নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্পন্ন বিদ্যুতের অভাবে নিজস্ব ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করে (ক্যাপটিভ পাওয়ার) দেশের বড় শিল্প কারখানাগুলো কার্যক্রম চালাচ্ছে। অথচ সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। শিল্প মালিকরা লোড ও ভোল্টেজ ওঠানামার কারণে গ্রিডের ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছে না। মূলত বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধির সমান্তরালে সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থার উন্নয়ন না হওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফলে ক্ষতি হচ্ছে ত্রিমুখী। শিল্প খাত এবং বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সরকারের বিদ্যুৎ বিতরণকারী কোম্পানিগুলো নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ দিতে না পারায় শিল্প মালিকরা কারখানার উৎপাদন অব্যাহত রাখতে ক্যাপটিভ বিদ্যুতে ঝুঁকছে। যদিও গ্রিড বিদ্যুতের চেয়ে ক্যাপটিভ বিদ্যুতে খরচ বেশি। এখনো শিল্প-কারখানায় গ্রিড বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ পাওয়া যায় না। তার ওপর প্রায় সময়ই ভোল্টেজ ওঠানামা করে। তাতে উৎপাদন ব্যাহত ও পণ্যের ক্ষতি হয়। ফলে ব্যবসায়ীদের বিপুল পরিমাণ লোকসানও গুনতে হয়। তাছাড়া ভোল্টেজ ওঠানামায় কারখানার যন্ত্রপাতির ক্ষতি হয় এবং জীবনকাল কমে যায়। ফলে এককালীন ক্ষতিও কম নয়। শিল্প-কারখানার উৎপাদনে এই বাধা ও ক্ষতির কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। যার প্রভাব খুচরা ভোক্তা পর্যায়েও পড়ে। আর রপ্তানিমুখী শিল্পে খরচ বেড়ে যাওয়ায় বৈশ্বিক বাজারে মূল্য প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশের পণ্য।
সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ১৩৮টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। সেগুলোর দৈনিক উৎপাদনক্ষমতা ২০ হাজার ৩৮৩ মেগাওয়াট। কিন্তু এখন পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ ব্যবহৃত হয়েছে ১২ হাজার ৮৯৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। আর গড় ব্যবহার ১১ হাজার মেগাওয়াটের বেশি নয়। ফলে অন্তত সাড়ে ৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত থাকছে। আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী ১০ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত রাখা উচিত নয়। ওই হিসেবে দেশে ২ হাজার ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অলস থাকতে পারে। কিন্তু দৈনন্দিন প্রয়োজনের চেয়ে সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে উদ্বৃত্ত থাকছে। চলতি বছর আরো ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গ্রিডে যুক্ত হবে। অথচ দেশের বড় শিল্প কারখানাগুলো নিজস্ব ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। শিল্পের এই নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনকে ক্যাপটিভ পাওয়ার বলা হয়। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) তথ্যানুযায়ী ২ হাজার ৯০৭টি কারখানায় প্রায় ৩ হাজার ৭০৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার সক্ষমতা রয়েছে। তবে শিল্প খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, এ ধরনের কারখানার সংখ্যা এবং মোট উৎপাদনক্ষমতা অনুমোদিত সংখ্যা ও সক্ষমতার চেয়েও বেশি।
সূত্র আরো জানায়, শিল্প মালিকরা সঠিক লোড ও ভোল্টেজে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে দীর্ঘদিন দেনদরবার করে চলেছে। কিন্তু আশানুরূপ ফল না পাওয়ায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে বড় শিল্পকারখানাগুলো ক্যাপটিভ বিদ্যুতের ওপর নির্ভর করেই চলছে। ১ থেকে ৫ মেগাওয়াটের ছোট ছোট বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো শিল্প উৎপাদনে জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করলেও বহুমাত্রিক খরচ বাড়িয়েছে। ফলে উৎপাদিত পণ্যের দামও বাড়ছে। তাতে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সক্ষমতা কমছে। বিদ্যুতের সার্বিক উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রায় প্রতি বছর নিত্যপ্রয়োজনীয় এই সেবাপণ্যের দাম বাড়ছে। তাতে জনগণেরও খরচ বাড়ছে। আর সরকারি কোষাগার থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি বাবদ বেরিয়ে যাচ্ছে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ববাজারে মূল্য প্রতিযোগিতায় দেশের রপ্তানিমুখী পণ্যগুলোর সক্ষমতা কমছে।
