলা বিচারের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়। তার মধ্যে ২৭টি মামলায় আসামিরা খালাস পায়। চারটি মামলায় সাজা হয়। সাজাপ্রাপ্ত মামলার আসামিদের মধ্যে ৭ জনের যাবজ্জীবন এবং একজনের অন্যান্য মেয়াদে সাজা হয়। তার বিপরীতে বিচারিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে খালাস পেয়েছে ৫৪ জন। ওই বছর মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে মামলা হয়েছিল ৫৬১টি। প্রাথমিক তদন্ত শেষে পুলিশের পক্ষ থেকে ৪৮৯টি মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছিল। আর ১৫১টি মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট দেয়া হয়। আর ২০১৯ সালে মানব পাচার প্রতিরোধ আইনের সর্বমোট ৩৯টি মামলা বিচারিক কার্যক্রমের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়। তার মধ্যে ৩০টি মামলায়ই আসামি খালাস পায় ৬৮ জন এবং ৯টি মামলায় সাজা হয়। ওসব মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয় ২৫ জন। তার মধ্যে ১৭ জনের যাবজ্জীবন এবং বাকি ৮ জনের অন্যান্য মেয়াদে সাজা হয়। গত বছর মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে মোট মামলা নথিভুক্ত হয়েছিল ৬৮৫টি। প্রাথমিক তদন্ত শেষে ৫৯৮টি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। আর ৯৭টি মামলায় চূড়ান্ত রিপোর্ট দেয়া হয়।
সূত্র জানায়, চলতি বছরে মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে দায়ের হওয়া মামলার মধ্যে বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার পর সাজা না হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে বিচারের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে ১০টি মামলা। তার মধ্যে ৯টিতেই আসামি খালাস পেয়েছে আর সাজা হয়েছে একটি মামলায়। মোট ১০টি মামলায় আসামি ছিল ৩১ জন। তার মধ্যে একজনের অন্যান্য মেয়াদে সাজা হয়েছে। বাকি ৩০ জন খালাস পেয়েছে। চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে মামলা হয়েছে সর্বমোট ২২৬টি। তার মধ্যে প্রাথমিক তদন্ত শেষে ১০২টি মামলায় অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। মানব পাচারের অধিকাংশ মামলাই হয়ে থাকে হিউম্যান স্মাগলিংয়ের ধারায়। সাধারণ মানুষ মূলত স্বেচ্ছায় বাড়তি আয়ের জন্য বিদেশ গিয়ে প্রতারিত হয়ে থাকে মানুষ। পরে দেশে ফিরে মামলা করার পর শুরু হয় তদন্ত। তদন্তের একটা পর্যায়ে আসামিদের কাছ থেকে আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার প্রস্তাব পেয়ে থাকে। তারপর তারা আর মামলা পরিচালনা করতে চায় না। ফলে অনেক মামলায় অভিযোগপত্র হলেও আসামি খালাস হয়ে যায়। তাছাড়া সময়মতো সাক্ষীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে না পারার কারণেও বিচার কার্যক্রমের দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়। যার একপর্যায়ে খালাস পেয়ে যায় আসামিরা।
সূত্র আরো জানায়, নিয়ম অনুযায়ী ভুক্তভোগীর অভিযোগ নথিভুক্ত করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় আইনি প্রক্রিয়া। মামলার পর শুরু হয় তদন্ত। তদন্তকারী কর্মকর্তা এ পর্যায়ে আসামি গ্রেফতার, অভিযোগের স্বপক্ষে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহসহ কয়েকটি ধাপে কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। তারপর তথ্যপ্রমাণে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেলে পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযোগপত্র প্রস্তুত করে বিচারিক কার্যক্রম শুরুর জন্য আদালতে দাখিল করা হয়। আর প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা না পেলে আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়ে মামলা থেকে আসামিদের অব্যাহতি দিতে আবেদন করে পুলিশ। কিন্তু তদন্তকারী সংস্থার পক্ষ থেকে অভিযোগপত্র দেয়া হলেও ২০১৮ ও ২০১৯ সালে মানব পাচার প্রতিরোধ আইনের ৭০টি মামলার মধ্যে ৮১ শতাংশ মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছে। আর সাজা হয়েছে ১৮ শতাংশ মামলায়।
এদিকে আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, মানব পাচার প্রতিরোধ আইনের মামলাগুলোয় শক্তপোক্ত তথ্যপ্রমাণ ব্যতীত আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত করা কঠিন বিষয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানব পাচারকারীরা তদন্তকারী সংস্থার দুর্বল অভিযোগপত্রে পার পেয়ে যায়। আবার কিছু ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের ফলেও মামলার স্বাভাবিক তদন্ত কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে প্রসিকিউশন সার্ভিস পেতেও ভুক্তভোগীদের বেগ পেতে হয়। তাতে করে একদিকে যেমন মানব পাচারকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না, অন্যদিকে ভুক্তভোগীরা এ ধরনের মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
অন্যদিকে মানব পাচার প্রতিরোধ আইনের মামলাগুলো মনিটরিং করে পুলিশ সদর দপ্তরের স্পেশাল ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট শাখা। সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে হালনাগাদ তথ্যসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পতিবেদন দেয়া হয়। প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মানব পাচার প্রতিরোধ আইনের ১৪৫টি মামলা ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে। পাঁচ বছরের বেশি সময় বিচারাধীন রয়েছে ৪৭৮টি মামলা। ওসব মামলার অধিকাংশই সময়মতো সাক্ষী হাজির করতে না পারায় বিলম্বিত হয়ে চলেছে।
মানব পাচার মামলার দুর্বল অভিযোগপত্রের বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা জানান, তদন্তই একটি মামলায় একমাত্র দিক নয়। যখন একজন পুলিশ কর্মকর্তা তদন্ত করেন, তখন তাকে অবশ্যই পেশাদারিত্বের মধ্য দিয়ে এগোতে হয়। তিনি নিখুঁত তদন্তের চেষ্টা করেন, যদিও এক্ষেত্রে উন্নতির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তাদের পশিক্ষণের ওপর জোর দেয়া হয়, যাতে তারা পেশাদারিত্বের সঙ্গে নিখুঁতভাবে তদন্ত শেষ করতে পারেন।