এদিকে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, এখনো গাজীপুরে স্থাপিত কারখানাগুলোতে বছরে গড়ে ৪৩৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকে না। সাভার, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে বার্ষিক এই লোডশেডিংয়ের পরিমাণ যথাক্রমে ৩৩০, ২৯২ ও ৩৩৮ ঘণ্টা। বিদ্যুতের লোড ও ভোল্টেজ ওঠানামার কারণে কারখানাগুলোতে বছরে ৩৫ লাখ থেকে ৫৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতি হয়। পাশাপাশি বিদ্যুতের নতুন সংযোগ পেতেও উদ্যোক্তাদের ভুগতে হয়। এমন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন শিল্পের মালিকদের জেনারেটরে উৎপাদিত ক্যাপটিভ বিদ্যুতেই ভরসা করতে হয়। ক্যাপটিভ বিদ্যুতের জেনারেটর, ব্যাকআপ ব্যাটারি, জ্বালানি (গ্যাস বা ডিজেল), আলাদা জনশক্তি ও স্থাপনা বাবদ শিল্প মালিকদের বিপুল অর্থ খরচ হয়। তাদের মধ্যে অনেকের কারখানার নিজস্ব চাহিদা মিটিয়েও আরো বিদ্যুৎ উৎপাদন করার ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু দাম নিয়ে সরকারের সঙ্গে একমত না হওয়ায় ওই অব্যবহৃত বিদ্যুৎও গ্রিডে আসছে না। শিল্প উদ্যোক্তাদের মতে, ক্যাপটিভ পাওয়ারের অব্যবহৃত বিদ্যুৎ ব্যবহার করা গেলে উৎপাদন খরচ কমানো যেত। যার ইতিবাচক প্রভাব দেশীয় এবং রপ্তানিনির্ভর পণ্যেও পড়তো।
অন্যদিকে দেশে চাহিদা না থাকায় অনেক বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র অলস পড়ে থাকে। উৎপাদন না হলেও সেগুলোর স্থাপনা বা কেন্দ্রভাড়া বাবদ সরকারকে মাশুল (ক্যাপাসিটি চার্জ) দিতে হয়। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে সরকার প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত বেসরকারি বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদেরকে ৬১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে। ওই পরিমাণ অর্থ দিয়ে দুটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যায়। আর গত ১০ বছরে সরকার বিদ্যুৎ খাতে অন্তত ৫২ হাজার ২৬০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। অথচ গ্রাহক যে দামে বিদ্যুৎ কেনে তা প্রকৃত উৎপাদিত মূল্যের চেয়ে বেশি নয়। তার মানে ভর্তুকির টাকা বেসরকারি খাতের বসে থাকা কেন্দ্রগুলোর পেছনে ব্যয় হয়েছে। এর মাধ্যমে খালি হচ্ছে রাষ্ট্রের কোষাগার। যা বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সামাল দিচ্ছে সরকার। তাতে শূন্য হচ্ছে জনগণের পকেট। সর্বশেষ গত মার্চে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির সদস্য (গ্যাস) মো. মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী জানান, বেশি খরচ হলেও শিল্পমালিকরা নিরবচ্ছিন্ন ও গোলযোগহীন বিদ্যুৎ না পাওয়ার কারণে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। সরকার টেকসই বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে কাজ করছে। সেভাবে নানানীতি এবং পরিকল্পনাও করা হয়েছে। এখন বিতরণ ও সঞ্চালন সংস্থাগুলোকে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। বিইআরসি নিয়মিত সে নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে।
একই প্রসঙ্গে সম্প্রতি এক সেমিনারে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে এখন কোনো সমস্যা নেই। পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ রয়েছে। কিন্তু মানসম্পন্ন ও টেকসই বিদ্যুৎ উত্পাদন ও সরবরাহ বড় চ্যালেঞ্জ। শিল্প এবং বাণিজ্যে বিদ্যুৎ ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য ইতিমধ্যে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তাদের সমস্যা এবং দাবিগুলো নিয়ে ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে।